দুজন নারী পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার পর থেকেই সন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। তবে জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিক বিবেচনায় কখনো কখনো সন্তানধারণে বিলম্ব করার প্রয়োজন দেখা দেয়। সুনির্দিষ্ট যৌক্তিক কারণ থাকলে ইসলামেও এটি অনুমোদিত।
গর্ভধারণের প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিভিন্ন পদ্ধতির উল্লেখ আছে। দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদী, এককালীন ও নিয়মিত – বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। ধর্মীয় নিয়ম মেনে এগুলোর যে কোনটি ব্যাবহার করে গর্ভধারণে দেরী করা যায়। তবে অনেক দম্পতি আছেন, এগুলোর কোনটিতেই স্বস্তি বোধ করেন না, তারা আরও প্রাকৃতিক কিছুর খোঁজ করেন। এক্ষেত্রে নারীর মাসিক ঋতুচক্রের সেইফ পিরিয়ড বা নিরাপদ দিনগুলো খুঁজে বের করতে পারলে, এটা তাদের জন্য বেশ সহায়ক পদ্ধতি হতে পারে।
সেফ পিরিয়ড ( Safe Period) বা নিরাপদ দিন কী?
একজন নারীর দেহকে সন্তান প্রজননের উপযুক্ত করে তোলার জন্য যেসব অঙ্গ ও প্রক্রিয়া রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নারীর মাসিক ঋতুস্রাব (Menstruation)। ঋতুস্রাবের সাথে সম্পর্কিত হচ্ছে ডিম্বস্ফোটন বা অভুলেশন (Ovulation) । নারীর অভুলেশনের পর ডিম্বাণুর সাথে পুরুষের শুক্রাণু মিলিত হয়ে জরায়ুতে নিষিক্ত হয় এবং গর্ভধারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই যে ডিম্বস্ফোটনের প্রক্রিয়া, এটি কিন্তু নারীর শরীরে প্রতিদিন ঘটে না। বরং চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুসারে, মাসের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে এই ডিম্বস্ফটন ঘটে এবং ওই সময়ে ডিম্বাণুর সাথে স্পার্ম/শুক্রাণু মিলিত হলে তখনই কেবল গর্ভধারণ ঘটে। অভুলেশনের সময় ছাড়া বাকি সময় শারীরিক সম্পর্কের ফলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা খুব সামান্য।
তার মানে, নারীর অভুলেশনের সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সময় অরক্ষিত শারীরিক সম্পর্কের জন্য নিরাপদ। এ সময় কোনোরকম জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যাবহার না করেও শারীরিক সম্পর্ক করা যায় এবং এতে গর্ভধারণের সম্ভাবনা থাকে না বললেই চলে। এক্ষেত্রে গর্ভধারণের সম্ভাবনামুক্ত যে সময়টি পাওয়া যাচ্ছে শারীরিক সম্পর্ক করার জন্য, এটিকেই বলা হয় “ সেফ পিরিয়ড” যাকে প্রাকৃতিক পরিবার পরিকল্পনা/ ন্যাচারাল বার্থকন্ট্রোল / রিদম মেথডও বলা হয়।
সেফ পিরিয়ড গণনার পদ্ধতি
