প্রবাসে করোনাকালীন সময়ে দ্বিতীয় সন্তান জন্মদানের অভিজ্ঞতা হল।প্রথম সন্তানের বেলায় উত্তেজনা উৎসাহ আর আতঙ্কের এক মিশ্র অভিজ্ঞতা ছিল। দ্বিতীয় সন্তানের বেলায় অভিজ্ঞতার কারণে কিছুটা নির্ভার থাকলেও, প্রত্যেক প্রেগনেন্সি যে ভিন্ন সেটা উপলব্ধি করেছিলাম।
![](https://matritto.b-cdn.net/wp-content/uploads/2019/03/Sept-20-pre-post-natal.jpg)
আমার প্রথম প্রেগনেন্সির কথা একটু বলি। প্রথম সন্তান জন্ম গ্রহণ করে নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর ৪২ সপ্তাহে। ইন্ডিউস করার মাধ্যমে পেইন উঠানোর কারণে লম্বা সময় (১৫ ঘন্টা) লেবারে থাকতে হয়েছিল। এপিডুরাল নেয়ার কারণে শরীরের নিচের অংশ অবশ হয়েছিল, যার কারণে ১০ সেন্টিমিটার সার্ভিক্স ওপেন হওয়ার পরেও পুশ করতে দুই ঘন্টার বেশি সময় লেগেছিল। দীর্ঘ সময় ধরে পুশ করা সত্ত্বেও বাচ্চার মাথা বের হচ্ছিল না। তিনবার ফরসেপ দিয়ে চেষ্টার পর ডেলিভারি না হওয়া, বাচ্চা অনেকক্ষণ টিউবে থাকার কারণে যখন বাচ্চার শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হচ্ছিল, ডাক্তার নার্ভাস হয়ে বলছিল আমাদের হাতে আর অল্প কিছু সময় আছে বাচ্চাকে নিরাপদে বের করে নেয়ার। তখন শুধু আল্লাহকে বলছিলাম এই যাত্রায় এতদূর আসার পর আমাকে নিরাশ করো না, আমার সন্তানকে নিরাপত্তার সাথে দুনিয়াতে পাঠাও। এর ৫ মিনিটের মাঝে আমার সন্তান দুনিয়াতে আসে, আর আমি নিস্তেজ হয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলছিলাম “ আলহামদুলিল্লাহ”।
দ্বিতীয় প্রেগনেন্সিতে তাই লক্ষ্য ছিল শুরু থেকেই দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া এবং একটু পড়াশুনা করে আমার পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব প্রস্তুতি নেয়া। আট মাস চলাকালীন ডাক্তার জানালো বাচ্চার মাথা নিচের দিকে যা বেশ ভালো একটি লক্ষণ, তা সত্বেও প্রথম সন্তান যেহেতু নির্ধারিত সময় পার হয়ে জন্মেছিল, তাই এবারও মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে। এরমধ্যে আমি যে শহরে থাকে সেখানে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে অনেক বিধি-নিষেধ আরোপ করছিল এবং ডাক্তার-নার্স দ্বিধার সাথে দূরত্ব নিয়ে সেবা দিচ্ছিলেন। তার ওপর হসপিটালে ডেলিভারির আগে আবশ্যক করোনা টেস্ট করিয়ে পজিটিভ আসলে আইসোলেটেড রেখে খুব সতর্কতার সাথে সেবা দেয়া হচ্ছিল।
