সিরিজ ইনডেক্স
১. ১ম পর্ব
২. ২য় পর্ব
৩. ৩য় পর্ব
সকাল এগারোটায় আবার ফোন দিলাম, পরামর্শ করে ঠিক করলাম কাছের আদ-দ্বীন হাসপাতাল থেকে চেক-আপ করে আসলে ভালো হবে। ভাবী তার বাসা থেকে হেঁটেই এসেছেন। আমার বাসার কাছাকাছি আসার পর আবারো কন্ট্রাকশন শুরু হল। লেবারের প্রথম স্টেজে হাঁটা হাঁটি করলে পেলভিক ইনলেট প্রসারিত হয়। পেলভিস এর হাড় যুক্ত থাকে লিগামেন্ট দিয়ে। লেবার পেইন এর সময় এই লিগামেন্ট রিল্যাক্সিন হরমোনের প্রভাবে প্রসারিত হয়ে যায়। আর এসময় মনোযোগ অন্যদিকে দিলে ব্যথা সহ্য করা সহজ হয় ।
হাঁটার বদলে আমরা এবার রিকশায় চড়ে রওনা দিলাম। কনট্রাকশন এর ফ্রিকোয়েনসি আর লেন্থ ক্যালকুলেশন করলাম। ফ্রিকোয়েনসি আসলো পনেরো মিনিট আর লেন্থ ৫০ সেকেন্ড। অর্থাৎ, পনেরো মিনিট পর পর কন্ট্রাকশন হয় আর ৫০ সেকেন্ডের মতো অব্যাহত থাকে। রিকশার ঝাঁকুনিতে কন্ট্রাকশন আরো তীব্র হচ্ছিলো। অবাক হলাম এই মায়ের শান্ত ভাব দেখে। ইনিই কিনা আগের ডেলিভারিতে প্রচন্ড ব্যাথায় চিতকার করার কারণে নার্সের ধমক খেয়েছিলেন। অবশ্য লেবার এর আর্লি স্টেজে আছি মাত্র, শেষ অবধি এতোটা শান্ত থাকতে পারেন কিনা সেটা নিশ্চিত নই।
হাসপাতালে পৌঁছানোর পর হাঁটার সময় থেমে থেমে যাচ্ছিলেন। কনট্রাকশন না থামা পর্যন্ত এগুতে পারছিলেন না। আমরা ডাক্তার দেখানোর জন্য অপেক্ষা করছি, মাঝে গ্যাপ ১০ মিনিট; ১ ঘন্টার অগ্রগতি। সময় যেটুকু আছে এই ফাঁকে একটা সফল ডেলিভারির গল্প শুনালাম। লেবারে এমন পজিটিভ আলোচনা খুবই জরুরি, মা এর মানসিকতাকে মোটিভেট করে। যিনি সাপোর্ট পারসন থাকবেন, তার এই টেকনিক গুলো জানা থাকা উচিৎ।
কথা বলার ফাঁকেও আমি সময় মত কন্ট্রাকশন পরিমাপ করে যাচ্ছি। ডাক্তার এর রুমের সামনে দাঁড়াতেই কন্ট্রাকশন উধাও! মেডিকেল স্টাফ দের পি ভি চেকের বিষয়টি গর্ভবতী মায়ের উপর এতোটাই প্রভাব বিস্তার করে যে এড্রনালিন (ভয় থেকে পালানোর হরমোন) এর প্রভাবে ডাইলেশন (জরায়ু মুখের প্রসারণ) উল্টো পিছন দিকে ফিরে যায়।
ডাক্তার দেখেই ভর্তি হতে বললেন। আমরা এই আদ-দ্বীন হাসপাতাল থেকে মগবাজারের আদ-দ্বীন এর দিকে রওনা দিব ভাবলাম। তবে প্রস্তুতি ছিলোনা বলে ব্যাগ আনার জন্য আবার বাসায় যেতে হল। (করণীয় যাচাই করার আগে মা ও বাবার ইচ্ছাকে সমর্থন করা জরুরি। কেননা রিস্ক জোন এ পড়ে গেলে দায়ভার আমার হবে)
তীব্র ব্যথায় তিনি শুধু আমার হাত শক্ত করে ধরেছিলেন। এছাড়া কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ল না। সিএনজি করে যাচ্ছিলাম আমরা। যাওয়ার সময় তিনি চুপচাপ ব্রিদিং প্র্যাকটিস করছিলেন। আর দু’আ করছিলেন। ভাবলাম, তৃতীয় প্রেগন্যান্সি হওয়ার কারণেই হয়তো তার সহনশীলতা বেড়ে গিয়েছে। মাঝে শুধু একবার বলে উঠলেন, “এর চাইতে সিজার করা ভালো।”
