
আমার বিয়ের পর থেকেই আমি আর আমার হাজব্যান্ড আল্লাহর কাছে একটা নেককার সন্তান চাচ্ছিলাম। আমার পিসিওএস (PCOS) থাকায় প্রায় ২ বছর অপেক্ষা করেও কনসিভ করছিলাম না। তারপর ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করলাম। ৮ মাস ধরে মেডিসিন নিয়েও যখন কনসিভ হচ্ছিলো না তখন আমি আর আমার হাজব্যান্ড খুব হতাশ হয়ে গেলাম।
নবম মাসে আমার আবার ডাক্তারের সাথে কনসাল্টের ডেট ছিলো। কিন্তু আমরা আর যাইনি। আগের মাসের ওষুধের সাথে লেট্রল কেনা ছিলো দেখে শুধু ওই মেডিসিনটাই খেয়েছি ওই মাসে আর বাকিসব মেডিসিন অফ করে দিছিলাম হতাশ হয়ে। তবে ওই মাসে আমি ৭ দিনের ডিটক্স রুকইয়াহ করেছিলাম। আড়াই বছরে ওইবারই প্রথম হাজব্যান্ডকে ছেড়ে বাবার বাড়ি ১৫ দিন থাকলাম। সেইবার কী মনে করে তিনি ৩ টা জারবেরা ফুল নিয়ে এসেছিলেন আমাকে নিতে আসার সময়।
অনেক দৌড়ঝাঁপ করে বাবার বাড়ি থেকে নিজের বাসায় গেলাম অক্টোবরের ১৫ তারিখ। এর মধ্যে বাবার বাড়িতে এসেও অনেক মানুষের অনেক রকম কথা শুনতে হয়েছে বাচ্চা হয় না দেখে। বাসায় যেয়ে ১৮ তারিখ রাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম আমার ছেলেবাবু হয়েছে। স্বপ্নটা আমার কাছে অনেক বাস্তব মনে হচ্ছিলো। ১৯ তারিখ সন্ধ্যার পরে আমরা দুজন ছাদে হাটছিলাম আর নিজেদের হতাশার কথা বলছিলাম। ছাদের গাছগুলোকে বললাম, তোদের এত যত্ন করি, পানি দেই একটু দোয়া করতে পারিস না আমাদের যেনো আল্লাহ একটা বেবি দেন। তারপর আমার স্বপ্নটার কথাও তাকে বললাম।
ওইদিন ভোরবেলা আমি উঠে দেখি তিনি জায়নামাজে। আমি ওয়াশরুমে যাচ্ছিলাম দেখে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি, তুমি ইউরিন টেস্টটা করো। আমি বললাম, ধুর এই মাসে তো আমি সব মেডিসিন অফ রেখেছিলাম। তিনি বললেন, একটা স্ট্রিপ নষ্ট হোক, তুমি টেস্ট করো। তারপর আমি ওয়াশুরুমে যেয়ে স্ট্রিপে ইউরিন দেয়ার সাথে সাথে দুই দাগ চলে আসলো । আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কারন এর মধ্যে আমার দুইবার ব্লিডিং হয়েছে। আমি ভাবছিলাম পিরিয়ড হয়ে গেছে। বের হয়ে আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি ছলছল চোখে। উনি ভাবলেন নেগেটিভ। বললেন, যাও ফেলে দিয়ে আসো। আমি বললাম, আমার কাছে তো দুই দাগই লাগছে। উনিও বিশ্বাস করলেন না। শাশুড়ি মাকে দেখালেন। মা তো দেখেই এক লাফ দিলেন। বললেন তোদের নিষেধ করেছিলাম লং জার্নি করে বাড়ি যেতে। যাই হোক, এরপর ডাক্তারের সিরিয়াল নিলাম। ওইদিনটা আর কাটছিলো না। আমরা তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যতক্ষণ না ডাক্তার কনফার্ম করবে।
সন্ধ্যায় ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার স্ট্রিপে পজেটিভ শুনে শিউর করলেন আর বললেন স্ট্রিপে সাধারনত ভুল হয় না। ব্লিডিং হয়েছে শুনে বললেন, বেবি ইউটেরাসে আছে কিনা শিউর হওয়ার জন্য একটা আল্ট্রা করেন। আল্ট্রা করে দেখলাম আলহামদুলিল্লাহ সব ঠিক আছে। রিক্সায় আসতে আসতেই আম্মুকে জানালাম। বাসায় এসে ওই দিনগুলো স্বপ্ন মনে হচ্ছিলো। ডাক্তার রেস্টে থাকতে বললেন। আমি বেশির ভাগ সময় শুয়েই কাটাচ্ছিলাম।
