আমাদের বিয়ে হয় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। বিয়ের পরপরই বেবি নেই নাই, কারন আমার তখন মাত্র আন্ডারগ্যাড শুরু হয়েছিলো। গোটা চারটা বছর পড়াশুনার চাপে বেবি নেওয়ার বিষয়টা চিন্তা করতে পারিনি। সাথে আমার হাজবেন্ড ও সবসময় সাপোর্ট করেছে, যদিও সে বেবির জন্য অনেক পাগল ছিল। গ্রাজুয়েশন যখন প্রায় শেষের কাছাকাছি চলে আসলো তখন আমরা বেবি নেওয়ার কথা ভাবলাম। তখনো আন্ডারগ্যাড শেষ হয়নি, থিসিসের কাজ চলছিলো, সময়টা ২০১৯ এর ডিসেম্বর। আমার LMP ছিল নভেম্বরের ১৫ তারিখ। আর ডিসেম্বরের ২১ তারিখ টেস্ট করে দেখলাম, পজিটিভ।
প্রেগন্যান্সিকালীন সময়
পজিটিভ জানার পর কেন জানিনা অনর্থক ভয় কাজ করতো আর সবকিছু অগোছালো লাগতো। এখন মনে হয় প্রেগ্ন্যান্সি সম্পর্কে অতোটা ওয়াকিফ ছিলাম না বিধায় অতোটা ভয় কাজ করতো। যাইহোক, ডিসেম্বর মাসে অর্থাৎ প্রথম মাসটা অনেক স্ট্রেসফুল কাটিয়েছি, কারণ তখনো আমার ডিফেন্স বাকি ছিল আর আমার অবস্থা ও অতোটা ভালো ছিলনা। একদম শুরু থেকেই ডিজিনেস, বমি ভাব ছিল সারাক্ষণ। এরপর ডাক্তারের কাছে গেলাম ডিসেম্বরের ৩০ তারিখ। ডাক্তার নরমাল ফলিক এসিড আর বমির ঔষধ দিলেন। আর কিছু টেস্ট দিলেন এবং তিন সপ্তাহ পর রিপোর্ট নিয়ে দেখা করতে বললেন। বলে রাখি ডিসেম্বরের লাস্ট উয়িক থেকে বমির ভাব ছিল। কিছুই খেতে পারতাম না, বলতে গেলে। ধরে নিয়েছিলাম এসব স্বাভাবিক প্রেগন্যান্সিতে। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছিল বমির পরিমান ততই বেড়ে যাচ্ছিলো। কোন কিছুই খেতে পারতাম না। পানি খেলে তাও বমি হতো সাথে সাথেই। ইভেন রাতে ঘুম থেকে উঠে ও বমি করা লাগতো।
যেহেতু কিছুই খেতে পারছিলাম না, আর আমার অবস্থা ও দিনদিন খারাপ হতে চলেছে, তাই দুই সপ্তাহ শেষ না হতেই আমার বর একপ্রকার জোর করেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। আমি যেতে চাচ্ছিলাম না যেহেতু এক সপ্তাহ পরেই রিপোর্ট নিয়ে যাবো এটা ভেবে। আর তখনো আমার কাছে আমার খেতে না পারা, বমি করা ইত্যাদি নরমাল লাগছিলো। যাইহোক, হস্পিটালে গেলাম এবং ডাক্তার দেখা মাত্র সাথে সাথেই বললেন এডমিট হয়ে যেতে। আর ডাক্তারের কথা অনুযায়ী এডমিট হলাম। এটা ছিল জানুয়ারির ১৫ তারিখ রাতের কথা। এডমিট হওয়ার পর থেকেই স্যালাইন চলছিলো অনবরত তিন দিন। ডাক্তার অনেক গুলো টেস্ট দিলেন। টেস্ট গুলো করানো শেষে জানতে পারলাম আমার এচিটন বেড়ে গিয়েছে এবং গলব্লাডার স্লাজ। রিপোর্ট পাওয়ার ৪ দিন পর্যন্ত ডাক্তারের অব্জারবেশনে ছিলাম।
