যে কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের জন্যে গর্ভকালীন সময়টা বেশ জটিল। গর্ভবতী অবস্থায় একজন মা’কে বিভিন্ন ধরনের অস্বস্তিকর অবস্থা, হতাশা, শারীরিক ব্যথা-বেদনা, মানসিক জটিলতার ইত্যাদি সম্মুখীন হতে হয় । এই কষ্টকর অবস্থা আরো বেড়ে যায় যদি ইতোমধ্যেই আরেকটি ছোট বাচ্চা থেকে থাকে । সেই বাচ্চার বয়স যদি দুই থেকে চার বছরের মাঝে হয় তবে অবশ্যই বাচ্চাটিকে কোলে নেয়ার দরকার হয়। কিন্তু গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের বাচ্চা কোলেে নেয়া কি ঠিক? এতে কী কোন ঝুঁকি আছে? আসুন বিস্তারিত জানা যাক।
- গর্ভাবস্থায় ছোট বাচ্চা কোলে নেওয়া কতখানি নিরাপদ?
- গর্ভবতী অবস্থায় বাচ্চা কোলে নিলে সম্ভাব্য ঝুঁকি কী কী হতে পারে?
- ১. গর্ভপাত
- ২. বাচ্চা আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে
- ৩. মায়ের শরীরে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে
- নিরাপদে বাচ্চাকে কোলে নেয়ার নির্দেশনা
- অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
- ১. বড় সন্তানকে তখনই কোলে নিতে হবে যখন সেটা প্রয়োজনীয় হবে
- ২. বাচ্চাকে অন্যান্য কর্মকান্ডে ব্যস্ত রাখা
- ৩. অন্য কোন ভাবে সন্তানের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা
- ৪. মাঝে মাঝে কোলে না নেওয়াতে কোন সমস্যা নেই
- শেষকথা
- তথ্যসূত্র
গর্ভাবস্থায় ছোট বাচ্চা কোলে নেওয়া কতখানি নিরাপদ?
দুই থেকে চার বছর বয়সে বাচ্চারা মায়ের কোলে উঠতে অভ্যস্ত থাকে। এ সময় মা যদি গর্ভবতী হন, তবে কোলে নেয়ার সময় তার বাচ্চার ওজন বিবেচনা করতে হবে। একইসাথে দেখতে হবে গর্ভাবস্থা কোন সময় পার করছে। সাধারণত তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে বাচ্চাকে কোলে না নিলে ভালো হয়। কেননা সে সময় গর্ভবতী মায়ের ওজন এবং গর্ভস্থ সন্তানের ওজন বৃদ্ধি পেতে থাকে । তাই এই সময়টাতে বাচ্চা কোলে নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ সর্তকতা অবলম্বন করা উচিত ।
প্রথম তিন মাসে বাচ্চাকে মোটামুটি কোলে নেওয়া যায় । দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার থেকেই কোলে নেওয়ার সময় বাচ্চার ওজন বিবেচনা করতে হবে। পাশ্চাত্যের মানদন্ডে বাচ্চার ওজন যদি ১৩ কেজি বা তার বেশি হয়, তবে বাচ্চাকে কোলে না নিতে বলা হয়। বাংলাদেশের মা’দের শারিরীক সক্ষমতা বিবেচনায় সর্বোচ্চ ১০ কেজির বাচ্চাকে কোলে নেয়া নিরাপদ বলা যায়।
গর্ভবতী অবস্থায় বাচ্চা কোলে নিলে সম্ভাব্য ঝুঁকি কী কী হতে পারে?
সাধারনত ডাক্তাররা গর্ভবতী মাকে শারীরিক পরিশ্রমের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেন। নতুবা মা ও অনাগত সন্তানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।
১. গর্ভপাত
গর্ভবতী অবস্থায় যদি বেশি ওজনের কোনো কিছু উঠানো হয় বা সেটা যদি তার সন্তানকে কোলে নেওয়া হয়, তবে সে ক্ষেত্রে শরীরের বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে । এই ওজন উত্তোলনের জন্য গর্ভপাত পর্যন্ত হতে পারে।
২. বাচ্চা আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে
গর্ভবতী মা সাধারণত দুর্বল ও অবসন্ন থাকেন । অধিক পরিমাণে দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও যদি কোন মা তার সন্তানকে কোলে নেন, দেখা যায় তার হাত থেকে বাচ্চা পড়ে গিয়ে আঘাত প্রাপ্ত হতে পারে।
৩. মায়ের শরীরে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে
গর্ভবতী মা যখন তার বাচ্চাকে কোলে নেয় তখন তার শরীরে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে । যেমন- ঘাড় ব্যথা, কোমর ব্যথা, পেটে ব্যথা ইত্যাদি।
নিরাপদে বাচ্চাকে কোলে নেয়ার নির্দেশনা
কিছু সর্তকতা অবলম্বন করে এই সময় বাচ্চাকে কোলে নেওয়া যায়-
- গর্ভবতী মা যদি অনেক ক্লান্ত থাকে অথবা শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা থাকে তবে সে ক্ষেত্রে তার বড় বাচ্চাটিকে কোলে না নেওয়া তার জন্য ভালো হবে।
- বাচ্চার ওজন যদি ১০ কেজি বা তার বেশি হয় তবে তাকে কোলে নেওয়া ঠিক হবে না।
- বসে থাকা অবস্থায় বাচ্চাকে কোলে নেওয়া যেতে পারে।
- বাচ্চা কোলে নেওয়া অবস্থায় মায়ের পাশে অন্য কোন একজন এর উপস্থিতি থাকলে ভালো হয়।
- গর্ভবতী মায়ের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ হাঁটা উচিত হবে না।
- মা খুব অল্প সময়ের জন্য বাচ্চাকে কোলে নিবে এবং সারাদিনে চার-পাঁচবার এভাবে নেয়া যেতে পারে।
- বাচ্চাকে কোলে নেওয়ার সময় শরীরে কোন ধরনের ঝাকুনি লাগানো উচিত হবে না।
- কোলে নেওয়ার সময় হাঁটু গেড়ে বসে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। এসময় পিঠে অথবা পেটে প্রেশার বা চাপ দেয়া একদমই উচিত হবে না।
- দাড়ানো অবস্থায় কোলে নিতে হলে বাচ্চাকে খাট বা চেয়ারে উঠতে বলতে হবে, যাতে কোলে নেয়ার সময় কোমর বা পেটে কোন চাপ না পড়ে।
- কোলে নেয়ার আগেই বাচ্চাকে বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে যে কোলে উঠে হঠাৎ লাফালাফি করা যাবে না।
গর্ভকালীন সময়ে মাকে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে । নিয়মিত চেকআপ এর মাধ্যমে সুগার ও প্রেসার লেভেল ঠিক আছে কিনা, দেখতে হবে । যাতে গর্ভস্থ সন্তানের কোন ধরনের ঝুঁকি না থাকে।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
১. বড় সন্তানকে তখনই কোলে নিতে হবে যখন সেটা প্রয়োজনীয় হবে
গর্ভাবস্থায় মা’র শরীর অনেক স্পর্শকাতর থাকে, বিশেষত তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে। তাই যতটা সম্ভব বাচ্চাকে কোলে না নেওয়ার জন্য চেষ্টা করা উচিত । সাধারণত ভালোবেসে, আদর করে বাচ্চাকে কোলে নেয়ার চেষ্টা করেন মায়েরা। কিন্তু এটা শরীরে চাপ তৈরি করে। এছাড়াও গর্ভাবস্থার শেষ দিকে শরীর অনেক নাজুক অবস্থায় থাকে। তখন কোন ধরনের ঝুঁকিতে পড়লে, গর্ভস্থ সন্তান , নিজের শরীর অথবা কোলে নেওয়া ছোট বাচ্চা যে কারো ক্ষতি হতে পারে। এজন্য বাচ্চা কোলে উঠতে চাইলেই তাকে কোলে নেওয়া উচিত হবে না । বরং মা যদি আরামদায়ক ভাবে বসে থাকতে পারে তখন কিছু সময়ের জন্য কোলে নিতে পারে অথবা পাশে বসে গল্প শোনাতে পারে।
২. বাচ্চাকে অন্যান্য কর্মকান্ডে ব্যস্ত রাখা