এভাবে হাসি আনন্দে ২৬ দিন কেটে গেলো। একদিন সকালে এক সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গেলাম। বাসায় এসে ফ্লোরে বসে পাপস পরিষ্কার করলাম। তারপর দুপুরে ওয়াশরুমে যেয়ে ব্লাড দেখলাম। আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম। ডাক্তার ঝুঁকে নুয়ে কাজ করতে নিষেধ করেছিলেন আর ব্লিডিং হলে ইমিডিয়েট যেতে বলেছিলেন। আবার ডাক্তারের কাছে গেলাম, আল্ট্রা করালাম। আলহামদুলিল্লাহ, সব ঠিক আছে। এবার আমাকে ফুল বেড রেস্ট দিলো। বাসায় এসে আমি আর বিছানা থেকে উঠি না। শ্বশুরবাড়ির মানুষ ফুল বেড রেস্টের গুরুত্ব বুঝছিলো না। হাজব্যান্ডও মেনে নিতে পারছিলো না আমার শয্যাশায়ী অবস্থা।
এরমধ্যে আমার কাজিন এলো বাসায় আমাকে হেল্প করতে। ও ১৫ দিন ছিলো। ও চলে যাওয়ার ১ দিন পর আবার ব্লিডিং শুরু হলো। এবার এত ব্লিডিং হলো যে ফিনকি দিয়ে ব্লাড বের হচ্ছিলো। আর একটা ব্লাড ক্লটও গেলো। আমি অনেক ভয় পেয়ে গেলাম, ভাবছিলাম এই বুঝি সব শেষ। আবার ডাক্তারের কাছে গিয়ে আল্ট্রা করে জানতে পারলাম আমার লো লাইয়িং প্লাসেন্টা। এবার হাজব্যান্ড গুগল করে এটা সম্পর্কে ডিটেইলস জেনে ফুল বেড রেস্টে থাকার গুরুত্ব বুঝতে পারলো। আম্মু আসলো আমার বাসায় আমাকে দেখাশোনা করার জন্য। আমি সারাদিন বাম কাত হয়ে শুয়ে থাকতাম। ওয়াশরুমে যাওয়া ছাড়া আর খাবার খাওয়া ছাড়া শোয়া থেকে উঠিনি। খাবার ও বিছানায় এনে দিতো। আম্মু খাইয়ে দিতো। আমি ব্লিডিং হবার ভয়ে একপাশ থেকে আরেকপাশে ফিরতাম না। একপাশ ফিরে শুয়ে থাকতে থাকতে আমার হাত পা অবশের মত হয়ে যেতো। ১ মাস পর কিছু টেস্ট করে আবার ডাক্তারের কাছে গেলাম। সব রিপোর্ট আলহামদুলিল্লাহ ভালো ছিলো তবে তখনো প্লাসেন্টা লো লাইয়িং ছিল।
আম্মু ১ মাস থেকে বাড়ি চলে গেলো। এবার শুরু হলো আমার আর হাজব্যান্ডের টিকে থাকার যুদ্ধ। খাদেমার কাজ ছাড়া বাসার সবকাজ তিনি করতেন। রান্না পারতেন না। বেডরুমে চুলা এনে রান্না করতেন, আমি বলে দিতাম। এভাবে আরও একমাস কাটলো। ননদ এসে ৩/৪ দিন রান্না করে দিয়ে গিয়েছিল। এক বারে অনেক রান্না করে ১০/১২ দিন খেতাম। ১ মাস পর এনোমালি স্ক্যান করলাম। এ সময় এসেছিল ডান দিকে কিছুটা উপরে উঠেছে। ৬ মাসের সময় ও পুরোপুরি উপরে উঠেনি। এনোমালি স্ক্যানের পর ডাক্তার বললো ছেলে বেবি হবে। হাজব্যান্ড মেয়ে চাইছিলো তাই একটু অখুশি ছিলো। আমি আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট ছিলাম,আলহামদুলিল্লাহ।
তখন আমি একটু একটু উঠতে পারি। ৬ মাস থেকে ডাক্তার আমাকে ঘরে অল্প হাঁটাচলা করতে বলছিলো। রান্নাটা বসিয়ে দেই, উনি বাকিটা দেখেন। এভাবে আরও একমাস গেলো। এর মধ্যে এলো করোনার টেনশন। ৭ম মাসে আর ডাক্তার দেখাতে পারিনি করোনার জন্য।
৮ম মাসের শুরু দিকে করোনার ভয় নিয়েই ডাক্তার দেখালাম। বেবি মুভমেন্ট ২ দিন একটু কম ছিলো। তাই আল্ট্রা করলাম। ৮ মাসে প্লাসেন্টা পুরোপুরি উপরে উঠে গিয়েছিল। তবে এবার ফ্লুইড কমে গেলো। বাসায় এসে আবার শুরু হলো ফ্লুইড বাড়ানোর টেনশন। দিনে ৪/৫ লিটার পানি খেতাম আর সারাদিন ওয়াশরুমে যেতাম। এভাবে করে আরও ১ টা মাস গেল।