আমার মায়ের সাথে শেয়ার করলে মা ও বললেন বেশি বেশি দোয়া করার কথা। ডেলিভারির কয়েক মাস আগে থেকেই চেষ্টা করতাম শরীরটা ভালো থাকলে তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য। লম্বা সময় ধরে আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম আমার জন্য যেন সব কিছু সহজ হয়, সময়ের মধ্যেই যেন আমার সন্তান দুনিয়াতে আসে। অন্যতম একটি দোয়া ছিল প্রসব বেদনা যেন কম হয় আর এপিডুরাল এর প্রয়োজন যেন না হয়। আমি খুব বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতাম যে আমার দোয়া বৃথা যাবেনা।
এর মাঝে অষ্টম মাসে বাচ্চার ওজন কম মনে হওয়াতে ডাক্তার একটু উদ্বিগ্ন হয়েছিল তাই তিনবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে হয়েছিল। ডাক্তারের পরামর্শমতো খাবার পরিমাণ বাড়িয়ে ছিলাম আর একটিভ থাকার চেষ্টা করছিলাম। আমার স্বামী আলহামদুলিল্লাহ পুরো প্রেগনেন্সির সময় জুড়ে খুব সাপোর্টিভ ছিলেন। আমাদের সাড়ে তিন বছরের মেয়েকে এবং আমাকে দেখার পাশাপাশি, সাংসারিক কাজে অংশ নিতেন।
নবম মাসে ডাক্তার পরীক্ষার পর জানালো বাচ্চার মাথা একদম নিজের দিকে, তাই ব্যথা উঠলে যেন তৎক্ষণাৎ হসপিটালে চলে যাই। আমি ধীরেসুস্থে শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। আমার মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম, স্বামীসহ সংসারের কাজ করতাম আর সাথে অনলাইন রিসোর্স ঘাটাঘাটি করে পাওয়া টিপসগুলো কাজে লাগানোর চেষ্টা করতাম। ব্রিদিং এক্সারসাইজ গুলো প্র্যাকটিস করতাম, এর সাথে নোটস নিয়েছিলাম লেবারে থাকাকালীন আমার করণীয়গুলো। আমার বান্ধবী তার প্রসবকালীন অভিজ্ঞতা শেয়ারের সময় বলেছিল তার ডেলিভারি দুদিন আগে হঠাৎ করে হওয়া প্রচন্ড ক্লান্তির কথা।
আমার ডিউ ছিল ২৭ নভেম্বর। ১৩ নভেম্বর রুটিন হাঁটাহাঁটির পর রাতে আমি খুব ক্লান্ত বোধ করতে থাকলাম, মনে হল যেন কথা বলতে ও শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। আমার শরীর ও মন জানান দিচ্ছিল লেবার শুরু হওয়ার ব্যাপারে। পরদিন ১৪ ই নভেম্বর আমি সাংসারিক কাজ গুছিয়ে রাখলাম, সাথে আমার পড়াশোনার কিছু কাজ ছিল, সেগুলো সম্পন্ন করলাম মাথা ঠান্ডা রেখে। সন্ধ্যায় আবার রেড মিউকাস দেখা দিল। স্বামীকে প্রস্তুতি নিতে বললাম, মেয়েকে কাউন্সেলিং করলাম। সন্ধ্যা থেকে অল্প ব্যথা অনুভব করলেও মনকে বুঝাতে লাগলাম আল্লাহর সাহায্যে আমার জন্য সব কিছু সহজ হবে। স্বামীকে হসপিটালে অনেক দৌড়াদৌড়ির মধ্যে থাকতে হবে তাই তাকে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিলাম আর আমি মেয়েকে নিয়ে শুয়ে পরলাম। এর মাঝে ১৫ মিনিট পরপর কন্ট্রাকশন হতে লাগলো। যতবার ব্যথা আসতে লাগল, জিকির করে মনকে ঘুরানোর চেষ্টা করছিলাম। যদিও ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছিল লেবার শুরু হওয়া মাত্র হসপিটালে যেতে, প্রথমবারের অভিজ্ঞতার কারণে আমি চাইছিলাম বাসায় থেকে মানসিক ও শারীরিকভাবে যতদূর সম্ভব এনার্জেটিক থাকতে। হসপিটালে যাওয়া মাত্রই অসুস্থতা কেন যেন বেড়ে যায়, আর নার্স বারংবার এসে এপিডুরাল প্রয়োজন কিনা জিজ্ঞেস করতে থাকে, যা মনকে আরো দুর্বল করে দেয়।
