সেলফোন বা মোবাইল ফোন আমাদের আধুনিক জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। অন্যের সাথে কথা বলা, মেসেজ আদান প্রদান, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়া, কাজে যাওয়ার সময় গুগল ম্যাপে লোকেশন খুঁজে নেয়া বা জরুরী নোট নেয়া কোন কাজে মোবাইল ফোন ব্যবহৃত হচ্ছে না! হতে পারে গর্ভবতী আপনি হাসপাতাল ব্যাগে কী কী নিবেন তার নোট নিচ্ছেন ফোনে, অথবা এই লেখাটি আপনার ফোনের স্ক্রীনে পড়ছেন। গর্ভাবস্থায় আপনার সন্তান আপনার যতটা নিকটে, ততটাই নিকটে আপনার মোবাইল ফোনটি।
এই ফোনটি আপনার অনাগত সন্তানের কোন ক্ষতি করতে পারে কী না তা নিয়ে কখনো কি দুঃশ্চিন্তা করেছেন? আসুন বিজ্ঞান কী বলে তা জেনে নিয়ে আপনার দুঃশ্চিন্তার নিরসন করা যাক।
ওয়ারলেস তরঙ্গ নিয়ে বিস্তারিত
আজকের প্রযুক্তি চালিত দুনিয়ায় যেই মোবাইল ফোন আপনাকে সারা দুনিয়ার সাথে যুক্ত রেখেছে সেটা তারবিহীন। আপনার ল্যাপটপটি বাসার রাউটারের সাথে যোগাযোগ রাখছে ওয়ারলেস বা তারবিহীনভাবে। এই ওয়ারলেস প্রযুক্তি এক যন্ত্রের সাথে আরেক যন্ত্রের যোগাযোগ রাখছে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে। এই রেডিও তরঙ্গ একধরনের শক্তি, খুব অল্প পরিমাণ হলেও যার একটা অংশ আমাদের শরীরে জমা হয়। যদি এই শক্তির পরিমাণ অনেক বেশি হয় তবে সেটা আমাদের ত্বকের টিস্যুর নষ্ট করতে পারে বা ডিএনএ’র ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ক্ষতির দিক থেকে ওয়ারলেস তরঙ্গ দুই ধরনের –
১) আয়োনাইজিং রেডিয়েশন – যেখানে তরঙ্গের মাত্রা বেশ শক্তিশালী এবং ত্বকের অণুতে অবস্থিত ইলেক্ট্রনকে ভেঙ্গে আয়নে পরিণত করে। এধরনের পরিবর্তন ক্যান্সারের সূচনা করে।
২) নন-আয়োনাইজিং রেডিয়েশন – তরঙ্গ ততটা শক্তিশালী না এবং ত্বকের অণুতে কোন পরিবর্তনের সূচনা করে না।
মোবাইল ফোন বা গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলো সাধারনত দ্বিতীয় ধরণের রেডিয়েশন উৎপন্ন করে। আবার এক্স-রে, সিটি স্ক্যানার, বা রেডিয়েশন থেরাপি দেয়ার যন্ত্র আয়োনাইজিং রেডিয়েশন উৎপন্ন করে। ঠিক এই কারণেই ডাক্তাররা গর্ভাবস্থায় পারতপক্ষে এক্স-রে করার পরামর্শ দেন না।
গবেষকরা কী বলছেন?