৯ মাসে পরলে আবার ডাক্তারের কাছে গেলাম। আল্ট্রা করে দেখলাম ফ্লুইড বেড়েছে কিন্তু ডাক্তার বললো প্লাসেন্টার এক্সটা একটা লোব বের হয়েছে। তাই সিজারিয়ান লাগবে। আমরা দুজনে অবশ্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম সিজারিয়ানের জন্য। এত জটিলতার পর নরমালের আশা বাদ দিয়েছিলাম।
ডাক্তার সিজারের ডেট দিয়ে দিলো জুনের ১৯ তারিখ। এরপর দিন গোণা শুরু হলো দুজনের। দোয়া করতে থাকলাম ডেটের আগে যেনো কোন জটিলতা না আসে। এরপর ১৯ তারিখ সকালে হসপিটালে ভর্তি হলাম। ওটি রুমে ঢুকে খুব ভয় লাগছিলো। করোনার জন্য মাস্ক পরে ওটিতে ঢুকেছি। সার্জিকাল মাস্কের উপরে অক্সিজেন মাস্ক দেয়ায় শ্বাস নিতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো এখনই শ্বাস আটকে মরে যাবো। মাথার কাছে কেউ ছিল না। একটু জোরে ডাকার পর একজন এসে সার্জিকাল মাস্ক খুলে অক্সিজেন মাস্কটা ঠিকভাবে লাগিয়ে দেয়ার পর শ্বাস কষ্ট দূর হলো। অপারেশনের সময় বমি পাচ্ছিলো খুব। আমি সারাক্ষন দোয়া ইউনুস পড়ছিলাম। পুরো প্রেগন্যান্সিতে যতক্ষণ আমার ধ্যান জ্ঞান ছিলো আমি দোয়া ইউনুসকে সর্বক্ষণের সাথী করে নিয়েছিলাম।
৯.৩০ এ আমার ছেলের জন্ম হলো। ছেলে প্রথমে একটা হেঁচকি দিলো, তারপর একটা হাঁচি দিলো এরপর চিৎকার দিলো, আলহামদুলিল্লাহ । আমি পুরোপুরি সেন্সে ছিলাম না মনে হয়। আধা সেন্সেই জিজ্ঞেস করলাম বাবুর ওয়েট কত? বললো ৩৬০০ গ্রাম। আমি আলহামদুলিল্লাহ বললাম। পোস্ট অপারেটিভে নিয়ে যাওয়ার সময় বাবুকে এক পলকের জন্য দেখলাম। আমি ঝাপসা চোখে বাবুকে দেখে একটা চুমো খেলাম। এ যে কেমন অনুভুতি, ভাষায় প্রকাশ করার মত না! আল্লাহ তা’আলা আমার মাতৃত্বকে পরিপূর্ণ করেছেন,আলহামদুলিল্লাহ।
এই পুরো জার্নিতে আমার হাজব্যান্ড আমাকে এতটাই যত্ন করেছেন যে, আমি সারাজীবন তার সেবা করলেও হয়তো এই ঋণ শোধ করতে পারবো না। আল্লাহ তা’আলাই তাকে এর উত্তম বিনিময় দান করুন। আমার শাশুড়িও অনেক আদর করেছেন। অনেক মানসিক সাপোর্ট দিয়েছেন,আলহামদুলিল্লাহ। আমার ডাক্তারেরও খুব অমায়িক ব্যবহার ছিলো। এত আস্তে ধীরে কথা বলেন যে উনার কাছে গেলেই আমি অনেক সুস্থ হয়ে যেতাম। আর একবার ভিজিট থেকে এসে পরবর্তী ভিজিটের অপেক্ষায় থাকতাম উনার সাথে দেখা হবে এই ভেবে। আমার জীবনে পাওয়া সেরা ডাক্তার উনি। উনি ড. উম্মে সালমা, ইবনে সিনা, লুবানায় বসেন।
বাবুর জন্মের পর জন্ডিস হয়ে ৩ দিন এনআইসিইউতে ছিলো। এজন্য ডেলিভারির পরে আরও এক পরীক্ষায় ছিলাম। এখন আলহামদুলিল্লাহ বাবু সুস্থ আছে। ও ব্রেস্টফিডিং করে না। ফর্মুলা দিতে হচ্ছে। সবাই আমার বেবির জন্য দোয়া করবেন। যতটা সহজে লিখে ফেললাম, প্রেগন্যান্সি যাত্রাটা ততটা সহজ ছিল না। অনেক কঠিন ছিল প্রতিটা দিন। একটা দিন পাড় করে সকালে উঠে আমি আলহামদুলিল্লাহ বলতাম, যে আরও একটা দিন পাড় করতে পেরেছি। প্রতিটা প্রেগন্যান্সি যাত্রা খুব সুন্দর আর আনন্দদায়ক হোক এই কামনা করি।
(লিখেছেন: উম্মে ইযান)
ছবি কৃতজ্ঞতা: ফ্রিপিক
You must be logged in to post a comment.