সাধারণত গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী মা’র খুব ঘন ঘন ক্ষুধা লাগে। একজনের গর্ভে নতুন একটি প্রাণ বেড়ে উঠছে, অন্যজন থেকে খাবার খেয়ে আরেকজন বেড়ে উঠছে। তাই তাদের ক্ষুধা লাগার পরিমাণ একজন সুস্থ মানুষের চাইতে কিছুটা বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে সাওম একটি ফরজ ইবাদত, মুসলিম হিসেবে যেটা তিরিশ দিন রোজা রাখার মাধ্যমে রমজান মাসে বছরে একবার আমরা পালন করি।
গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মা এই সাওম পালন করা নিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়েন। গর্ভকালীন যাত্রা সবার এক রকম হয় না। গর্ভবস্থায় অনেকে রোজা রাখতে পারেন না, কারণ পেট খালি হলেই তাদের প্রচন্ড বমি হয়। আবার অনেক গর্ভবতী মায়েদের কোন রকম সমস্যা হয় না। ১৪ থেকে ১৭ ঘণ্টা না খেয়ে থাকলেও তাদের শরীর খুব বেশি একটা খারাপ হয় না অথবা বাচ্চার উপর কোন প্রভাব পড়ে না।
অন্যদিকে সম্পূর্ণরূপে বুকের দুধের উপর নির্ভরশীল বাচ্চা’র মা অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকলে বাচ্চা বুকের দুধ পাবে না। সেক্ষেত্রে তারা সাওম পালন করা নিয়ে দোটানায় থাকেন। যথাযথভাবে বিষয়গুলো জানা না থাকায় অনেকেই অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন যে, গর্ভবতী হবার কারণে বা বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য সাওম পালন করতে পারছি না। এ ব্যাপারে ইসলামী শারিয়াহ’র অবস্থান কী? এটা জানতে আমরা জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ইসলামকিউ/এ এর একটি প্রশ্নোত্তরের অনুবাদ এখানে তুলে ধরছি।

ইসলামী শারিয়াহ এ ব্যাপারে কী বলে?
এটা বোঝার জন্য আমরা দুই ধরনের অবস্থা বিবেচনা করতে পারি। প্রথমত, যদি স্তন্যদানকারী মা সাওম পালন করার কারণে কোন শারীরিক কষ্ট বোধ না করে বা তা তার শারীরিক কোন জটিলতা সৃষ্টি না হয় এবং তার সন্তান ভালোভাবেই খেতে পারছে , কোন সমস্যা হচ্ছে না । সে ক্ষেত্রে সাওম না রাখা তার জন্য উচিত হবে না, অর্থ্যাৎ তিনি সাওম পালন করবেন। দ্বিতীয়ত, যদি স্তন্যদানকারী মা সাওম পালন করার ফলে শারীরিক সমস্যা বোধ করেন, সেক্ষেত্রে না রাখাই উত্তম। বরং সাওম পালন করা মাকরুহ হবে । তবে পরবর্তীতে এই রোজাগুলো কাযা আদায় করে নিতে হবে।
কিছু বিশেষজ্ঞগণ এভাবে বলেন যদি তার রোজা রাখার ফলে বাচ্চাকে না খেয়ে থাকতে হয় (যে বাচ্চা শুধু বুকের দুধ খায় ) তার জন্য রোযা না রাখা উত্তম বরং বাচ্চার ক্ষতি হলে রোযা তার জন্য হারাম হবে।
আল মিরদাওঈ আল ইনসাফ (৭/৩৮২) এ বলেছেন, “এ ধরনের ক্ষেত্রে (যেখানে রোজা রাখার কারণে মা বা সন্তানের শারীরিক বা দুধ খাওয়ায় সমস্যা হতে পারে – সম্পাদকের নোট) রোজা রাখা মাকরুহ হবে…. ইবনে আকিল বলেছেন এ ঘটনা মাকরুহ হবে, যদি গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী মা এই ভয় পায় যে, না খেয়ে থাকলে তার বাচ্চার কোন সমস্যা হবে । সে ক্ষেত্রে এটা তার জন্য ভালো হবে না, যদি সে রোজা রাখে।
শায়েখ ইবনে উথায়মীন, ফাতওয়া আল সিয়াম (পৃঃ১৬১) প্রশ্ন করা হয়েছিল: “যদি গর্ভবতী মা বা স্তন্যদানকারী মা কোন কারন ছাড়াই রোযা না রাখে এবং তার শরীর যদি সুস্থ থাকে রোজার কারণে দুর্বল হয়ে না যায় এমতাবস্থায় তার জন্য সাওম পালনের আইন কি হবে?
উত্তরে তিনি বলেছেন: যদি কোন ধরনের শারীরিক অসুস্থতা না থাকে তবে রমজানে সবারই রোজা রাখা উচিত আর যদি কোন অসুস্থতাজনিত কারণে রোজা রাখতে না পারে তবে সেটা কাযা আদায় করে নিতে হবে ।
“তোমাদের মধ্যে যারা অসুস্থ বা সফরে আছে তারা পরে গুণে গুণে সেই পরিমাণ দিন পূরণ করে নেবে” -সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৫
এখানে অসুস্থ বলতে বোঝানো হয়েছে সেসব গর্ভবতী এবং স্তন্যদানকারী মা, যাদের রোজা রাখার কারণে গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি হতে পারে অথবা বুকের দুধ শুকিয়ে যেতে পারে। ফলে বাচ্চাকে না খেয়ে থাকতে হতে পারে সে ক্ষেত্রে যতদিন রোজা বাদ যাবে ততদিন তারা পরবর্তীতে আদায় করে নিতে হবে।
কয়েকজন আলেম বলেছেন, রোজা ছেড়ে দেয়া প্রতিদিনের জন্য তাদেরকে কোন একজন গরিব ব্যক্তিকে পেটভরে খাওয়াতে হবে এবং পরবর্তীতে অবশ্যই কাযা রোজা আদায় করে নিতে হবে। এর বিপরীত মতামত হলো শুধু ছেড়ে দেয়া রোজা আদায় করে নিলেই হয়ে যাবে, খাবার খাওয়ানোর কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ইমাম আবু হানিফার মতামত হলো যেসব বিষয়ে কোরআন বা হাদীসে কোথাও সুষ্পষ্ট প্রমাণ নেই, সেটা অবশ্য পরিপালনযোগ্য কোন বিষয় না। গরীবকে খাওয়ানোর বিষয়ে যেহেতু এরকম কোন প্রমাণ নেই, তাই এটি পালনের আবশ্যকতা নেই। এ বিষয়ে ইমাম আবু হানিফার মতটি প্রণিধানযোগ্য।
শায়খ আবু উথায়মিন কে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল (ফাতওয়া আল সিয়াম পৃষ্ঠা ১৬২), একজন গর্ভবতী যিনি তার গর্ভস্থ সন্তানের ব্যাপারে ভীত এবং রোজা ছেড়ে দেন, তার ব্যাপারে শরীয়াহ কী বলে?
উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “এখানে দুটি দৃশ্য দেখতে হবে। প্রথমত, গর্ভবতী যদি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হন এবং রোজা থাকার কারণে তার গর্ভের সন্তানের যদি কোন সমস্যা না হয় তবে তাকে রোজা রাখতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ যদি তিনি গর্ভাবস্থার শেষ পর্যায়ে থাকেন বা শারীরিক দুর্বলতা বা অন্য কোন সমস্যার কারণে রোজা রাখতে না পারেন সে ক্ষেত্রে রোজা রাখা উচিত হবে না। বিশেষত যদি তার গর্ভস্থ সন্তানের কোনো ক্ষতির কোন আশঙ্কা থাকে রোজা ছেড়ে দেয়া আবশ্যক হতে পারে। পরবর্তীতে অন্যদের মতো (যারা শারীয়াহ গ্রহনযোগ্য কারণে রোজা ছেড়েছেন) ছেড়ে দেয়া রোজা অবশ্যই আদায় করে নিবেন। বাচ্চা প্রসব করার পরে নিফাস থেকে পবিত্র হয়ে রোজা আদায় করে নিবেন। অনেক সময় দেখা যাবে গর্ভাবস্থার অজুহাত শেষে অন্য অজুহাত আসতে পারে (যেমন বাচ্চাকে স্তন্যদান)। এধরনের ক্ষেত্রে স্তন্যদায়ী মা’কে পানাহার করতে হবে, বিশেষত প্রচন্ড গরমের সময়। এক্ষেত্রে বাচ্চার পুষ্টি মা’র উপর নির্ভর করে। তাই মা রোজা ছেড়ে দিবেন এবং এই অজুহাত (দুধ খাওয়ানো) যখন থাকবে না তখন কাযা আদায় করতে হবে।
শায়েখ ইবনে বাজ (মাজমু আল ফাতওয়াতে ১৫/২২৪) বলেছেন, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য এটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে , আনাস ইবন মালিক আল কাবী সূত্রে, আহমাদ দ্বারা বর্ণিত, ” হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারা রোজা রাখবে না এবং তাদেরকে মুসাফির ব্যক্তির মত বিবেচনা করা হবে ।”
এ থেকে বোঝা যায় মুসাফিরদের মত বিবেচনা করে রোজা না রাখার ব্যাপারে অনুমতি দেওয়া হয়েছে এবং পরবর্তীতে তা আদায় করে নিতে বলা হয়েছে । বিশেষজ্ঞরা বলেন , তারা শুধু তখনই রোজা রাখবেন যখন রোজা রাখা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য না বা তাদের বাচ্চাদের জন্য ক্ষতিকর হবে না । আল্লাহ ভালো জানেন।
ফাতওয়া আল লাজনাহ আর দাঈমাহ(১০/২২৬) তে বলা হয়েছে –
গর্ভবতী মা যদি নিজেকে বা গর্ভস্থ সন্তানকে নিয়ে কোন আশঙ্কা বোধ না করেন তবে তাকে রোজা রাখতে হবে। ক্ষতির আশঙ্কায় থাকলে রোজা বাদ দিবেন এবং তা পরবর্তীতে অবশ্যই আদায় করে নিতে হবে।
তথ্যসূত্রঃ ইসলাম কিউ/এ
সম্পাদনায়: হাবিবা মুবাশ্বেরা
You must be logged in to post a comment.