সন্তানের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য তার বাবা-মায়ের সাথে সময় কাটানো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ছোটবেলা থেকেই যে সন্তান যত বেশি তার মা-বাবার সাথে সময় কাটাবে, তার স্বাস্থ্যকর ভাবে বেড়ে উঠার জন্য সেটা ততো ভালো কাজ করবে। কিন্তু গর্ভবতী মা যেহেতু বাচ্চাকে প্রায় সময় কোলে নিতে পারবে না, তাই এই সময় বাচ্চাকে বেশি বেশি করে অন্যান্য কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে । যেমন কোরআন তিলাওয়াত বা গান ছেড়ে দেওয়া যায়, কথা বা গল্প বেশি করে করা, বই পড়ে শোনানো, খেলনা দিয়ে একা একা খেলতে শেখানো ইত্যাদি। যেসব বাচ্চারা নানা ধরনের খেলায় বা কাজে ব্যস্ত থাকে তারা মায়ের কোলে উঠবে বলে অযথা বায়না করে না। বাচ্চাকে ব্যস্ত রাখার আইডিয়া পেতে ফেসবুকে মা’দের কমিউনিটি বা ইউটিউবের সহায়তা নিন। এছাড়াও কোন শিশু বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলতে পারেন।
৩. অন্য কোন ভাবে সন্তানের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা
বাচ্চাকে কোলে নেওয়া, তাদেরকে আদর করা বা ভালোবাসার একটি বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এটাই একমাত্র ভালোবাসা প্রকাশের মাধ্যম না। সন্তানকে ঘন ঘন জড়িয়ে ধরা যায়, তার গালে কপালে চুমু দেওয়া যায়, তাদেরকে মা নিজ হাতে খাইয়ে দিতে পারেন , গোসল করাতে পারেন, ঘুমানোর সময় তাদেরকে গল্প পড়ে শোনাতে পারেন । ছোটবেলা থেকেই সন্তান যদি বুঝতে পারে বাবা মা তাকে ভালবাসেন এবং মা কোলে না নিলেও তাকে অনেক আদর করে , তবে সেটা তার মানসিক বিকাশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ । এছাড়া এতে বাচ্চারা অন্য মানুষের সাথে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে শিখে।
মনে রাখতে হবে , কোলে নেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন ভাবে বাচ্চাকে আদর করা যায়। কিন্তু যদি মনে হয় যে, বাচ্চাকে কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে এটা আসলে বাচ্চার চাহিদা নয় বরং এটা মায়ের ব্যক্তিগত অনিরাপত্তার অনুভূতি (Insecurity feeling) থেকে আসে।
৪. মাঝে মাঝে কোলে না নেওয়াতে কোন সমস্যা নেই
একজন মা সবসময় তার বাচ্চাকে কোলে নেবেন এমন কোন কথা নেই । মাঝে মাঝে বাচ্চাকে কোলে না নেওয়া যেতে পারে। গর্ভস্থ সন্তানের ভালোর জন্য এবং নিজের শারীরিক সুবিধার জন্য মাঝে মাঝে কোলে না নিলে দোষের কিছু নাই । কেননা সবার সুযোগ-সুবিধা দেখতে হবে । একজনকে আদর করতে গিয়ে যাতে অন্য কারো জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি না হয়। এ ব্যাপারে বাচ্চার বাবার সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। যাতে মা কোলে না নিলেও বাচ্চাটি তার বাবার কোলে থাকতে পারে।
শেষকথা
গর্ভাবস্থায় বাচ্চাকে কোলে নেয়া বা না নেয়ার দোটানা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়েও বেশি জরুরী বিষয় হলো ছোট্ট বাচ্চাটিকে তার অনাগত ভাই/বোনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করা। এজন্য তাকে ক্রমাগত কাউন্সেলিং করা, কী কী পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে তা নিয়ে তাকে ধারণা দেয়া, তার ভাই/বোনের জন্য সে কী কী করতে চায় সেগুলো নিয়ে তাকে উদ্দীপ্ত করা বেশি জরুরী। নতুন একজনকে মেনে নেয়া ছোটদের জন্য বেশ কঠিন। তারা যেন কোনভাবে এটা মনে না করে যে তার আদর কমে যাবে বা তাকে কম গুরুত্ব দেয়া হবে। কারণ যে বাচ্চা প্রস্তুত থাকবে না, সে তার ভাই/বোনের প্রতি মারমুখী থাকবে, ফলশ্রুতিতে বাবা-মা হিসেবে তার প্রতি আপনার আচরণ প্রভাবিত হবে।
তাই, আপনার শরীরে সন্তানের বীজ বপনের সাথে সাথে বর্তমান ছোট বাচ্চা, যে আপনার উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে, তার মনে আত্ম-নির্ভরতার বীজ বপন করে দিন। এটা করতে গিয়ে তাড়াহুড়ো বা বাড়াবাড়ি করবেন না। গর্ভধারণের পর প্রসব হতে মানব সন্তানের যেমন ৪০ সপ্তাহ সময় লাগে, তেমনি তাকে প্রস্তুত করতে সময় নিন। আপনার মাতৃত্বের যাত্রা কল্যানময় হোক।
তথ্যসূত্র
লেখাটি রিভিউ করেছেন –
ডাঃ সাবরিনা আফরোজ
MBBS, MPH
লেকচারার, ঢাকা কমিউনিটি মেডিসিন কলেজ
সম্পাদনায়: হাবিবা মুবাশ্বেরা
ছবি কৃতজ্ঞতা: People vector created by freepik