প্রতি মাসের নিরাপদ দিনগুলি খুঁজে বের করার জন্য বেশ কিছু পদ্ধতি প্রচলিত আছে। এখানে সেগুলো উল্লেখ করা হলো-
১। ক্যালেন্ডার পদ্ধতি (Calendar Method)
আগেই বলা হয়ছে, সেফ পিরিয়ড বের করতে হলে ঋতুচক্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঋতুচক্র এবং অভুলেশন একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আপনি যদি সেফ পিরিয়ড নির্ণয়ে ক্যালেন্ডার পদ্ধতির সুফল ভোগ করতে চান, তাহলে প্রথমেই আপনাকে কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে হবে। যেমন, আপনার মাসিক ঋতুস্রাবের চক্রটি খুবই নিয়মিত হতে হবে। অর্থাৎ এক মাসিক থেকে আরেক মাসিকের দূরত্ব, মাসিক চলার সময়কাল ইত্যাদি নিয়মিত হতে হবে। এটি বুঝার জন্য বিগত ৬ মাসের মাসিকের হিসাবটি খেয়াল রাখতে হবে। হিসাবের সুবিধার্থে ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে রাখতে পারেন।
যাদের ঋতুচক্র একদম নিয়মিত অথবা যাদের শেষ ৬ মাসের ঋতুচক্রের গড় দৈর্ঘ্য ২৬ থেকে ৩২ দিনের মধ্যে এবং সর্বনিম্ন ও দীর্ঘতম ঋতু চক্রের মধ্যে পার্থক্য ৭ দিন বা তার কম সময়ের, তারাই নিরাপদে এ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারবেন। সবচেয়ে কম যত দিন পর মাসিক হয়, তা থেকে ১৮ দিন বাদ দিতে হবে। পিরিয়ড শুরুর প্রথম দিন থেকে এ দিনটিই হলো প্রথম অনিরাপদ দিন। আবার সবচেয়ে বেশি যতদিন পর পিরিয়ড হয়, তা থেকে ১১ দিন বাদ দিলে মাসিক শুরুর প্রথম দিন থেকে এ দিনটিই হলো শেষ অনিরাপদ দিন।
ধরুন আপনার পিরিয়ড ২৬ থেকে ৩০ দিন অন্তর হয়। তবে ২৬-১৮=৮, অর্থাৎ পিরিয়ড শুরুর পর থেকে প্রায় ৮ দিন আপনার জন্য নিরাপদ, মাসিক ভালো হওয়ার পর এ দিনগুলোতে কোনও পদ্ধতি ব্যবহার না করেও সহবাস অনায়াসেই করা সম্ভব। ৯ম দিন থেকে অনিরাপদ দিন শুরু। তাই এ দিন থেকে সহবাসে সংযত হতে হবে। ৩০ দিন হল দীর্ঘতম মাসিকচক্র। তাই ৩০-১১=১৯, অর্থাৎ ১৯তম দিনটিই হল শেষ অনিরাপদ দিন। ২০তম দিন থেকে আবার অবাধে সহবাস করা যেতে পারে। এতে গর্ভধারণের সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ প্রতি মাসিকের শুরু থেকে প্রথম ৮ দিন ( মাসিক চলাকালীন সহবাস নিষেধ) এবং পরের মাসিক শুরুর আগের ১১ দিন আপনার জন্য নিরাপদ। অন্যদিকে ৯ম থেকে ১৯তম দিনের মধ্যে অবাধ সহবাসের ফলে গর্ভধারণ হতে পারে।
২। শরীরের তাপমাত্রা পদ্ধতি
ওভ্যুলেশনের সময় শারীরিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। কয়েক মাস প্রতিদিন তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এটি বুঝা যায়। মাসিক শুরুর প্রথম দিন থেকে প্রতিদিন একই সময়ে তাপমাত্রা মাপতে হবে। ঘুম থেকে উঠবার পরই মাপাটা ভাল। অভুলেশনের আগে শরীরের তাপমাত্রা সাধারণত ৯৭ থেকে ৯৭.৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট থাকে। অভুলেশনের পর প্রজেসটেরণ হরমোনের কারনে তাপমাত্রা ০.৫ ডিগ্রী বেড়ে যায়। সাধারণত ডিম্ব স্ফুরণের ১-২ দিন পর তাপমাত্রার এই পরিবর্তন ধরা পড়ে। সাবধানতার জন্য তাপমাত্রা বাড়ার পরবর্তী ৩ দিন পর্যন্ত সহবাসে সংযত হতে হবে।