মোবাইল ফোন ও গর্ভাবস্থায় এর প্রভাব নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেশি, তাই এটা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত হওয়া এসব গবেষণায় এমন কোন ফল পাওয়া যায়নি যার ভিত্তিতে ফোনের তরঙ্গের ক্ষতির বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়ে কিছু বলা যায়।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা গবেষণায় গর্ভবতী ইঁদুরের খাঁচার পাশে ফোনকে কল দেয়া অবস্থায় (যখন সবচেয়ে বেশি তরঙ্গ নিঃসরিত হয়) দু’সপ্তাহের জন্য রেখে দেয়া হয়। ফোনের তরঙ্গের মাঝে জন্ম নেয়া বাচ্চাদের আচরণ ও স্মৃতি পরীক্ষায় এমন লক্ষণ দেখা গেছে যেটা ADHD (Attention Deficit Hyperactivity Disorder) আক্রান্ত মানুষের মাঝে দেখা যায়। এতটুকু পড়েই আতংকিত হওয়ার কিছু নেই, কারণ –
ক) ইঁদুরের উপর হওয়া গবেষণা মানুষের জন্য প্রযোজ্য হবে এমনটা ধরে নেয়া যৌক্তিক না
খ) ইঁদুরগুলো তাদের গর্ভাবস্থার পুরো সময় (২৪ঘন্টা/৭দিন) উচ্চমাত্রার রেডিয়েশনে ছিল। একজন গর্ভবতী মা এরকম টানা ফোনে কথা বলবে এটা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
২০১৭ সালে বার্সেলোনার গবেষকরা ৮০ হাজার মা ও তাদের শিশুদের উপর চালানো গবেষণায় দেখা গেছে যেসব মা গর্ভাবস্থায় ফোনে বেশি কথা বলেছেন তাদের সন্তান অস্থিরতা (Hyperactivity) এর মতো আচরণ ও আবেগজনিত সমস্যায় ভুগে। লক্ষ্য করার বিষয় হলো, যেসব মা গর্ভাবস্থায় ফোনে বেশি ব্যস্ত থাকে, তারা সাধারণ অবস্থাতেও হয়তো বাচ্চাকে সময় দেয়ার চাইতে ফোনে বেশি ব্যস্ত থাকেন এবং যার কারণে বাচ্চারা সমস্যাগ্রস্থ হয়।
আবার কিছু গবেষণা এধরনের কোন সমস্যা খুঁজে পায়নি। ২০১৭ সালে হওয়া এরকম আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যেসব বাচ্চাদের মা ফোনে বেশি সময় কাটায় তাদের বাচ্চাদের ভাষাগত ও মটর স্কিল (হাত-পা নাড়ানো ও জিনিস ধরার সক্ষমতা) একেবারে ফোন ব্যবহার না করা মা’দের বাচ্চাদের তুলনায় বেশি।
করণীয় কী?
দেখা যাচ্ছে গবেষণা থেকে এখনো উপসংহারে পৌঁছানো যাচ্ছে না। তাই নিরাপত্তামূলক মধ্যমপন্থা অবলম্বনই বেশি যৌক্তিক।
- ফোনে কথা সংক্ষেপ করা এবং কেবলমাত্র দরকার হলেই ফোন করা।
- কল করার বদলে মেসেজ করা, কারণ কল করার সময় রেডিয়েশন সর্বোচ্চ হয়।
- কল করার সময় উন্মুক্ত স্থানে যান, যেখানে ফোন সহজেই নেটওয়ার্কের সিগন্যাল পায়। সিগন্যাল দূর্বল হলে ফোন অধিক রেডিয়েশন উৎপাদন করে।
- ফোন ব্যবহারের পর তা আপনার কাছ থেকে দূরে রাখুন।
- কথা বলার সময় হেডফোন ব্যবহার করুন। এতে ফোন আপনার থেকে কিছুটা দূরে থাকবে
- রাতে বালিশের কাছে ফোন রাখা থেকে বিরত থাকুন। বরং তা বিছানার পাশের টেবিলে বা বিছানার বাইরে রাখুন।
শেষ কথা
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ওয়ারলেস ডিভাইসকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আবার ওয়ারলেস যন্ত্রপাতি-ই এই রেডিও তরঙ্গের একমাত্র উৎস না। মাইক্রোওয়েভ ওভেন, এক্স-রে মেশিন, বিমান বা নিতান্ত গোবেচারা এফএম রেডিওটিও এই তরঙ্গের লেনদেন করে। আশার কথা হলো, মানব দেহে ওয়ারলেস তরঙ্গের ক্ষতি নির্ভর করে এই তরঙ্গ কতটা শক্তিশালী এবং কত দীর্ঘ সময় আপনি এর সংস্পর্শে আছেন।
তাই মোবাইলের ক্ষতি নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করার চাইতে অপ্রয়োজনীয় স্ট্রেস মুক্ত থাকা বেশি জরুরী।
তথ্যসূত্র
১. হোয়াট টু এক্সপেক্ট
২. বেবিসেন্টার
লেখাটি রিভিউ করেছেন –
ডাঃ সারওয়াত জাবীন আনিকা
এমবিবিএস
KMC (IMCS) – এ বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত
সম্পাদনাঃ হাবিবা মুবাশ্বেরা
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ Technology vector created by freepik