এই চারদিন কোন কিছুই খেতে বারণ করেছেন, শুধু মাত্র লিকুইড ছাড়া, তাও পরিমানে অল্প। তৃতীয় দিন এসে আমার বমি বলতে গেলে নাই হয়ে গিয়েছে আর আমার ভাত খেতে ইচ্ছে করেছিলো অনেক বেশি। কিন্তু ডাক্তার নিষেধ করেছেন শক্ত খাবার না খেতে। এই দিকে আমার মনে হচ্ছিলো সেই বেলা ভাত খেতে না পারলে আমি মরেই যাবো। আমার অবস্থা দেখে আমার বর অনেক বার ডাক্তারের কাছে গেলেন ভাত খেতে পারবো কিনা জিজ্ঞেস করার জন্য, কিন্তু ডাক্তার কিছুতেই সম্মতি দেননি। এভাবে করে ৪র্থ দিন এসে দুপুর বেলা জাউ ভাত খাবার অনুমতি দিলেন। আমি সেই জাউ ভাত গুলো (হাভাতের মতন) মন ভরে খাই। সেদিন ভাত খেতে পেরে সত্যি অনেক শান্তি পেয়েছিলাম। প্রায় এক মাসেরও বেশি সময় পর আমি কিছু খেতে পেরেছিলাম ( তাও আবার ভাত 🙂 )।
৪র্থ দিন এসে অর্থাৎ যেদিন ভাত খেতে দিলেন সেদিনই আমার হস্পিটাল থেকে ডিসচার্জ হল। ডিসচার্জের পর বাসায় চলে আসলাম এবং কিছুটা সুস্থ বোধ করছিলাম তখন। এভাবে করে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ আর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ চলে গেলো। বলে রাখা ভালো, হস্পিটাল থেকে এসে মাত্র কয়েক দিন শারীরিক ভাবে ভালো ছিলাম। কিছু দিন যাওয়ার পর থেকেই আমার হালকা জ্বর আসা শুরু করেছিলো। বিভিন্ন বইয়ে, আর্টিকেলে পড়েছি প্রেগ্ন্যান্সিতে জ্বর আসে। তাই এতো বেশি পাত্তা দিলাম না। তখনো অব্দি আমার জ্বরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১০০ ডিগ্রি।
এভাবে করে দুই সপ্তাহ গেলো আর যেহেতু জ্বর প্রতি দিনই আসছে তাই ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখ আবার ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার ও কিছু বলেন নি কেবল এইচ ট্যাবলেট দিলেন আর জ্বর আসলে ডেইলি ৩ টা করে খেতে বললেন। সাথে তো ক্যালসিয়াম আর আয়রন আছেই। আবার একমাস পরে দেখা করতে বললেন। এভাবে করে জ্বর নিয়ে আরও দশ দিন গেলো। কিন্তু জ্বর কমছিল না বরং তাপমাত্রা আরও বেড়ে যাওয়া শুরু হল। এবার জ্বরের তাপমাত্রার পরিমান ১০২ ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে গেলো। তাই ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখ ডাক্তারের সাথে দেখা করলাম। ডাক্তার এবার এইস ট্যাবলেট দিনে চারটা করে খেতে বললেন, তারপরেও জ্বর না কমলে বা বেড়ে গেলে সাপুজিটরি ইউজ করতে বলেলেন।
তার সাথে ৪/৫ টা টেস্ট দিলেন আর রিপোর্ট নিয়ে আবার দেখা করতে বললেন। এভাবে করে টেস্ট গুলো করতে এবং রিপোর্ট হাতে পেতে প্রায় তিনদিন লেগে গেলো। আর রিপোর্ট পাওয়ার পরেই ডাক্তারকে তা দেখাতে নিয়ে গেল আমার বর। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে টাইপয়েড সাস্পেক্ট করলেন। এবং মেডিকেশন হিসেবে ডেনভার দিলেন দশ দিনের জন্য। ডাক্তারের কথা মতো মেডিসিনের ফোল কোর্স শেষ করলাম। মেডিসিন শেষ মার্চের দশ তারিখের দিকে। তখন পর্যন্ত আমি তেমন কিছুই খেতে পারতাম না। মেডিসিন তো খালি পেটে খাওয়া যায় না। তারজন্য করতাম কি, এক স্লাইস তরমুজ খেয়ে মেডিসিন নিতাম প্রতি বেলা।
এভাবে এন্টিবায়োটিক শেষ হওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত শারীরিকভাবে ভালো ছিলাম আমি। কিন্তু মার্চের ১৫ তারিখ থেকে আবার জ্বর আসা শুরু হয়। ধীরে ধীরে জ্বরের পরিমান বাড়তে থাকে। তাই মার্চের ২১ তারিখ আবার গেলাম ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার সব কিছু দেখে- শুনে মেডিসিন স্পেসালিস্টের কাছে রেফার করে দেন। কিন্তু গত বছর করোনার প্রকোপের কারণে ২৬ মার্চ থেকে লকডাউন শুরু হয়ে যাওয়ায় সব ডাক্তার আগে থেকেই চেম্বার করা বন্ধ করে দেন। আর আমরা অনেক চেষ্টা করেও কোন মেডিসিন স্পেশালিষ্টের শরণাপন্ন হতে পারিনি। কিন্তু অনেক চেস্টা চালিয়ে যাওয়ার পর আমার বরের এক পরিচিত ( আমি বলবো- ফেরেশতা সমতুল্য) উনার বন্ধুর নাম্বার দেন আর ফোনের মাধ্যমেই সেই ডাক্তারের সাথে কথা হয়।
উনাকে সব কিছু বলার পর উনি কিছু টেস্ট দিলেন আর ঐ লকডাউনের মধ্যে টেস্ট গুলো করালাম। ইমারজেন্সির মাধ্যমে টেস্টের রিপোর্ট গুলো নেওয়া হল। এদিকে আমার জ্বরের পরিমান বেড়ে ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত গড়াল। ডাক্তার রিপোর্ট দেখে দিনে ৪ টা করে দশ দিনের এন্টিবায়োটিক দিলেন। এবার এন্টিবায়োটিক গুলো একেকটা খেলেই মনে হতো যেন আমি পাগল হতে চলেছি। জীবনে প্রথমবার এতো বেশি খারাপ লেগেছিল কোন মেডিসিন নেওয়ার পর। কেন জানিনা, তখন শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম যেন তাড়াতাড়ি এই এন্টিবায়োটিক গুলো শেষ হয়ে যায়।
মনে আছে, যেদিন আমার এই দফার এন্টিবায়োটিক শেষ হয়েছিলো সেদিন মনে হচ্ছিলো যেন আমি কোন অলৌকিক সুখের সন্ধান পেয়েছি সাথে আমার বরের ও সেম অবস্থা। কারণ সে সময় টাতে আমার অবস্থা খুবই নাজেহাল হয়ে গিয়েছিলো। এভাবে এন্টিবায়োটিক শেষ হল এবং আমি দুদিন পর্যন্ত মোটামুটি ভালো ছিলাম। তৃতীয় দিন থেকে আমার পুনরায় জ্বর ফিরে আসে। ডাক্তারকে আমার কন্ডিশন সম্পর্কে জানানোর পর তিনি এন্টিবায়োটিক সাজেস্ট করলেন আবার পাঁচ দিনের জন্য। এটা ছিল মূলত এপ্রিল মাসে আমার কন্ডিশন। এপ্রিলের লাস্টের দিকে এসে আমি মোটামুটি সুস্থ্য হয়ে গিয়েছিলাম।
এরপর শুরু হল ২০২০ সালের রমজান মাস, এপ্রিলের ২৫ তারিখ থেকে সম্ভবত। এই দফায় সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো। খাওয়া- দাওয়া, ঘুম সবকিছু। কিন্তু বমি টা ছিল। এভাবে করে রোজা রাখলাম। মোট ১৮ টা রোজা রাখতে পেরেছিলাম। এরপর আর রাখতে পারিনি, কারণ আমার পেট খালি থাকলেই বমি টা বেড়ে যেত। গত বছর প্যান্ডেমিক শুরু হওয়াতে প্রথম দিকে কম বেশি সবাই ভয়ে ছিল। আমার বরের ও সেই করুন অবস্থা। একেত আমার অবস্থা অতোটা ভালো না, তারপর আমার শ্বশুর- শাশুড়ি, মা-বাবা থাকেন গ্রামে। আমার বরের মনে হচ্ছিলো এই ক্রিটিক্যাল সময়ে সবার একসাথে থাকলে ভালো হবে, সেক্ষেত্রে কারো জন্য টেনশন থাকবে না, আর আমার ও ভালো টেক কেয়ার হবে । তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো গ্রামে চলে যাবার। তখনো পুরুদমে লকডাউন, কোন গাড়ি চলছিলো না। কিন্তু গত বছর ঈদের দু দিন আগে সরকার ইমারজেন্সি হিসেবে প্রাইভেট কার খুলে দিয়েছিলো। সেই সুবাদে আমরা গ্রামে চলে যাই। যদিও গ্রামে যেতে আমার মন বিন্দু পরিমানেও সায় দেইনি। কিন্তু তারপরেও গিয়েছিলাম আমার বর স্ট্রেস নিবে সেটা ভেবে।
যাইহোক, আমরা চলে গেলাম গ্রামে। তখনো গ্রামে করোনার অবস্থা মোটামুটি ভালো ছিল। বলে রাখা ভালো মে মাস অব্দি আমি কোন আল্ট্রা করাতে পারিনি একটা বারের জন্য ও। গ্রামে গিয়ে ১৪ দিন কুয়ারেন্টাইন পালন করেই তবেই সিদ্ধান্ত নিলাম গ্রামেই একটা গাইনকলজিস্ট দেখানোর। জুন মাসের ৭ তারিখ প্রথম আল্ট্রা করেছিলাম আমি, তখন আমার প্রেগ্ন্যন্সির ৮ মাস শুরু হয়েছিলো। ডাক্তার চেক আপ, আল্ট্রা – রিপোর্ট সবকিছু দেখে বললেন সব ঠিক আছে যদিও আমার এম্নুটিক ফ্লুয়িড বেশি বলেছিল। তিনি কিছু ভিটামিন আর আয়রন, ক্যালসিয়াম কন্টিনিউ রাখতে বলেছিলেন। আর জুলাই মাসে আবার ফলো আপের জন্য যেতে বললেন।
আমরা জুলাই মাসে নতুন আরেকটা ডাক্তার দেখানোর সিদ্ধান্ত নি। জুলাই তে ডাক্তার যাকে দেখালাম তিনি ও একজন বেশ ভালো গাইনকলজিস্ট ছিলেন কক্সবাজারের। যাইহোক, উনি দেখলেন আমাকে, বেবি ঠিক আছে বললেন আর কিছু টেস্ট করতে বললেন। টেস্ট গুলো করে রিপোর্ট নিয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে। তিনি বললেন এম্নুটিক ফ্লুয়িড বেশি। কিন্তু উনি বেশি কিছু বলেন নি, সাবধানে থাকতে বললেন আর আগস্টে আবার দেখা করতে বললেন। সে অনুযায়ী আগস্ট মাসে উনার কাছে ফলো আপের জন্য গেলাম। এবার উনি অনেক গুলো টেস্ট দিলেন। রিপোর্ট পেয়ে উনি দেখলেন আমার তখনো অব্দি এম্নুটিক ফ্লুয়িড ২৯ সিএম ছিল। উনি আবার আরেকটা আল্ট্রা করাতে বললেন আল্ট্রা স্পেশালিষ্টের কাছ থেকেএবং বললেন রিপোর্ট দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিবেন সবকিছুর। কারণ আমরা নর্মাল ডেলিভারি প্রেফার করি সেটা ডাক্তারকে আগে থেকে জানানো ছিল।
কিন্তু এবার এই আল্ট্রা ও তে আসলো এম্নুটিক ফ্লুয়িড এর পরিমান ৩০ সিএম। দুর্ভাগ্যবশত নাকি সৌভাগ্যবশত সেটা বলতে পারবো না, কারন এইবার ডাক্তার কে আমার রিপোর্ট দেখাতে পারিনি। দুদিন উনি ছুটিতে ছিলেন আর দুদিন অপেক্ষা করার পর জানতে পারলাম তিনি করোনা পজিটিভ এবং কুয়ারেন্টাইনে আছেন। তাই উনাকে দেখানো আর সম্ভব হয়নি। এই দিকে এই ৩/৪ দিন আমরা শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করছিলাম, তিনি যাতে আমাদের আর পরীক্ষার ভেতর না রাখেন আর সবকিছু যেন ঠিকঠাক রাখেন। কারণ খারাপ কিছু শোনার সেই ধৈর্য বা মানসিক অবস্থা আর ছিল না আমাদের। এসব মূলত আগস্টের ১১ তারিখের কথা। এদিকে আমার ইডিডি ছিল আগস্টের ২৩ তারিখ।
তাই অপেক্ষা না করে আরেকজন গাইনকলজিস্ট দেখালাম। উনি রিপোর্ট দেখলেন, সবকিছু বললাম এবং আমাদের নর্মাল ডেলিভারির প্রেফারেন্সের কথা উনাকেও জানালাম। উনি সবকিছু দেখে- শুনে নির্ভয় দিয়ে বলেছেন সবকিছু ঠিক আছে আর আমাদের ইডিডি অনুযায়ী ভর্তি হতে বললেন। আর হ্যাঁ, উনি এও বলেছিলেন যে আমরা যদি আগেই ডেলিভারি করতে চাই তাহলে ইডিডি’র এক সপ্তাহ আগে এডমিট হতে বললেন। আর যদি ইডিডি পর্যন্ত অপেক্ষা করি আর এর মধ্যে ওয়াটার ব্রেক হয় তাহলে সাথে সাথেই এডমিট হতে বললেন। আর যদি ইডিডি অব্দি লেবার পেইন না আসে তাহলে পেইন ইন্ডিউচ করাবেন।
যাইহোক,আগস্টের ১১ তারিখ ডাক্তার দেখালাম, ১২ তারিখ এসে আবার গায়ে র্যাশ উঠা শুরু করলো। এবার ও এই র্যাশ নিয়ে অনেক বেশি ব্যাগ পেতে হল। কোন ভাবেই কমছে না, বরং বেড়ে চলেছে। এই র্যাশ উঠা এবং উঠার সময়কার চুলকানির কথা মনে পড়লে এখনো আমার গাঁ শিয়রে উঠে। এমন অবস্থা ছিল মনে হতো যেন গায়ের স্কিন গুলো ছিঁড়ে ফেলি। ৭/৮ দিন এভাবে গেলো। পরে অবস্থার আরও বেশি অবনতি হতে থাকলে আগস্টের ২০ তারিখ আবার গেলাম ডাক্তারের কাছে। উনি বললেন, প্রেগন্যান্সিতে এসব হয় আর একবার ডেলিভারি হয়ে গেলে চলে যাবে এসব। তারপরেও উনি একটা ক্রিম দিলেন আর একটা ট্যাবলেট দিলেন খাওয়ার জন্য। কিন্তু এই ক্রিম আর মেডিসিন নেওয়ার পরেও এদিকে আমার অবস্থা পাগল্প্রায় হতে চলেছে। কোন ভাবেই কমছে না কিছু। আর এইদিকে র্যাশ- চুলকানির তীব্র যন্ত্রণায় রাত- দিন কোন ভাবেই ঘুমাতে পারতাম না। নিজের স্কিন কে নিজেই নক দিয়ে পাগলের মতো আঁচড়াতাম। এভাবে করে আরও তিন দিন চলে গেলো এবং আগস্টের ২৩, বহুল প্রতীক্ষিত দিন টা চলে আসলো। মনে আছে আমার সেদিন আমি এতো বেশি খুশি আর এক্সাইটেড ছিলাম যা আমাকে লেবার পেইনের মতো ভয়াবহ জিনিস কে ও তুচ্ছ মনে করার মানসিক শক্তির যোগান দিয়েছিলো।
যাইহোক, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ২৩ তারিখ সকাল ১১ টায় হস্পিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম এবং ১২ঃ৩০ নাগাদ সব ফরমালিটিস শেষ করে আমাকে চেক আপের জন্য নেওয়া হল। সবকিছু চেক করে কেবিনে চলে গেলাম। ১২ঃ৫৫ দিকে আমাকে প্রথম পিটুসিন দেয়া শুরু করলেন, এবং তা রাত ১০ টা পর্যন্ত চলেছিলো। রাত দশটার পর পিটুসিন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই পর্যন্ত আমার কোন পেইন আসেনি। এদিকে আমি দোয়া পড়ছি আর খেজুর খেয়ে যাচ্ছি যাতে সবকিছু ভালো মতো হয়। কিন্তু প্রথম দিন কিছু হল না, ২য় দিন সকাল আট টা থেকে আবার পিটুসিন দেয়া শুরু করলেন। সকাল ১১ টার দিকে এসে আমার ওয়াটার ব্রেক হল। পিটুসিন এ দিনও রাত ১০ টা পর্যন্ত চলল কিন্তু কোন পেইন আসেনি এই দফায় ও।
এদিকে ডাক্তার- নার্স রা সবকিছু চেক করছিলো প্রতিনিয়ত। আর আমিও বুঝতাম বেবির মুভমেন্ট। যাইহোক রাত দশ টার দিকে ডাক্তার আসলেন চেক করে বললেন যদি আগামীকাল ১২ টা অব্দি পেইন না উঠে তাহলে সিসেক করাবেন। এইবার আমি কিছুটা শক্তি হারাতে শুরু করলাম। তারপরেও অনবরত দোয়া পড়ে চলেছি, আর মনের আনাচে- কানাচে যত সব শক্তি আছে তা নিংড়ে নিংড়ে একযোগ করার চেষ্টা করছি। সেই সময় টাই এতো বেশি টেনশন লাগছিলো যা কেবল চোখের পানিতেই প্রকাশ পাচ্ছিলো। তখন মনের ভেতর কিছু অগোছালো দুচিন্তা হানা দিচ্ছিল। এমন একটা সময় ছিল সেটা বা এমন কিছু কষ্টের ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো যা আজ অব্দি কাউকে বলার সাহস কুড়াতে পারিনি। তারপরেও নিজেকে শক্ত করে অনবরত দোয়া পড়েই যাচ্ছিলাম সেই রাতে।
২৫ তারিখ সকালে ৮ঃ৩০ টার দিকে আমার পেইন শুরু হল। মানুষ পেইন হলে কষ্ট পায় শুনেছি, কিন্তু এই যাত্রায় আমি আর আমার বর এতো বেশি খুশি হয়েছিলাম, মনে হচ্ছিলো এই লেবার পেইন টাই আমাদের কাছে সাত রাজার ধন। নার্স এসে পিভি চেক করলেন এবং ১২ টার দিকে আমাকে ডেলিভারি রুমে নেওয়া হল। এদিকে আমার পেইন ক্রমশ বেড়েই চলছে, যা বর্ণনাহীন আমার কাছে। এভাবে ১২ঃ৪৫ মিনিটে আমাদের মেয়ে, আমাদের রুহ পৃথিবীতে আগমনের আগেই প্রত্যাবর্তন করে শেষ করেছিলো তার ৩০৫ দিনের সফর। আমাদের ছেড়ে চলে যায় যেখান থেকে সে এসেছে সেখানেই। আর সাথে আমাদের দিয়ে যায় প্রাণহীন এক শূন্য, নিস্তেজ- নিস্তব্ধ জীবন। যে নিস্তব্ধতা, শূন্যতার আদৌ কোন মলম আছে কিনা জানা নেই!!
ডাক্তারের ভাষ্য
তার গলায় এম্বলিক্যাল কর্ড পেছানো ছিল। কিন্তু জম্নের ১০ দিন আগেও ২ টা আল্ট্রা করিয়েছি, কোন আল্ট্রা তে কিছুই আসেনি। ইভেন জম্নের ২ মিনিট আগেও সে এতো এতো এক্টিভ বেবি ছিল, তার মুভমেন্ট, যখন ডপলার দিয়ে চেক করা হয় তখনো ডাক্তার নিজেই বলেছেন বেবির মুভমেন্ট ঠিক আছে। আর জম্নের সময় তার হ্যালথ ভালো, ওজন ৩ কেজি ছিল। তাহলে ভুল কোথায় হয়েছিলো?! সেই প্রশ্নের উত্তর আমরা প্রতি মুহূর্তে খোঁজে ফিরি।
কিছু কথা, কিছু স্মৃতি
- বই, আর্টিকেল পড়ে যত টুকুন জানতে পেরেছি, সাধারণত প্রেগ্ন্যন্সিতে বাচ্চার মুভমেন্ট শুরু হয় ১৬- ১৮ সপ্তাহে। কিন্তু আমাদের রুহ তার রেসপন্স শুরু করেছে ১২ সপ্তাহ থেকে। সে অনেক বেশি এক্টিভ বেবি ছিল। প্রতি মুহূর্তে জানান দিত তার উপস্থিতি আমাদের।
- প্রেগ্ন্যন্সির শুরু থেকেই ওর সাথে প্রতিনিয়ত কমিউনিকেট করার চেষ্টা করতাম আর মজার ব্যাপার হল সে সবসময় রেসপন্স করতো। ডেইলি মিনিমাম আধা ঘন্টা তার সাথে কথা বলতাম। এমনও ছিল, যখন আমার মুড সুইং হতো, তখন মন খারাপ করে থাকলে সে এতো বেশি মুভ করতো মনে হতো যেন কিছু বলতে চায় আমাকে, বলতে চায়- মন খারাপ করো না, আমি আছি তোমার সাথে। মজার ব্যাপার ছিল- আমার মন খারাপের সময়কার তার মুভমেন্ট গুলো এতো বেশি ফানি ছিল যে, মন যতই খারাপ হোক, না হেসে পারতাম না।
- প্রেগ্ন্যন্সিতে বেশি বেশি সূরা শোনা হতো। তার পছন্দের সূরা ছিল- আল ইমরান। যখনি সূরা আল ইমরান শুনাতাম তাকে তার মুভমেন্ট তিন গুন বেড়ে যেত। ইভেন কোন কারণে যদি তার মুভমেন্ট কমে যায় সূরা আল ইমরান চালু করার সাথে সাথেই সে তার উপস্থিতি জানান দিতো। সে চলে যাওয়ার পর থেকে আজ অব্দি সূরা আল ইমরান শোনা হয়নি আমাদের, কারণ এখনো অব্দি শোনার সেই সাহস টাই করে উঠতে পারিনি।
- সে এক্সপেরিমেন্টাল খাবার অনেক বেশি পছন্দ করতো। আমি নতুন কোন খাবার খেলেই সে তার মুভমেন্টের ধরণ দিয়ে তার পছন্দের কথা বলতো। আমার প্রেগ্ন্যন্সির পুরু সময় কেটেছে তাকে অব্জারভ করে এবং প্রেগ্ন্যান্সি- প্যারেন্টিং রিলেটেড বই- আর্টিকেল পড়ে। সুতরাং, আমি একটা অনাগত বাচ্চার সাথে কথা বলা, তার সাথে সময় কাঠানো, ভাব বিনিময়, তার সাথে আমার স্বপ্নের আদান- প্রদান সবই চলতো আমাদের মাঝে। আনন্দের বিষয় ছিল এই যে, আমরা দুজনেই একে অপরের ভাষা বুঝতাম।
নোটঃ
- প্রেগ্ন্যান্সির শুরু থেকেই নিয়মিত হাটাহাটি, এক্সারসাইজ সবকিছু করতাম। খেজুর খেতাম প্রচুর পরিমানে লাস্টের দিকে এসে। বাসার সব কাজ করতাম। এবং মোটামুটি ফিট ছিলাম।
- প্রেগ্ন্যন্সি ট্র্যাকে রাখা এবং গাইডলাইন হিসেবে “বেবি সেন্টার” অ্যাপ টা ইউজ করেছিলাম। তাতে করে গাইডলাইনের সাথে সাথে মা এবং বেবির ইম্প্রুভমেন্ট কতটুকুন তা বুঝা যায়।
- মাঝে মাঝে এবং প্রেগ্ন্যান্সির লাস্টের দিকে এসে বেবির মুভমেন্ট কমে যায়। ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় তা অব্জারভ করা হয়না। তাই বেবির মুভমেন্ট ঠিক আছে কিনা এবং তা কাউন্ট করার জন্য “বেবি মুভমেন্ট ট্র্যাকার” নামে একটা অ্যাপের সাহায্য নিতাম।
- আমার গ্রামে যাওয়া ভুল ছিল এখন মনে হয়। নিজের ইন্টুইশন কে প্রাধান্য দেওয়া দরকার ছিল।
- নিজের মনের কথা কাউকে বলতে পারতাম না, অন্যকে প্রাধান্য দিতাম বেশি। যার কারণে অনেক বেশি মানসিক শান্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম পুরো সময়টাতে। আর প্রেগ্ন্যান্সি এমন একটা সময়- সবার উচিত এই সময়টাতে সব কিছুর উপরে নিজেকে, নিজের মানসিক শান্তি টাকে প্রাধান্য দেওয়া।
- ডাক্তারের কথা অনুযায়ী অপেক্ষা না করে আমাদের সিসেক করা দরকার ছিল। তাহলে অন্তত এই মনকে শান্তি দিতে পারতাম।
- ডেলিভারির সময় সকল মায়েদের উচিত সে জায়গা তেই থাকা যেখানে তারা কম্ফরট ফিল করে। কম্ফরট ফিল করেনা এমন জায়গায় যাওয়া মা ও বেবি উভয়ের জন্যই অত্যন্ত হানিকর।
- একজন প্রেগন্যান্ট মহিলাকে জ্ঞান দেওয়ার জন্য ( আমি বলি- তাদের মনের যন্ত্রণা চাপানো) আশেপাশে মানুষের অভাব নেই। কিন্তু ভালোভাবে, পজিটিভ্লি তাদের পুরো জার্নিটাতে সাহায্য করার মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। তাই বেবি প্ল্যান করার আগে অন্তত একজন মাকে নিজের জন্য সেই মানসিক পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরী। কারণ দিনশেষে একজন মাকেই বেশি পোহাতে হয় সবদিক দিয়ে।
- সর্বোপরি সিসেক কিংবা নর্মাল ডেলিভারি কোন একটাতেই বেশি জোর দেওয়া মোটেও উচিত না, অন্তত আমি বিশ্বাস করি। কারণ সিসেক করে যদি আপনি একটা সুস্থ্য বাচ্চার বাবা- মা হতে পারেন তাহলে কেন আপনি নরমাল ডেলিভারির আশায় আপনার বাচ্চাকে পৃথিবীতে আসার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় জানাবেন?!
মহান আল্লাহ সবার মঙ্গল করুন।
লিখেছেন: উম্মে রুহ