৩। ভ্যাজাইনাল মিউকাস এর পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ
এই পদ্ধতির দ্বারা ঋতু চক্রের বিভিন্ন সময়ে ভ্যাজাইনাল মিউকাসের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে অভুলেশনের সময় নির্ধারণ করা যায়। সাধারণত মাসিকের ১০ম-১২তম দিনে একটু ঘন আঠাল সাদাটে ভ্যাজাইনাল মিউকাস দেখা দেয় যা ধীরে ধীরে পরবর্তী ২-৩ দিনের মধ্যে ডিমের সাদা অংশের মত পাতলা স্বচ্ছ পিচ্ছিল মিউকাসে রূপ নেয়। এই সময়টাতেই অভুলেশন হয়। যে কয়দিন এই মিউকাস দেখা যায়, সেই দিনগুলো এবং পরবর্তী আরও ৩ দিন পর্যন্ত সহবাসে সংযত হতে হবে।
৪। অভুলেশন কিট টেস্ট
অভুলেশন টাইম বের করার জন্য বাজারে বিভিন্ন রকম টেস্ট কিট পাওয়া যায়। সেগুলো দিয়েও অভুলেশন টাইম বের করা যায়। এক্ষেত্রে ইউরিন বা থুতু পরীক্ষার মাধ্যমে অভুলেশনের আগাম বার্তা পাওয়া যায়। কিট ব্যাবহার করার সময় মনে রাখতে হবে, এই টেস্ট শতভাগ সঠিক নয়, তবে অন্য পদ্ধতিগুলোর সাথে মিলিয়ে ব্যাবহার করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মতামত নিয়ে ও কিটের ম্যানুয়ালে উল্লেখিত নিয়ম মেনে তবেই কিট ব্যাবহার করা উচিত।
সেফ পিরিয়ড গণনায় সতর্কতা-
আপনি যদি সেফ পিরিয়ডের সুযোগটি কাজে লাগাতে চান, তাহলে আপনাকে কিছু সতর্কতা মেনে চলতে হবে। যেমন-
১। আপনার মাসিক নিয়মিত থাকতে হবে। অন্তত, বিগত ৬ মাসের মাসিক নিয়মিত থাকতে হবে।
২। মাসিকের চক্র ২৮ থেকে ৩২ দিনের ভেতরে হতে হবে।
৩। গণনার জন্য আপনি যে পদ্ধতিই ব্যাবহার করেন না কেনো সেটি একদম নিখুঁতভাবে করতে হবে।
৪। অভুলেশন কিট ব্যাবহারের ক্ষেত্রে কিটের সাথে দেয়া ম্যানুয়ালের নিয়ম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করতে হবে।
৫। অভুলেশন হওয়ার পর ডিম্বাণু সাধারণত ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত জীবিত থাকে। কিন্তু শুক্রাণু ৩-৫ দিন পর্যন্ত নারীর যোনিপথে জীবিত থাকতে পারে। তাই অভুলেশনের আগে পরে মিলে লম্বা একটি সময় এই সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। ফলে একদম নিরাপদ দিন হিসেবে খুব অল্প দিনই পাওয়া যাবে। এটা মাথায় রাখতে হবে।
সেফ পিরিয়ডের হিসাব কি শতভাগ নির্ভরযোগ্য?
সেফ পিরিয়ড পদ্ধতি অনুসরণ করে গর্ভধারণ বিলম্বিত করার ক্ষেত্রে সবার মনেই একটি প্রশ্ন উঁকি দেয় যে সেফ পিরিয়ড আসলে কতোখানি সেফ?