১৫ ই নভেম্বর সকাল থেকে ১০ মিনিট পর পর ব্যাথা হতে লাগলো। ব্যাথার ফাঁকে খেজুর সহ হালকা কিছু খাবার খাচ্ছিলাম এনার্জির জন্য। আমার স্বামী বারবার রেস্ট নিতে বলেছিলেন, কিন্তু আমি অ্যাক্টিভ থাকার জন্য হেঁটে হেঁটে টুকটাক কাজ করছিলাম। বাচ্চার আর আমাদের দুপুরের খাবার প্রস্তুত করলাম। ব্যাথার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় গোসল করে নিলাম, ব্যথা কমাতে বেশ সাহায্য করল । দুই কন্ট্রাকশন এর মাঝামাঝি সময়ে দুপুরের খাবার খেতে চেষ্টা করলাম বারোটার দিকে। ইমারজেন্সিতে কথা বলে ১০ মিনিট পর পর কন্ট্রাকশন কথা জানালাম, নার্স হসপিটালে যেতে বলল।
হসপিটালের ব্যাগ আগেই রেডি করে রেখেছিলাম, বাচ্চাকে এক পারিবারিক বন্ধুর বাসায় রেখে হসপিটালে গেলাম। পথে যতবারই ব্যথা আসছিল, হিসনুল মুসলিমের সহজতার দু’আ টি পড়ছিলাম। সোয়া দুইটার দিকে হসপিটালে পৌঁছানোর পর ইমারজেন্সিতে আগে পরীক্ষা করছিল, এটা কি আসল নাকি ফলস লেবার। জরায়ুর মুখ ৫ সেন্টিমিটার খুলেছে দেখে সাথে সাথে লেবার রুমে ঢুকালো। ৫ মিনিট পর পর কন্ট্রাকশন শুরু হওয়ার পর ব্যাথার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ব্রিদিং এক্সারসাইজ করছিলাম, যাতে অনেকটুকু ব্যাথা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলাম।
এরমধ্যে করোনা টেস্ট করিয়ে নেগেটিভ আসাতে, নার্স কাছে এসে আরও কিছু টেকনিক বলল। কপালে আর চোখে ভেজা নরম কাপড় দিল জলপট্টির মত, যা বেশ আরাম দিচ্ছিল। ২০ মিনিট পর ৯ সেন্টিমিটার ওপেন হল, সবাই তাড়াতাড়ি ডেলিভারির প্রিপারেশন নিল।সার্ভিক্স একপাশে ওপেন হয়ে, অন্য পাশে শক্ত থাকায় ২ পায়ের মাঝে বার্থিং বল দিয়ে নার্স হালকাভাবে নড়াচড়া করালো শোয়া অবস্থায়। সাথে সাথে ওয়াটার ব্রেক হল।
১০ সেন্টিমিটার ওপেন হওয়ার পর ডাক্তার বলল ব্লাডার খালি করে আসতে, তাহলে আর ক্যাথেটার দেয়া লাগবেনা। সাথে পুশ করতে নিষেধ করল। আমি দাঁড়াতেই নিচে প্রচন্ড চাপ অনুভব করলাম। ডাক্তার আবার শুইয়ে দিয়ে পুশ করতে বলল, আমি স্বাভাবিকভাবে করলাম। প্রচন্ড ব্যথার মাঝে ১০ মিনিটের মধ্যে আমার দ্বিতীয় সন্তান দুনিয়াতে আসলো চারটা চল্লিশে আলহামদুলিল্লাহ। আমার সব দোয়া কবুল হওয়ার পর ডেলিভারির এক সপ্তাহ পর পর্যন্ত মাথায় শুধু কুরআনের একটা আয়াত ঘুরছিল
“ ফাবিআইয়ি আলা ইরাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান” (তুমি তোমার প্রতিপালকের কোন অবদানকে অস্বীকার করবে?)”।
সুরা আর-রাহমান
লিখেছেন: উম্ম রাওয়াশিদ