১.
ব্যাংকের চাকরি আরিফার। বয়স ২৬। সারাদিন একই চেয়ারে বসে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। প্রথম প্রথম চাকরিতে ঢুকে বেশ খুশি ছিল। এখন আর সারাদিন বসে থাকতে পারেনা। কোমড়ে প্রচন্ড ব্যথা।

২.
মাকসুদা বেগম সারাজীবন নিচে বসেই সবজি কাটেন। বয়স ৫০ হলো। কোমড়ে ব্যথার জন্যে আর এখন বসতে পারেননা নিচে। “আরেহ,সারাজীবন কাটলেন এখন পারেননা কেন?” নিজে নিজেই ভাবেন।

৩.
বিছানায় বসে পড়তে তন্বীর খুব ভাল লাগে। বয়স ২২। মায়ের কাছে বকুনি সবসময় কেন চেয়ারে বসেনা। পড়াশুনা হবে চেয়ার টেবিলে। তন্বী ভাবে পড়লেই তো হলো। সে বিছানায় বই রেখে কুঁজো হয়ে বসে পড়ে। ইদানিং খুব কোমড়ে ব্যথা হয়। বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেনা।

উপরের প্রায় প্রত্যেকটি ঘটনাতেই ব্যথা শুরু হওয়ার মূল কারণ লাইফস্টাইল। মেডিকেলীয় ব্যথাগুলোর মাঝে অনেকগুলো ব্যথাই এমন যে প্রতিদিন কোন কাজের মাধ্যমে ছোট ছোট আঘাত হয় যা আমরা সাথে সাথে বুঝিনা,কিন্তু একটা সময় গিয়ে তা বড় আকার ধারণ করে। তখন ভাবি কি করে হলো, কেনই বা হলো! আমার তো কোন সমস্যা ছিলনা। কিংবা অমুকের তো হলোনা আমার কেন হলো?

কোমড়ে ব্যথা অনেক বড় বিষয়। কারণ আছে হরেক।

কোমরে ব্যথার কারণগুলো

  • ৪৫ এর কাছাকাছি বয়সে মাসিক বন্ধ হওয়ার পর
  • দীর্ঘদিন ধরে দীর্ঘক্ষণ ঝুঁকে/বাঁকা হয়ে বসে/কুঁজো হয়ে বসে কাজ করা
  • প্রসবকালীন/প্রসব পরবর্তী জটিলতা
  • ভিটামিন ডি/ক্যালসিয়ামের অভাব
  • হাঁড়ের ক্ষয়জনিত কারণে

এছাড়াও থাকতে পারে

  • আকস্মিক আঘাত পাওয়া
  • আথ্রাইটিস
  • যেকোন ধরণের ইনফেকশন
  • টিউমার
  • কিছু স্ত্রীরোগের ক্ষেত্রে উপসর্গ হিসেবে কোমরে ব্যথা হতে পারে

আমরা কথা বলবো যে ব্যথাকে আমি প্রতিরোধ করতে পারি তা নিয়ে। আমাদের প্রাত্যহিক কাজে কিছুটা বদল আনলেই এই ব্যথা এবং তার পরবর্তী জটিলতা থেকে এবং অন্যের উপর নির্ভরশীলতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারি।

কি করতে হবে প্রতিরোধের জন্যে?

১. শরীরকে সচল রাখতে প্রাত্যহিক ব্যায়ামের কোন বিকল্প নেই। প্রতিদিনের কাজের ভীড়ে যদি তা সম্ভব না হয় তবে, হাঁটুন। কিছুসময় বের করে হাঁটার ফলেই আপনার শরীর সচল থাকবে। তবে অবশ্যই অন্য যেকোন ব্যায়ামের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি।

২. আপনার চাকুরিক্ষেত্রে বা কাজের জন্যে যদি দীর্ঘক্ষণ চেয়ারে বসে কাটাতে হয় তবে, চেষ্টা করুন কিছু সময় পর পর উঠে দাঁড়িয়ে শরীরকে একটু বিশ্রাম দিতে। এবং ঝুঁকে বা কুঁজো হয়ে কাজ করবেন না। ছবির মতন চেয়ারে আপনার কোমড় বরাবর কুশন বা ভাঁজ করা টাওয়েল রাখার চেষ্টা করুন।

দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে হলে কোমড় ব্যথা এড়িয়ে কাজ করার উপায়
ছবি ১ – দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে হলে কাজ করার উপায়

৩. প্রচুর পানি পান করুন

৪. নিচু পীঁড়া বা টুলে বসে কাজ করবেন না। চেয়ারে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে করুন। সেক্ষেত্রেও পিঠ সোজা রেখে কাজ করুন। দাঁড়িয়ে দুই পায়ের উপর একসাথে বেশিক্ষণ ভর দেবেন না। এক পায়ের উপর বেশি এবং অপর পায়ের উপর হালকা ভর দিয়ে,পা বদল করে করে দাঁড়ান যদি দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াতে হয়।

৫. ভারী কিছু নাড়ানোর সময় পা ব্যবহার করার চেষ্টা করুন যথাসম্ভব। যদি সম্ভব না হয়, আল্গানোর সময় কোমড় ভাঁজ করবেননা, হাঁটু এবং গোড়ালি ভাঁজ করুন।

কোমড়ের ব্যথা এড়াতে কীভাবে কোন জিনিস আলগাবেন
ছবি ৩ – সঠিকভাবে আলগানো

৬. দৈনিক ৬-৭ ঘন্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন।

৭. দুশ্চিন্তা এবং বিষন্নতাকে কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে পরামর্শ নিন।

৮. গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে- ভারী কিছু আলগাবেন না,নিচু হয়ে/ঝুঁকে কাজ করবেন না।

প্রতিকার

১. উপরের পরামর্শ মেনে চলুন।
২. চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পথ্য মেনে চলুন।
৩. ব্যথার স্থানে গরম সেক দিতে পারেন (গরম পানিতে টাওয়েল ভিজিয়ে)। অথবা বরফ কে কাপড়ে প্যাঁচিয়ে ব্যথার স্থানে লাগাতে পারেন। যা আক্রান্তস্থানে প্রদাহ থাকলে কমিয়ে আনবে এবং আরাম দেবে।
৪. যদি আপনার উচ্চতার তুলনায় ওজন বেশি হয়, তবে কমিয়ে আনুন
৫. পুষ্টিকর খাবার খান।
৬. ঘুমানোর সময় এক পাশ হয়ে দুই পায়ের মাঝে বালিশ দিয়ে ঘুমান, কিংবা চিৎ হয়ে হাঁটুর নিচে বালিশ দিয়ে ঘুমান। এতে আপনার কোমড়ের হাঁড় বিশ্রাম পাবে।

ছবি ২ – পিঠের হাঁড়কে বিশ্রাম দিয়ে শোওয়ার পদ্ধতি

কখন চিকিৎসকের কাছে যাব?

১. যদি আকস্মিক আঘাত প্রাপ্ত হওয়ার পর প্রচন্ড ব্যথা হয়
২. ব্যথার স্থানে ফোলা কিংবা গোটা ধরতে পারেন
৩. আকস্মিক ব্যথার সাথে দ্রুত ওজন কমে যাওয়া ও জ্বর থাকে
৪. শুধুমাত্র ব্যথা আছে কিন্তু ২/৩ সপ্তাহ বা এক মাস ধরে
৫. ব্যথার সাথে পা অবশ হয়ে যাওয়া কিংবা পায়ে দুর্বল ভাব
৬. কোমড়ে ব্যথার সাথে অন্য জয়েন্টেও ব্যথা

সাবধানতা

১. ফার্মেসী বা অন্য কারো পরামর্শে যত্রতত্র ব্যথার ঔষধ খাবেন না এবং ব্যথার কিংবা স্টেরয়েড ইনজেকশন নিবেননা।
২. শারীরিক তথা সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় একেক ব্যথায় এবং একেক রোগীর ক্ষেত্রে ঔষধ হতে পারে ভিন্ন

কোমড়ে ব্যথা খুব প্রচলিত সমস্যা হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা বিরাট আকার ধারণ করে মানুষকে অচল করে ফেলতে পারে। একটু সাবধানতা এবং কিছু বিষয় মেনে চলাই করতে পারে সমস্যাগুলোর প্রতিরোধ। চিকিৎসা বিষয়ে ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত কিছুই করবেননা।