১.

বাবুর বয়স যখন দু বছরের কয়েক মাস বাকি, তখন থেকে ওকে পটি ট্রেনিং করানোর চেষ্টা করতে থাকি। নানাভাবে চেষ্টা করতাম, ডায়পার ছাড়া রেখে, ক্লথ ডায়পার পরিয়ে, কিছু সময় পর পর বাথরুমে নিয়ে। কিন্তু কোনভাবেই সুফল পাচ্ছিলাম না। কারন পটি ট্রেনিং তখনই কার্যকর হবে, যখন শিশু নির্দিষ্ট সময় পর পর প্রস্রাব করার সক্ষমতা অর্জন করবে।

আমার ছেলের ক্ষেত্রে এই বিষয়টাই হচ্ছিলো না। ও অল্প সময় পর পর একটু একটু করে প্রস্রাব করতো। কখনো বেশি, কখনো কম। এ কারনে পটি ট্রেনিং কিছুদিন চেষ্টা করার পর, প্রতিবারই আমি হাল ছেড়ে দিতাম, আর ভাবতাম হয়তো এখনো সময় হয় নি।

ওর বয়স যখন প্রায় দু’ বছর তখন একদিন খেয়াল করলাম, কিছু সময় পরপর ও জোর দিয়ে দিয়ে প্রস্রাব করছে। ব্যাপারটা দেখেই সন্দেহ হওয়াতে ডাক্তারের সাথে কথা বললাম। উনি ইউরিন ইনফেকশনের সম্ভাবনা এবং একটা সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে সুন্নতে খৎনার কথা বললেন। ছেলে বাচ্চাদের এটা খুব সাধারণ সমস্যা। তবে এবিষয়ে কোন অবহেলা উচিৎ নয় একদমই।

করোনার সময় বাবুকে নিয়ে হাসপাতাল/ ডাক্তারখানায় একাধিকবার যেতে ভয় লাগছিলো। তাই ইউরিন ইনফেকশন চেক না করিয়ে, সরাসরি আমাদের পরিচিত একজন প্রফেসরের লেজার ক্লিনিকে নিয়ে গেলাম। উনি চেক করে বললেন, বাবুর প্রস্রাবের রাস্তা অত্যন্ত সরু হয়ে গিয়েছে, যে কারনে ওকে প্রেশার দিয়ে দিয়ে প্রস্রাব করতে হচ্ছে। এখনই সারকামসিশন (খৎনা) করতে হবে, তা না হলে প্রস্রাব ঠিক মতো বের হতে পারবে না, প্রেশার দেয়ার ফলে সেটা ধাক্কা খেয়ে পেছনে চলে যাবে ও কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে।

মানসিক ভাবে প্রিপারেশন নিয়ে গিয়েছিলাম। মাগরিবের সলাতের পর বাবুকে অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) নেয়া হলো। ডাক্তার বললেন, World Health Org থেকে রিসেন্টলি জনানো হয়েছে, বাচ্চাদের সারকামসিশনের সময় জেনারেল এনেস্থেশিয়ার পরিবর্তে লোকাল এনেস্থেশিয়া দিতে। জেনারেল এনেস্থেশিয়ার চেয়ে অবশ্যই লোকাল ভালো। কিন্তু দু বছরের চঞ্চল কোন শিশুকে কেমন করে অচেতন না করে ওটিতে কাজ সারা হবে, তা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না।

যেহেতু মাইনর সার্জারি, আর ছোট বাচ্চা, তাই বাচ্চাকে মা সহ অর্থাৎ আমাকে সহ ওটিতে নিয়ে যাওয়া হলো। বেডে বাবুকে শুইয়ে লোকাল একটা চেতনানাশক ইঞ্জেকশন দিলো। তার কিছুক্ষণ আগে একটা চেতনা নাশক মলম লাগিয়ে নেয়া হয়েছিলো, যেনো ইঞ্জেকশনে ব্যাথা না পায়।

আমাকে বলা হলো পুরোটা সময় মোবাইলে কার্টুন দেখিয়ে বাচ্চাকে অন্যমনষ্ক করে রাখতে। ডাক্তার ছাড়াও বাবুকে ধরে রাখার জন্য আরো কয়েকজন ছিলো। কিন্তু অচেনা মানুষ দেখে আব্দুল্লাহ এতই ভয় পেয়ে যায় যে, কোন নড়চড়া করার চেষ্টাই করে নি। কার্টুন দেখেছে আর চোখ দিয়ে পানি ফেলেছে পুরোটা সময়। আলহামদুলিল্লাহ্‌ রুমের সবাই বাবুকে অনেক আদর করছিলো, কেউ চোখের পানি টিস্যু দিয়ে মুছে দিচ্ছিলো, আবার কেউ আদর করে কথা বলছিলো।

প্রায় আধা ঘণ্টা পর আমরা বের হই। লেজার সার্জারি হওয়াতে স্টিচ ছিলো মাত্র তিন টি। ইউরিন ঠিকমতো বের হতে পারছিলো না বলে ময়লা জমে স্কিনের ভেতরে অনেক ইনফেকশন হয়ে যাওয়ায়, ১২ দিনের এন্টিবায়োটিক দিয়েছিলো।

২.

এবার আসি পটি ট্রেনিং প্রসঙ্গে-

খৎরা হলে ডায়পার যে একেবারেই পরানো যাবেনা, তা নয়। তবে যেকোন কাটাছেড়া যতটা খোলা রাখা যায় তত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। আমরা বাবুকে রাতের বেলা আলতো করে ডায়পার পরিয়ে রাখতাম, যেনো বিছানা ভিজে ঠান্ডা লেগে না যায়। সারাদিন খোলা রাখতাম। প্রথম দিন আব্দুল্লাহ ভয়ে নড়াচড়া করেনি, পরদিন থেকে দৌড়াদোড়ি, লাফালাফি সব শুরু করে দিয়েছে।

কোন রক্তপাত অথবা অপারেশন পরবর্তী ইনফেকশন হয়নি আলহামদুলিল্লাহ্‌। এরই মাঝে একটা মজার জিনিস আবিষ্কার করলাম, ওর প্রস্রাব করায় একটা প্যাটার্ন এসে গেছে। একটু পর পর করছে না। নির্দিষ্ট সময় পর পর প্রস্রাব করতে বললে করছে, আমার নির্দেশনা বুঝতে পারছে।

যেহেতু তখন সার্জারির জন্য এমনিতেই দিনের বেলা ডায়পার পরাচ্ছিলাম না, তাই ভাবলাম এই সুযোগেই পটি ট্রেনিং করাই না কেন! বাথরুমের কমোডের ওপর বাচ্চাদের সিট কভার নিয়ে সেখানে বসাতে লাগলাম, হ্যান্ড শাওয়ার নিয়ে খেলতে দিতাম, বাথরুম করতে পারলে, অনেক অনেক উৎসাহ দিতাম। এই বয়সী বাচ্চারা উৎসাহ খুব পছন্দ করে। ওকে বলতাম বাথরুম লাগলে যেনো আমাকে বলে, কিছুক্ষন পর পর জিজ্ঞেস করতাম বাথরুম যাবে, কিনা। এভাবে কয়েকদিনের ভেতর ও রেসপন্স করা শুরু করে।

তাছাড়া বাথরুম লাগলে ও হঠাত নড়াচড়া বন্ধ করে দেয়, তখন দৌড় দিয়ে কমোডে বসিয়ে দিতাম। দুই তিন দিন এমন করার পর, কাছাকাছি দুরত্বে যেমন বাসার নিচে প্লে গ্রাউন্ডে, দশ মিনিট দূরত্বের দাদার বাসায় ডায়পার ছাড়া নিয়ে যেতাম আর সব সময় বোঝাতাম কাপড়ে বাথরুম করে দেয়া খুব ময়লা একটা বিষয়। বড় বেবিরা এরকম করে না।

আলহামদুলিল্লাহ্‌, এরপর থেকে সে বাথরুমে যেতে হলে, পিসু করবো বলা শুরু করলো। খেলার নেশায় থাকলে, বা আমরা অনেক্ষণ খেয়াল না করলে এখনো কদাচিৎ দূর্ঘটনা হয়। তবে সারাদিন আর ডায়পার পরাতে হয় না। দিনের বেলা ঘুম থেকে উঠলে, সাথে সাথে বাথরুম নিয়ে যাই। শুধু রাতের বেলা এখনো ডায়পার পরাই।

আল্লাহ্‌ এর রহমতে খৎনা করানোর সপ্তাহ খানেকের মাঝে ওকে ডায়পার ছাড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়। যাদের ছেলে বাচ্চা আছে, কিন্তু পটি ট্রেনিংয়ে সমস্যায় পড়েছেন, তারা একবার ডাক্তারকে দেখিয়ে নিতে পারেন, খৎনা করানোর দরকার আছে কিনা জানার জন্য। আর বাচ্চার মাঝে কোন অস্বাভাবিকতা আছে কি না তা মায়েরা সাধারণত বুঝতে পারেন। তাই কখনো যদি দেখেন বারবার প্রস্রাব করছে বা প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেছে, প্রস্রাবের সময় কষ্টের কোন শব্দ করছে, তখন একেবারেই দেরি না করে শিশুকে ডাক্তারের এর কাছে নিয়ে যাবেন। হতে পারে আব্দুল্লাহ র মতো আপনার বাচ্চাও সারকামসিশনের পর সহজেই পটি ট্রেইন্ড হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ্‌।

লিখেছেন- বিনতে হক
সম্পাদনা- মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন