কোন কিছুর জন্ম হওয়া, প্রাণ ধারণ করা একমাত্র সৃষ্টিকর্তার নৈপুণ্য ছাড়া অসম্ভব। মানুষ সৃষ্টি নিয়ে সুরাহ বালাদ এ আল্লাহ বলেন ,

لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ فِیۡ کَبَدٍ

নিঃসন্দেহে আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে।

অর্থাৎ মানুষ সৃষ্টিগতভাবে আজীবন শ্রম ও কষ্টের মধ্যে থাকে। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]তাফসীরে জাকারিয়া

মানুষের জন্মের সূচনা থেকেই শুরু হয় কষ্ট। প্রসবের সময়ও শিশুটিকে মায়ের সরু প্রসব রাস্তা থেকে বেরিয়ে আসতে বেশ কসরত করতে হয়। তবে তারও পূর্বে শুন্য থেকে নয় মাস ধাপে ধাপে তাকে পরিবর্তিত হতে হয় যার ইঙ্গিত আল্লাহ কুরআনে দিয়েছেন।

‘তোমাদের সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভে—পর্যায়ক্রমে, একের পর এক ত্রিবিধ অন্ধকারে।’ (সুরা জুমার, আয়াত : ৩৯/৬)

মাতৃগর্ভে শিশুকে সংরক্ষণের জন্য মাতৃজঠরের তিনটি পর্দা বা স্তরের কথা কোরআনে বলা হয়েছে। যথা—পেট বা গর্ভ, রেহেম বা জরায়ু এবং ভ্রূণের আবরণ বা ভ্রূণের ঝিল্লি গর্ভফুল (Placenta) (বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান, পৃষ্ঠা ২৭৭)

‘আমরা মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমরা তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আধারে (জরায়ুতে) স্থাপন করেছি। এরপর শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে গোশতপিণ্ডে পরিণত করেছি, এরপর গোশতপিণ্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে গোশত দ্বারা আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে নতুনরূপে করেছি।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১২-১৪)

রাসুলুল্লাহ (সা.) মাতৃগর্ভে মানবশিশু জন্মের স্তর সম্পর্কে এভাবে বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির উপাদান আপন মাতৃগর্ভে বীর্যের আকারে ৪০ দিন, জমাট বাঁধা রক্তে পরিণত হয়ে ৪০ দিন, গোশত আকারে ৪০ দিন। এরপর আল্লাহ একজন ফেরেশতাকে পাঠান এবং চারটি বিষয়ে আদেশ দেন যে, তার (শিশুর) আমল, রিজিক, আয়ুষ্কাল ও ভালো না মন্দ—সব লিপিবদ্ধ করো। অতঃপর তার মধ্যে রুহ ফুঁকে দেওয়া হয়।’ (বুখারি, হাদিস : ২৯৬৮)

উপরে যে সংক্ষিপ্ত আয়াত আমরা দেখলাম তা অনেক আগের কথা হলেও বিজ্ঞান এখন এ কথা স্বীকার করে যে মানুষের সৃষ্টি একটি অতীব জটিল কিন্তু সূক্ষ্ম ক্যালকুলেশন ছাড়া অসম্ভব।

গর্ভধারণের জন্য প্রথমে ওভুলেশন হওয়া জরুরি। স্বাভাবিক ভাবে অধিকাংশ মেয়েদের এই পর্যায় বয়ঃসন্ধিকাল থেকে মেনোপজ পর্যন্ত চলতে থাকে।পরবর্তী পিরিয়ডের ১৪ দিন পূর্বে ওভুলেশন ঘটে অর্থাৎ ডিম্বাশয় থেকে পরিপক্ক Graafian follicle ফেটে পরিপক্ক ডিম্বাণু বেরিয়ে আসে এবং বিবাহিত নারির ক্ষেত্রে ওভালুশনের ২৪ -৭২ ঘন্টার মধ্যে উপযুক্ত পরিবেশে ফার্টিলাইজেশন হয়।

