“আমার চারপাশে তো কারো এমন হয়নি।
যার হয় নাই তারা কেউই তো আমার কষ্ট বুঝবে না।”  

এই কথাগুলো বলছিল আমার এক ক্লায়েন্ট, যার কিছুদিন হল মিসক্যারেজ হয়েছে। এবং সেটা একবার নয় পরপর তিনবার। শেষ বার সি-সেকশন  করলে যেভাবে পেট কাটতে হয় সেভাবে কাটা হয়েছে। 

বাচ্চাকে দেখাশোনা করার কত কত মানসিক প্রস্তুতি সব কেমন জমাট রক্তের মত চিন্তায় আটকে আছে তার। উঠতে বসতে চলতে ফিরতে সব মনে পড়ে যায়। কারো বাচ্চা হয়েছে, কারো বাচ্চা দেখলে হাহাকার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নিজেকে হিংসুক মনে হয়। মনে হয় আমি তো এমন ছিলাম না, অন্যের ভালো দেখে আমার এমন লাগছে কেন? হাজারো কেন তে আটকে আছে সময়। 

মিসক্যারেজের পর মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন

আমার আরেক ক্লায়েট দুদিন আগে মেসেজ দিল সে প্রেগন্যান্ট। লকডাউন এর আগ দিয়েও তার সে কী আশাহত অবস্থা কারণ তার মিসক্যারেজ হয়েছে। বলছে বারবার, আপু যা হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ কিন্তু সন্তান নিয়ে প্রত্যাশা, পরিকল্পনার আলাপগুলো বলে দিচ্ছে শূন্যতায় আচ্ছন্ন মেয়েটি। মুখের শুকনো হাসি আর শুকনো হৃদয়ে জোর করে বসিয়ে দেওয়া ইতিবাচক ভাবনাগুলো সেখানে শুধুমাত্র প্রলেপ। এই দাওয়া ধনুন্তরী তবে সময় লাগে ঠিক হতে। 

আমার খুব কাছের একজনের বোন IVM Treatment করাচ্ছিলেন ইন্ডিয়াতে। বছরের উপর সময় সেখানে আছেন। দ্বিতীয়বার মিসক্যারেজ হল আর এবার টুইন বেবি ছিল। বিয়ের দশ বছর পার হয়ে গেছে। অপেক্ষা নামক ফলটা শুধু তিতা বললে ভুল হবে তার থেকেও বেশি কিছু। শুনেই আমি নিজের পেটে হাত বোলালাম শরীরের মধ্যে অল্পকিছু ওজনের প্রাণশূন্য পেটটা এখন তাকে কী অনুভূতি দিচ্ছে? কতটুকু আশা হলে ভরবে অন্তরের শূন্যতা?  

রোজ এসব বিষয়ে কাউন্সেলিং করতে করতে একদিন জানলাম আমার বোনের মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। কন্সিভ করেছিল, কাউকে আগেই জানায়নি। দু’মাসের কিছু কম সময়ের মধ্যে যা হওয়ার হয়ে গেল। তারপরেও কয়েকটা মাস পেরিয়ে গেছে সে আমাদের জানতেই দেয়নি। 

ওপরের মানুষ গুলোর কথা ভেবে বোনের জন্য কষ্ট কম হচ্ছে। কারণ বোনের একটা বাচ্চা আছে এবং ও নিজেকে মানসিক ভাবে সামলে নিয়েছে। 

মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো মানুষের আচার-আচরণ প্রকৃতি পরিস্থিতি অনুসারে ভিন্ন এবং একই ঘটনায় প্রভাবটাও মানুষ ভেদে ভিন্ন হয়। 

এসবকিছুর পরেও পেটের মধ্যে জানান দেওয়া প্রানের স্পন্দনটা যখন হঠাৎ করে এসে হঠাৎ করে থেমে যায় তখন অন্তর থেকে স্বস্তি চলে যায়, যুক্তিযুক্ত ভাবনা চিন্তা চলে যায়, মাতৃত্বের হাহাকার হৃদয়ে প্রতিধ্বনি করে। 

নিজের সাথে এমন হলে কী করবেন? 

১. মেনে নেয়াঃ আল্লাহর ফয়সালাকে মেনে নিবেন,   বিপদকে আল্লাহ হেসে হেসে মেনে নিতে বলেননি, সবরের সাথে মেনে নিতে বলেছে। আল্লাহ আপনাকে পরীক্ষা দুয়েছেন এটা মেনে নিন, কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে তেমনি এই কঠিন পরীক্ষায় অংশগ্রহনে যিনি আপনাকে মনোনীত করেছেন তার পক্ষ হতেই আছে পুরস্কার। ঐযে সবরটাকে ধরতে হবে। 

২. আপনি একা ননঃ এই পরীক্ষা শুধুমাত্র আপনার একার নয়, আপনিই একমাত্র মানুষ নন যিনি এই কষ্ট ভোগ করছেন। এই পৃথিবীতে কেউ সন্তান পেয়ে কষ্টে আছে, কেউ না পেয়ে কষ্টে আছে, কেউ পেয়ে হারানোর কষ্টে আছে। 

৩. সম্ভাবনার শেষ নয়ঃ মিসক্যারেজ মানেই সম্ভাবনার শেষ নয়। বয়সের ভারে জীর্ণ জাকারিয়া আঃ দোয়া করছেন ইয়া আল্লাহ কখনো আপনাকে ডেকে নিরাশ হইনি। কী চমৎকার, কী দৃঢ় তার বিশ্বাস। কথাটার মধ্যে সবকিছু পাওয়ার পরে যে শুকরিয়া তার ইঙ্গিত আছে। তিনি পাননি কিন্তু তিনি জানেন তার রব তাকে যা দরকার সব দেয়, সুতরাং তিনি বিশ্বাস করে নিয়েছেন তাকে সন্তান দেওয়া হবে অতঃপর তিনি দোয়া করছেন “আপনাকে ডেকে কখনো নিরাশ হইনি।” অতএব বুক ভরা কষ্টের মাঝে এই অনুপ্রেরণা থেকে আশার বীজ বপন করুন। 

এই যে কষ্ট চারপাশে তো কারো এমন হচ্ছে না, এটার মানে অন্য কেউ নয়, চারপাশের কেউ নয় আমি নিজেকে নিজে সব থেকে দুঃখী ভাবছি, কিন্তু বিষয়টা যদি এভাবে ভাবি, অন্যদের জীবনেও পরীক্ষা আছে কিন্তু আমি যে কষ্টটা পাচ্ছি সেটা আমি বুঝছি আর আমার রব বুঝছেন। আসলে আমরা তাদেরকে কষ্টের মূল্যায়ণ করতে দেই যাদেরকে রব্বুল আলামীন যথোপযুক্ত ভাবে কারো কষ্ট, দুঃখ, পেরেশানি বোঝার তাওফিকই দেননি। কারণ এ যোগ্যতা একমাত্র আল্লাহর। 

মিসক্যারেজের পর মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন, সিজনাল ডিপ্রেশনে পড়েছেন, কোন ভাবেই নিজেকে সামলাতে পারছেন না। একবার ভাবুন মৃত সন্তানের মুখ দেখে মা কষ্ট পায় না, স্বাভাবিক জীবনযাপন করে, হেসে খেলে বেড়ায়, আপনার অনুভূতিগুলো এমন হলে কেমন হত। কষ্টকর অনুভূতিগুলো নিয়ামত। মায়ের মমতা, মাতৃত্বানুভুতির মধ্যে যে কান্না, কষ্ট, মন খারাপ নামক উপাদান গুলো আছে সেগুলো দিয়ে আল্লাহ নারীদের সম্মানিত করেছেন, মর্যাদা দিয়েছেন। তাই সন্তান হারানোর কষ্ট মা থেকে আর কেউ বেশি অনুভব করে না। সবাই দুদিনে ভুলে যায় কিন্তু একজন মা ভুলে যান না। 

মিসক্যারেজ হওয়া, বন্ধ্যা হওয়া, প্রেগন্যান্সিতে অন্য কোন সমস্যা হওয়া এগুলো অযোগ্যতা নয়, আপনার ভুল নয়, এগুলো আল্লাহ প্রদত্ত পরীক্ষা যা তিনি আপনার রিজিকে নির্ধারিত করেছেন। 

মিসক্যারেজের পরের সময়গুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন কনকনে শীতের আমাবস্যার রাতের মত। আপনি মনে রাখবেন আল্লাহ চিন্তাশীল মানুষকে পছন্দ করেন। যে আল্লাহর শান, প্রজ্ঞা, হিকমা নিয়ে ভাবে, নিয়ামত অনুসন্ধান করে তাকে আল্লাহ ভালবাসেন, অনুগ্রহ করেন। তাই ভেবে দেখুন এটা আপনার জীবন নয়, জীবনের একটা অধ্যায় মাত্র। এ অধ্যায়ে আপনি মাতৃত্বহীনা পরের অধ্যায়ে কিংবা তার পরের অধ্যায়ে আপনার শূণ্য কোল ভরে গেছে। 

বিপদ আপদ কষ্ট কমায় সাদাকাহ। তাই সাদাকাহ করুন বেশি বেশি। বিনে পয়সায় সাদাকাহ করুন। চারপাশে চোখ রাখলে অগনিত পাবেন যে অসুস্থ, প্রতিবন্ধী, বিকলাঙ্গ সন্তান নিয়ে যুদ্ধ করে চলেছে, কারো সন্তান অনেক বখে গেছে, কারো এমন কোন বড় অসুস্থতা আছে যে কন্সিভ করলেই লাইফ রিস্ক, এরকম হাজারো পরীক্ষায় আছে অসংখ্য মানুষ। Just listen to them, hug them. নিজের কষ্ট কমানোর সহজ সূত্র হচ্ছে অন্যের কষ্টে ব্যাথিত হওয়া। 

৪. দোয়া কবুলের গল্পঃ নিজের জীবনের ছোট থেকে ছোট দোয়া কবুলের মুহুর্তগুলোকে মনে করুন। 

৫. ইস্তেগফারঃ সন্তান আপনার জন্য রিজিক। অধিক পরিমানে ইস্তেগফার পড়লে রিজিক বৃদ্ধি পায়। মনে রাখবেন আল্লাহ যা জানেন আপনি তা জানেন না। 

আপনি ঠিকই ভেবেছেন আল্লাহ আপনাকে একটু নয়, অনেক দামী কষ্ট দিয়েছেন আর এই অনেক দামের কষ্টের প্রতিদানটাও দামী হবে। এটাই আল্লাহর দয়া, মহানুভবতা। আপনি আশা রাখুন। দেনা পাওনার হিসাবটা আপনার রবের সাথে, নিজের সাথে কিংবা অন্য কারো সাথে তুলনা করে নয়।

লেখক: মেন্টাল হেলথ প্রফেশনাল। ফ্যামিলি, ম্যারেজ এন্ড রিলেশনশিপ কাউন্সিলর। দ্যা নাফস সাইকোলজিকাল এন্ড স্পিরিচুয়াল ওয়েলনেস সেন্টার।
ছবি কৃতজ্ঞতা: freepik.com

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা