আমরা ভেবেই নেই…. মা মানেই সঠিক। বাবা মানেই সঠিক।
সন্তানের ক্ষেত্রে বাবা-মার চেয়ে সঠিক কেউ নেই।
কারণ বাচ্চাকে বাবা-মার অধিক কেউ ভালবাসতে পারে না।
কিন্তু ভালবাসলেই কি সব সঠিক হয়ে যাবে? এমনটা কিন্তু নয়।
যদি দুনিয়ার তাবত বাবা-মা সঠিক হতো, তাদের প্যারেন্টিং সঠিক হতো তাহলে ঘরে ঘরে আদর্শ সুখী, সমৃদ্ধ মানুষের জন্ম নিত। কিন্তু আদৌ কি সেরকম হয়? হয় না।
বাচ্চা জন্মের পর থেকে আমরা অসংখ্য ভুল প্যারেন্টিং এর মাঝখান দিয়ে যাই। আর ভালবাসার দোহাই দিয়ে সবকিছুকে সঠিক সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করি।
কিছু ভুল প্যারেন্টিং এর অল্প কিছু উদাহরণ:
❌ ভুল প্যারেন্টিং ১ঃ
জন্মের পর বাচ্চা রাত জেগে কান্না করছে। তার মানে তার পেটে প্রচুর খিদা। কি করা যায়?
বাচ্চাকে ফরমুলা মিল্ক দাও। বাচ্চা খেয়েদেয়ে আরামের ঘুম দিবে। বাচ্চারও শান্তি, মায়েরও শান্তি!
❌ ভুল প্যারেন্টিং ২ঃ
সলিড শুরুর পর বাচ্চা খেতে চায় না। অন্য সবার বাচ্চা এত্ত এত্ত খায়। আমারটাই খায় না। বাচ্চা একটু মোটাতাজা, নাদুসনুদুস হাতির বাচ্চা না হলে কেমন দেখায়!
ওকে! বাচ্চাকে মাল্টিভিটামিন খাওয়ানো শুরু করা! ভিটামিন খেয়ে বাচ্চার ওজন যখন লিমিট ক্রস করে তখন আবার তার ওজন নিয়ে হা হুতাশ করা!
❌ ভুল প্যারেন্টিং ৩ঃ
বাচ্চাকে খাবার খাওয়ানোর জন্য ভয় দেখানো। যেমন ধরুন বাচ্চা তেলাপোকা ভয় পায়। বাচ্চাকে তেলাপোকা দেখিয়ে ভাত খাওয়ানো। বাচ্চা টিকটিকি ভয় পায়! বাচ্চাকে টিকটিকির ভয় দেখিয়ে ভাত খাওয়ানো।
মানে যে করেই হোক….
ভাত বাচ্চাকে গিলাতেই হবে!
❌ ভুল প্যারেন্টিং ৪ঃ
বাচ্চার হাতে ডিভাইস ধরিয়ে দিয়ে তাকে চুপচাপ বসিয়ে রাখা। আরামচে রেস্ট নেওয়া, কাজ করা, ফোনে কথা বলার ক্ষেত্রে বাচ্চার হাতে একখানা ডিভাইস ধরিয়ে দেয়ার মতো বিকল্প হয় না!
এরপর বাচ্চা যখন ডিভাইস ছাড়া খায় না, ঘুমায় না, কথা বলে না। তখন আবার বাচ্চার সাথে চেচামেচি করা!
❌ ভুল প্যারেন্টিং ৫ঃ
বাচ্চার গায়ে হাত তুলা। বাচ্চা দুষ্টামি করল। দাও মাইর। খাবার খাচ্ছে না। দাও মাইর। পড়তে বসছে না। দাও মাইর।
মাইরের উপর ওষুধ নাই। বাচ্চাকে মাইর ছাড়া কথায় কাজে দেয় না। সে মাইর খাইতে খাইতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে!
সব কথার বড় কথা! আমরা সেকালে বাবা-মার মাইর খাইতে খাইতে বড় হইছি। আমরা কি মানুষ হই নি?
এমন অনেক শিক্ষিত বাবা-মা আছেন যারা বলেন, "কাচা থেকে না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ঠাস ঠাস।" বাচ্চাকে তাই শাসন করে করে এতটাই নুইয়ে রাখা হয় যে সে কোনদিন হয়তো মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারে না!
❌ ভুল প্যারেন্টিং ৬ঃ
বাচ্চাকে শাসন করাই যাবে না। কোন ধমক দেয়া যাবে না। বাচ্চা যখন, যেভাবে যেটা চায় সেটাই হাতে ধরিয়ে দেওয়া।
নিজের জীবনে যা যা পাইনি তার সব বাচ্চার জীবনে এনে দেয়া।
বাচ্চাকে অভাব বুঝতে দিব না, কষ্ট বুঝতে দিব না। জান্নাতি জীবন এনে দিব।
এরপর বাচ্চার চাহিদা নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলেও সমস্যা।
❌ ভুল প্যারেন্টিং ৭ঃ
বাচ্চাকে অভাব বুঝাতে হবে। কষ্ট বুঝাতে হবে। বাচ্চা চাইলেই কিছু দেওয়া যাবে না।
ভালো জামা কাপড় দরকার নাই। খেলনা তো ফেলে দেয়, নষ্ট করে ফেলে। তাই খেলনা কিনে দেওয়ার দরকার নেই। অন্য বাচ্চাকে দেখে তার ভেতর হীনমন্যতা হচ্ছে? হোক। তাতে কি!
আমাদের সময়ে আমরা তেমন কিছুই পাইনি। তাই বলে আমরা মানুষ হইনি?
❌ ভুল প্যারেন্টিং ৮ঃ
নিজের জীবনে যা যা পারিনি তার সব প্রত্যাশা বাচ্চার উপর ঢেলে দেওয়া।
ছোটকাল থেকে তাকে বুঝানো তোমাকে পাহাড়ের সমান বড় হতে হবে। নয়তো এ জীবনের মানে নেই!
তোমার জন্য প্রয়োজনে শরীরের রক্ত বিক্রি করে দিয়ে দিব। তাও তুমি পাহাড় সমান বড় হও।
❌ ভুল প্যারেন্টিং ৯ঃ
বাচ্চাকে কেবল দুনিয়া আর তার প্রয়োজনীয়তা শেখানো। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে হবে। বড় চাকরি করতে হবে। অনেক টাকা কামাই করতে হবে।
কিন্তু সন্তানের মধ্যে সামান্যতম দ্বীনদারিতা আছে কিনা সেটা নিয়ে না ভাবা।
এই সন্তান বড় হয়ে যখন পিতা-মাতার হক আদায় না করে তখন আবার হায় আফসোস করা।
❌ ভুল প্যারেন্টিং ১০ঃ
সন্তান যে বাবা-মাকে অনুকরণ করে, অনুভব করে সেটা ভুলে যাওয়া। সন্তানের প্রথম শিক্ষাঙ্গন তার পরিবার। তার পিতা-মাতা। এই সহজ সত্যটা এড়িয়ে চলা। তার মানসিক বিকাশ, পরবর্তী জীবনে তার নেয়া সিদ্ধান্ত সব কিছুই বাবা-মা থেকে প্রভাবিত।
বাবা-মা সন্তানের শারীরিক সুস্থতা নিয়ে যতটা ভাবেন, মানসিক সুস্থতাকে ঠিক ততটাই এড়িয়ে চলেন।
❌ ভুল প্যারেন্টিং ১১ঃ
বাচ্চা বাবা-মার চেয়ে অন্যদের কাছে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। এটাকে ফিল ফ্রী হিসেবে নেয়া। কখনও ভেবে না দেখা, কেন একজন সন্তানের কাছে বাবা-মার চেয়ে অন্য কেউ বেশি প্রিয়!
কেন তার প্রায়োরিটি লিস্টে বাবা-মা নাই?
❌ ভুল প্যারেন্টিং ১২ঃ
বাচ্চার সামনে বসে পারিবারিক বিরোধ, ঝগড়া করা। অথবা বাবা-মার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে বাচ্চার সামনে খোলামেলা আচরণ করা!
কারণ বাচ্চা ছোট, অবুঝ! সে কিছু বুঝে না!
❌ ভুল প্যারেন্টিং ১৩ঃ
পরিবার, আত্মীয় সবার সামনে বাচ্চাকে শাসন করা, ধমকানো। কখনও চড়, থাপ্পড় দেয়া। বাচ্চারও যে একটা আত্মসম্মানবোধ থাকতে পারে সেটা বেমালুম ভুলে যাওয়া।
❌ ভুল প্যারেন্টিং ১৪ঃ
বাচ্চাকে সময় দেয়া?
সেটা আবার কি জিনিস! বাচ্চাকে নিয়ে ঘুরতে বের হওয়া, প্রকৃতির সান্নিধ্যে নেয়া, আত্মীয়দের সাথে পরিচয় করানো…. ব্যস্ত জীবনে এত সময় কোথায়!
বড় হয়ে এই বাচ্চাটাই যদি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠে। পরিবার, আত্মীয়ের হক আদায় না করে তখন বর্তমান প্রজন্ম আর সভ্যতাকে গালিগালাজ করা।
❌ ভুল প্যারেন্টিং ১৫ঃ
বাচ্চার সাথে কোন আত্মিক যোগাযোগ, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না থাকা। বাচ্চা জানে বাবা-মা টাকার মেশিন। অন্য কিছু নয়। মন খারাপের গল্প বাবা-মার সাথে শেয়ার করার কথা কল্পনাতেও আসে না।
মা মজার রান্না করবে, বাবা শখের জিনিস কিনে দিবে। উল্টাপাল্টা কিছু করলেই শাসনের পর শাসন করবে।
❇️ শেষ কথা,
একটা সঠিক প্যারেন্টিং যেমন বাচ্চার জন্য অত্যন্ত উপকারী। ঠিক তেমনি একটা ভুল প্যারেন্টিং একটা সন্তানকে আজীবন ভুগায়।
ভুল প্যারেন্টিং-এ বড় হওয়া সন্তানটা কিন্তু একাই তার কষ্ট ভোগ করে না। বরং তাকে ঘিরে থাকা মানুষ গুলোও কমবেশি সেটার ক্ষতিকর প্রভাবের মধ্যে পড়ে।
✴️ মনে রাখবেন প্যারেন্টিং চর্চা করার বিষয়। এটা নিয়ে যত পড়বেন, তত জানবেন। আর যত জানবেন ততই তার সৌন্দর্য আপনার সন্তানের মধ্যে আসবে।
প্যারেন্টিং বিষয়ক জ্ঞানকে তাই কখনও ছোট করবেন না।
🚫 নিজেকে সবার উপরে স্থান দেওয়া অজ্ঞতা বৈ অন্য কিছু নয়! মনে রাখা দরকার, বাবা-মায়েরও ভুল থাকতে পারে।
✅ প্রয়োজনে তাদের বদলানোটা কখনও কখনও ভীষণ প্রয়োজন। সন্তান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত। সে আপনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় যে আপনি আপনার সন্তানের সাথে যেমন খুশি তেমন ব্যবহার করবেন।