বিকাল চারটার দিকে হাসপাতালে পৌঁছাই আমরা। সিএনজি থেকে নেমে ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভর্তি করানোর কাগজপত্র ঠিক করতে কাউন্টারে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হয়েছিলো। ৫ মিনিট ভর্তি কাউন্টার এ অপেক্ষা করার পর ভাবী ফ্লোরে বসে পড়লেন। আমি দ্রুত হুইল চেয়ারের খোঁজে গেলাম। তাকদীরের ফায়সালা, হুইল চেয়ার পেলেও আয়া পেলাম না। আমি নিজেই চেয়ার নিয়ে রওনা দিলাম। আসার পর হুট করেই কোথা থেকে যেন আয়া বেগম উদয় হলেন।
ডেলিভারি ওয়ার্ড তিন তলায়। আয়ার এক কথা, ভর্তি কাগজ ছাড়া রোগী তিনি নিবেন না। বকাবকি করে তাকে রাজি করাতে হলো। রোগী মোটামুটি ফুল ডাইলেটেড, অবস্থা দেখে বুঝাই যাচ্ছে। ট্রানজিশন ফেইজে গেলেই শুধু নিজের ওপর কন্ট্রোল থাকেনা। তিনি ট্রানজিশন ফেইজে আছেন বলেই কন্ট্রোল হারিয়ে ফ্লোরে বসে পড়েছেন। না হলে এমন ধপ করে বসার কথা না। ফ্লোরে বসার আগ পর্যন্তও আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। আমার ব্রেইনে তখন ঘুরছে এই সময়ে মায়েরা ব্যথায় চিতকার করে।
উপরে নিয়ে বেডে পিভি চেকের জন্য শোয়ানো হল। বেশি দেরি হয়নি, নার্স গ্লাভস পরার জন্যে অপেক্ষা করছে মাত্র, এর মধ্যেই ভাবী চিতকার করে ওঠলেন, কিছু একটা বের হয়ে যাচ্ছে। পরক্ষনেই পানি ভেঙে গেলো আর বাচ্চার মাথা বের হয়ে গেল। আলহামদুলিল্লাহ।
বাকি সময় নার্স বাচ্চা বের করতে সাহায্য করল, ভাবীও পুশ করছিলেন। বাবু বের করেই নার্স নাড়ী কেটে দিল। নবজাতককে কোলে নিয়ে আমি ওর বাবাকে ডেকে আনলাম।
তারপর…. সেই আযান দেওয়ার দৃশ্য! মানুষ জন্মানোর সময় আযান দিতে হয়, আর আল্লাহর কাছে ফিরে গেলে সালাত পড়তে হয়। বিষয়টার ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। এ এক অদ্ভুত ব্যালেন্স!
এই ডেলিভারি থেকে আমার প্রাপ্ত শিক্ষা হল আনমেডিক্যাটেড বার্থ এর উপকারিতা অসীম। আমরা যদি আরো আগে আসতাম, তাহলে স্যলাইন দিত, ইনডাকশন ব্যবহার করত। এতে পেইন এর ধারাবাহিকতায় ব্যাঘাত ঘটতো। পুশ করার সময় মায়ের নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ থাকত না।
এপিসিওটমি (বা দেশীয় ভাষা সাইড কাটার) করার সম্ভাবনা বেড়ে যেত। পূর্বে দুটো ডেলিভারিতে এই সাইড কাটার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো বলে ভাবী বারবার ভয় পাচ্ছিলেন। এই সাইড কাটার কারণেই সেকেন্ড ডেলিভারির পরে সিজারিয়ান মায়েদের মত কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিলো তাকে। এক মাস ঘুমাতে পারেননি। তার মাঝে এপিসিওটমির ভয়টা তীব্র ছিল। ভয়টা কাটানোর জন্যই এ নিয়ে প্রায় আলাপ করতাম।
এবারে, সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, তার প্রাকৃতিক প্রসব হয়েছে। এমনকি, নরমাল ডেলিভারির মত কোন ঔষধ প্রয়োগ করতে হয় নি। তবে অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছি, খুব বেশি দেরি করে না যাওয়াই উত্তম। কিছুটা মধ্যম পন্থা অবলম্বন করলেই ভালো।