আল্লাহতায়ালা যে মানব শিশুর আগমন নির্দিষ্ট করে রেখেছেন, পৃথিবীর কোন কিছুই তার আগমন আটকাতে পারবে না। সুতরাং সেফ পিরিয়ড শতভাগ সেফ না। আবার এটাও ঠিক যে, আল্লাহর দেয়া জ্ঞান দিয়েই মানুষ নানান রকমের গবেষণা করছে, আল্লাহর কুদরতের বিভিন্ন বিষয় খুঁজে বের করছে। তাই সেফ পিরিয়ডের সফলতার হার প্রায় ৯৯% কিন্তু শতভাগ নয়।
তবে সেফ পিরিয়ডের সাফল্য যতটা নির্ভর করে এর নিজস্ব কার্যকারিতার উপর, তার চেয়ে বহুলাংশে নির্ভর করে সুনির্দিষ্টভাবে সেফ পিরিয়ড গননা করতে পারার উপর। কেননা, আপনি যদি একদম সঠিকভাবে নিরাপদ দিনগুলো বের করতে না পারেন, তাহলে ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু নিষিক্ত হবার সুযোগ পাবে এবং গর্ভধারণ হবে। সঠিকভাবে গননা করা হয় না বিধায় এই পদ্ধতির ব্যর্থতা হার প্রায় ১৪ শতাংশ! গণনা সঠিক হলে সফলতার সুযোগও ভালো থাকে।
সর্বোপরি বলা যায়, প্রাকৃতিক ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত এই পদ্ধতির সঠিক ব্যবহার করতে পারলে এটি বেশ সহজ ও আনন্দময় অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
বিশেষ নোট:
এই লিখায় কোথাও গর্ভধারণকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছেনা, কিংবা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কিছুই বলা হচ্ছেনা। আল্লাহর দেয়া প্রাকৃতিক একটি বিষয়কে তুলে ধরা হয়েছে। কারোর বুঝতে ভুল হলে লিখাটি আবার পড়ুন এবং মন্তব্য করুন।
তথ্যসুত্র
- What days are safe to avoid pregnancy?
- Sex around Periods
- জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক পদ্ধতি
- অভুলেশন কিট কিভাবে কাজ করে?
লেখাটি রিভিউ করেছেন –
ডাঃ সাবেরিনা সালাম সারাহ
MBBS, PGT (Pediatrics), Medical Officer, Pediatrics & Neonatology Department, Bangladesh Specialized Hospitalå
ইসলামি দৃষ্টিকোন থেকে মাসিক চলাকালীন সময়ে সহবাস করা পুরোপুরি হারাম। এই আর্টিকেলে মাসিক চলাকালীন সময়কে নিরাপদ বলে সহবাস করতে উৎসাহিত করা হয়েছে যা ইসলামিক দিক দিয়ে উচিত হয় নি। এছাড়াও মাসিক কালীন সহবাস করা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ। আশা করছি বিষয়টি বিবেচনা করে আর্টিকেলটি ইডিট করবেন। কারন এরকম একটা উপকারী ওয়েবসাইটে এরকম লিখা থাকা উচিত নয়।
এই লেখার কোথাও মাসিক চলাকালীন সহবাসে উৎসাহিত করা হয় নি। আপনি লেখাটা আবার পড়ে দেখুন।
এই লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো স্ত্রীর ঋতুচক্রে এমন একটা সময় খুঁজে বের করা যাতে ‘অনিরাপদ’ সহবাসের ফলেও যেন গর্ভধারণ না হয়। – সম্পাদক।
“অর্থাৎ পিরিয়ড শুরুর পর থেকে প্রায় ৮ দিন আপনার জন্য নিরাপদ, মাসিক ভালো হওয়ার পর এ দিনগুলোতে কোনও পদ্ধতি ব্যবহার না করেও সহবাস অনায়াসেই করা সম্ভব।”
এটা ইসলামের বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।
আপনার কোট করা লেখাটাই আপনি আবার পড়ে দেখেন। “মাসিক ভাল হওয়া পর” এই অংশটা খেয়াল করবেন। ইসলামের বিধান লংঘিত হয়নি, বরং যথাযথভাবে ব্যালেন্স করা হয়েছে।