এসময় ডিম্বাণু ও শুক্রানু থেকে ২৩ টি করে ক্রোমোসোম এসে মিলিত হয় যা থেকে প্রায় ৩৬ ঘনটার মধ্যে এককোষী জাইগোট তৈরি হয়। পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে জাইগোট দুই, চার,আট,ষোল,চৌষট্টি এভাবে বিভক্ত হয়ে morula তৈরি করে এবং পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে একশ কোষ বিশিষ্ট ব্লাস্টোসিস্টে পরিবর্তন হয়। ব্লাস্টোসিস্ট এর পরে জরায়ুর দেয়ালে এন্ডোমেট্রিয়ামে প্রোথিত হয়, যাকে ইমপ্লানটেশন বলে।

এর পরে এই গুচ্ছ কোষটি আরো বিভক্ত হতে থাকে যার কিছু ভ্রূণ তৈরি করে আর কিছু প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল তৈরি করে। ব্লাস্টোসিস্টে দুই ধরনের এম্ব্রাওনিক সেল থাকে যার একটি হল ট্রফোব্লাস্ট ও অন্যটি হল ইনার সেল মাস। ট্রফোব্লাস্ট থেকে প্লাসেনটা ও ইনার সেল মাস থেকে ভ্রুন তৈরি হয়।

উপরের বর্ণনা অনুযায়ী দেখা যায় সন্তানের বেড়ে ওঠার সুবিধার জন্য মায়ের শরীরে বাড়তি কিছু অংশ প্লাসেনটা,আম্বিলিকাল কর্ড, এমনিওটিক স্যাক, এমনিওটিক ফ্লুইড তৈরি হয়, সেই সাথে হরমোনের পরিমাণগুলো ২৮০+- ১৪ দিন যাবত কমা ও বাড়ার খেলায় নিয়োজিত থাকে।

গর্ভফুল (Placenta) ভ্রূণ বৃদ্ধি, সংরক্ষণ,রোগ প্রতিরোধ ইত্যাদি কাজে অন্যতম ভূমিকা রাখে। এটি মায়ের শরীর থেকে রক্তের মাধ্যমে নানা পুষ্টি ভ্রূণের দেহে বহন করে, আবার খুব ধীর গতিতে রেচন পদার্থ এর মায়ের দেহের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। গর্ভফুলের সাহায্যে ভ্রূণ অক্সিজেন (02) গ্রহণ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2) ত্যাগ করে মায়ের ফুসফুসের মাধ্যমে, জীবাণু (Infection) থেকেও ভ্রূণকে রক্ষা করে।

এ ছাড়া ভ্রূণটি ঠিকমতো জরায়ুতে আটকে রাখা, পুষ্টি সঞ্চয়, সম্পর্ক রক্ষা, হরমোন সৃষ্টি ইত্যাদি কাজেও বিশেষ ভূমিকা রাখে। গর্ভকালীন সময় বাড়ার সাথে সাথে জরায়ু পেলভিক লাইন থেকে উপরের দিকে উঠে যায় এবং উপরের দিকে এবডমিনাল ক্যাভিটি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এই সময় জরায়ু তার স্বাভাবিক আকার থেকে প্রায় পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পায় ,ফলে আশেপাশের এবডমিনাল অরগানগুলোকে চেপে থাকতে একপ্রকার বাধ্য করে। জরায়ুর আকার বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে এর ভিতর রক্তের প্রবাহ বেড়ে যায় এবং জরায়ু পেশির কার্যক্ষমতাও বেড়ে যায়।

গর্ভাবস্থায় রক্তের প্লাজমা ঘনত্ব ৫০ শতাংশ ও লাল রক্ত কনিকা প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। মা ও শিশুর মেটাবলিক হার বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেন এর চাহিদাও ২০-৪০ শতাংশ বেড়ে যায়। তাছাড়া  musculoskeletal সিস্টেম বা পেশী ও হাড়, এন্ডোক্রাইন বা হরমোন নিঃসরণ, রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেম বা প্রজনন, কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেম বা রক্ত সংবহন, রেস্পিরাটরি সিস্টেম বা শ্বসনতন্ত্র , গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সিস্টেম বা পাকস্থলী ও এতে শোষণ পদ্ধতি এবং রেনাল বা রেচন সংক্রান্ত কিছু পরিবর্তন সংঘটিত হতে পারে।

এইসব অন্তর্নিহিত কারণে অন্তঃসত্ত্বা নারীর বিভিন্ন শারীরিক অস্বস্তি হওয়া খুবই স্বাভাবিক তবে এর কারণ ও প্রতিকার নিয়ে জানলে সমস্যাগুলো কে অসহনীয় কষ্ট মনে হয় না।

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা