মাতৃত্ব যতটাই কঠিন হোক না কেনো, মায়েরা অদ্ভুত এক ইমোশনাল টানাপোড়েনের মুখোমুখি হন বাচ্চাদের বুকের দুধ ছাড়ানোর সময়। বাচ্চা খুব জেদ করতে থাকে, রাতে প্রচন্ড চিৎকার করে যারা ঘুমের মাঝে ব্রেস্টফিডিং করতে অভ্যস্ত। বাড়ির ঘুমন্ত মানুষ বেশ বিরক্ত হয় স্বাভাবিকভাবেই। মুরব্বিরা বয়সের কারনেই অনেকটা নরম মনের হয়ে যান। তারা আশেপাশে থাকলে বিড়ম্বনা তাই মায়ের জন্য কিছুটা বেড়ে যায়। ‘খাক তো আরো কিছুদিন, তুমি দাও।’ তাদের এরকম অনুরোধ, আবদার তখন পালন করা ছাড়া উপায় থাকে না। মায়ের নিজেরো খুব গিলটি ফিলিং কাজ করতে থাকে। মনে হতে থাকে, তার বাচ্চাটা কষ্ট পাচ্ছে। আমি অনেক মা’দের চিনি তারা এই weaning এপিসোডে খুব কান্নাকাটি করেছে। বেশী বুঝা মানুষও আছে কিছু চারপাশে যারা বলে বেড়াবে, দুই বছরের একটা দিনও বেশী ব্রেস্ট ফিডিং করানো হারাম! কি এক সংকট।
ইউসুফ আর খাদিজার বেলায় আমি একই পদ্ধতি ব্যবহার করেছি এই সময়কালে। ইউসুফকে দুই বছর হবার ৪ মাস আগেই ব্রেস্ট ফিডিং ছাড়াতে হয়েছে কারন তখন খাদিজার জন্মের সময় হয়ে গিয়েছিলো। খাদিজার জন্মের প্রায় এক মাস আগে ইউসুফের ব্রেস্ট ফিডিং weaning করানো হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, অনেকের এরকম অল্প গ্যাপের বাচ্চা থাকলে তারা বড় এবং ছোট দুই বাচ্চাকেই ব্রেস্ট ফিডিং করান, যেটা খুব প্রশংসনীয়; বড় বাচ্চাকে দুই বছর হবার পর ছাড়িয়ে দেন। আমার নিজের কাছে এটা খুব ঝামেলা মনে হওয়ায় আমি খাদিজার জন্মের আগেই ইউসুফের weaning process শুরু করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল দ্বিতীয় সিজারের পর দুজনকে ফিড করানো আমার জন্য হেলথ হ্যাযার্ড হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আমার দুই বাচ্চা দু’রকম হলেও একজনকেও শান্ত শিষ্ট বলা চলে না। দুজনেরই ভীষণ রকমের ত্যারাব্যাঁকা মার্কা জেদ। আমি নিজেও মা হিসেবে বেশ কড়া। আমি খুব ডিটারমাইন্ড ছিলাম এই weaning নিয়ে খুব একটা হাউকাউ হতে দিবো না। তাদের জেদের কথা উল্লেখ করছি এই কারনে যে, এক এক বাচ্চা এক এক রকম। এবং আমার দুই বাচ্চাই খুব ডিফিকাল্ট বাচ্চা ছিলো, কতটা সেটা এর আগে বর্ননা করেছি বেশ কিছু লেখায়। এবং সিস্টেমেটিক ভাবে যেহুতু তাদের ব্রেস্ট ফিডিং ছাড়ানো গেছে, তাই আমি অনেকটা জোর দিয়েই বলতে পারি যে এই এপিসোডটা ইমোশনাল হতে হবেইই এমন কোন কথা নেই।
আমার দু বাচ্চার বেলাতেই তাদের এক বছর পার হবার পর ব্রেস্ট ফিডিং ফ্রিকোয়েন্সী কমিয়ে দিয়েছি। বাচ্চার সাথে রিপিটেডলি একই কথা বললে ইট মেকস সেন্স টু দেম। একটা এক বছরের বাচ্চা সিম্পল ইন্সট্রাকশন বুঝে, যেমন তাকে মা কিছু মানা করছে, বাবা কিছুতে উৎসাহিত করছে, তার দাদা কিছু চাচ্ছে, কাউকে টাটা দেয়া মানে সে ব্যাক্তি চলে যাচ্ছে এরকম বেসিক প্যাটার্নের হিউম্যান সারভাইভাল আর সোশ্যাল কমিউনিকেশন স্কিলস। আমি বার বার ইউসুফ আর খাদিজাকে বুঝাতাম যে এখন না, নির্দিষ্ট সময়ে তারা ফিড করতে পারবে। ঘুমানোর সময় বা খাবার খাওয়ার পরে। শুরুতে খানিকটা জেদ করলেও মা যে তার সিদ্ধান্তে অনড় সেটা তাদের বোধগম্য হতে বেশী সময় লাগে নি। কান্না করলে এটা ওটা দিয়ে ডিস্ট্র্যাক্ট করেও কয়েকবার ভোলানো যায়। আর সেই প্রাথমিক কয়েকবারের সাফল্যের পরেই ইনশাআল্লাহ জেদের পরিমাপে ভাটা পড়ে যাবে।
এক বছরে ফিডিং এক দফা কমানোর পর দেড় বছর বয়সের আরেকটু আগে আরেক দফা কমিয়ে ফেলেছিলাম। তিন বার থেকে দুই বারে এনেছিলাম। এরপর ছাড়ানোর সময় খুব বেশী বেগ পেতে হয় নি আলহামদুলিল্লাহ। ‘তুমি মাশা’আল্লাহ এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছো!, আজকে ফিডিং না করে বরঞ্চ আমরা গল্প শুনে ঘুমাতে যাই?, ‘তোমার এখন দাঁত হয়ে গেছে অনেকগুলা, তুমি বড়দের মতন খাবার খাবে এখন থেকে ইনশাআল্লাহ!’ এসব গঠনমূলক উৎসাহ টেম্পোরারিলি কাজে দেয়। টেম্পোরারি বললাম কারন এই বয়সী বাচ্চারা বেশীক্ষন কিছু মনে রাখতে পারে না। তাই বার বার বলতে হয় বেশ ধৈর্যের সাথে। একটা কথা ইম্পর্ট্যান্ট এখানে যে, বাচ্চারা যখন বুঝে ফেলে কান্নাকাটি করে তাদের চাহিদা মাফিক জিনিস পাওয়া যাচ্ছে, তারা অবশ্যই সেটার এডভান্টেজ নিবে। তাই নিজেকে প্রস্তুত করে মাঠে নামা বুদ্ধিমানের কাজ। মনে রাখতে হবে, বাচ্চাটা নতুন ধরনের চেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এবং এখন সে কাঁদলেও সেটা এক পর্যায়ে থেমে যাবে। এটাই নিয়ম। জীবনের প্রতিটি চেঞ্জেই যথাযথ এডযাস্টমেন্টের জন্য সময় প্রয়োজন, ব্রেস্ট ফিডিং wean করার ব্যাপারটা তার ব্যাতিক্রম না।
খাদিজা আর ইউসুফ দুজনের ক্ষেত্রেই একই টেকনিক ব্যাবহার করে সুফল পেয়েছি। একবারে বন্ধ না করে, ক্রমান্বয়ে দু তিন দফার কমিয়ে আনলে বাচ্চা এবং মা দুজনেরই মানসিক এবং শারীরিক প্রভাবটা drastic হয় না। এক্ষেত্রে একটা জিনিস মেইন্টেন করাটা একটু জরুরী, সেটা হলো ঘুমের মাঝে ফিডিং বন্ধ করা এক বছর হবার পরেই। অনেকের ধারনা বাচ্চা ক্ষুধার কারনে রাতে বার বার খেতে চায়, কিন্তু আসলে এটা অনেকটাই ‘comfort feeding’। ইউসুফ খাদিজাকে সাবস্টিটিউট হিসেবে আমি পানি দিতাম রাতে, যাতে পিপাসা মেটে। প্রথম প্রথম প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু যখন বুঝেছে যে রাতে বার বার জাগলে পানিই পাবে, আর কিছু না, তখন আকস্মিক ভাবে ঘন ঘন উঠা কমে গেছে। এটাও অনেক বড় একটা রিলিফ। আমি বাচ্চা আর আমার মাঝে বালিশ রাখতাম যাতে রাতে গা ঘেঁষে না থাকে। বাচ্চারা মায়ের গন্ধ খুব চেনে, পাশ ছাড়া হলে কান্নাকাটি করে অনেকে, আবার বার বার ঘুমের মাঝে ফিডিং করতে চায় তাই এই প্রোএক্টিভ ব্যাবস্থা।
ব্রেস্ট ফিডিং যেমন খুব ন্যাচারাল একটা বিষয়, আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামাহ, ঠিক তেমনি ছাড়ানোর ব্যাপারটাও ন্যাচারাল হওয়াটা শ্রেয়। ইমোশনালি ভালনারেবল হওয়ার মতন সিচুয়েশন যথাসম্ভব এড়ানো যায় ততই দুই পক্ষের জন্য ভালো। আমি বাচ্চাদের দেড় বছর হবার পর থেকে বাইরের দুধে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করেছি অল্প অল্প করে। কৌটার দুধে আমার একেবারেই ফেইথ নেই দেখে সেটা ধার্তব্যে আনি নি।
আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করি যে বাচ্চাদের মোটামুটি এক হাতেই বড় করতে হয়। বড় ছোট সিদ্ধান্তগুলো মা’কে একলাই নিতে হয়। মায়েরা সন্তানের ক্ষেত্রে আবেগী হবে এটা খুবই নরমাল, তবে বাচ্চাদের একেবারে ছোট বয়স থেকে মা’দের আবেগের বহিঃপ্রকাশ যদি পরিমিত থাকে তবে আমার এক্সপিরিয়েন্স বলে যে বাচ্চা নিজেও তাহলে নিজস্ব ইমোশনগুলি গুছিয়ে উপস্থাপন করতে পারে, খাপছাড়া ভাবে হুলুস্থুল অবস্থার সৃষ্টি করে না সাধারণত। সন্তানের যে কোন বড় ছোট সিদ্ধান্ত নেবার আগে খুব করে দুয়া করা উচিত, যেন রাস্তাটা সহজ হয়ে যায় এবং তাতে সর্বপোরী ভালো নিহিত থাকে।
[লিখেছেনঃ উম্ম ইউসুফ]