আমার অনেক ইচ্ছা ছিল যদি আল্লাহ চান এবং সবকিছু ঠিক থাকে,তাহলে আমার মেয়ে হওয়ার গল্প সবার সাথে শেয়ার করব। এতে যদি কিছু বোনের উপকার হয়। আমি নিজে আমার গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন বোনদের শেয়ার করা সন্তান প্রসবের ঘটনা নিয়মিত পড়েছি এবং আমার জন্য তা অনেক উপকারী ছিল, আলহামদুলিল্লাহ। আমি এত গুছিয়ে লিখতে পারি না। তাও চেষ্টা করব যতটা সম্ভব বিস্তারিত লিখার।
আমার গর্ভধারণের পুরোটা সময়ে আল্লাহর রহমত ছিল, আলহামদুলিল্লাহ। এত শান্তিতে গর্ভাবস্থা কেউ পার করেছে আমি দেখিনি পরিচিত কাউকে। সন্তান ধারণের পর থেকে গর্ভধারণের কোনরকম কোন উপসর্গ ছিল না আমার মাঝে।। এর জন্য আমার নিজেরই বিশ্বাস করতে একটু সময় লেগেছে যে আমি গর্ভবতী।
আমার মাসিক নিয়মিত ছিল, তাই যখন হচ্ছিলো না এবং গভর্ধারণেরও কোনরকম লক্ষন দেখছিলাম না, তখন ধরেই নিছিলাম অন্য কোনকিছুর জন্য মনে হয় দেরি হচ্ছে। এজন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। আর এর মাঝখানে সিলেট, চাঁদপুর লম্বা ঘুরাঘুরিও করে ফেললাম।
দুই মাসের কিছু আগে টেস্ট করালাম। আলহামদুলিল্লাহ ইতিবাচক ফলাফল আসলো। আরো নিশ্চিত হতে ১২তম সপ্তাহে আল্ট্রাসাউন্ড করলাম এবং প্রথমবারের মত আমার ফাতিমাকে দেখলাম। অনেক অদ্ভুত অনুভুতি। একটা অতি ছোট মানুষ নড়াচড়া করছ! আলহামদুলিল্লাহ।
এরপর একদম ডেলিভারি পর্যন্ত তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। শুধু বেশি হাঁটাহাটি করলে পায়ে পানি চলে আসতো সাত মাসের পরে। আমি পাঁচ মাসের দিকে কোলকাতা থেকেও ঘুরে এসেছি। আমার প্রেগন্যান্সি থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে, যদি সবকিছু স্বাভাবিক থাকে, তাহলে প্রেগন্যান্সিতে স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত। একজন মা যেভাবে স্বচ্ছন্দ বোধ করে, তাকে সেভাবে থাকতে দেওয়া উচিত। মা মানসিকভাবে প্রশান্তিতে থাকলে তা মা এবং বাচ্চা দুইজনের জন্যই ভালো।
একটা লেখায় পড়েছিলাম, “প্রেগন্যান্সি কোন রোগ না, এটি একটি স্বাভাবিক শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া।”- এই কথাটা আমার গর্ভাবস্থায় আমার জন্য অনেক সত্যি ছিল। আমাদের এখানে দেখা যায় কেউ গর্ভধারণ করলে চারপাশ থেকে মানুষজন নেক নিয়তেই উপদেশের ঝুড়ি নিয়ে বসে যায়। এটা করা যাবেনা, এভাবে চলা যাবেনা- এরকম নানান উপদেশে মাকে মোটামুটি রোগী বানিয়ে ফেলে। যা একজন মাকে, বিশেষত যারা নতুন মা হতে যাচ্ছে তাদেরকে, ভীতিকর অবস্থায় ফেলে দেয়। আলহামদুলিল্লাহ, আমাকে এধরণের অবস্থায় পরতে হয়নি। এজন্য প্রেগন্যান্সির সময়টা আমার জন্য অনেক আনন্দের ছিল।
স্বাভাবিক প্রসবের জন্য প্রথম থেকেই আল্লাহর কাছে দুয়া করছি এবং এই নিয়ে বিভিন্ন ভিডিও দেখেছি। এসব ভিডিও দেখা বেশ উপকারী ছিল। আমাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে সাহায্য করছে। নরমাল ডেলিভারির জন্য শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকার কথা বলে সবাই। কিন্তু আমার প্রেগন্যান্সির পুরোটাই শুয়ে-বসে কাটানো লেগেছে। কারণ বাসায় কাজ করার কোন দরকার হতো না এবং বাইরেও তেমন যাওয়া হত না। ৩২ সপ্তাহে চেকআপে গেলাম। ডাক্তার দেখে বললো সব ঠিক আছে কিন্তু বাচ্চার পজিশন ব্রিচ। ৩৬ সপ্তাহে আবার আল্ট্রাসাউন্ড করে দেখা করতে বললো। ব্রিচ শুনে আমি চিন্তায় পরে গেলাম। অনেকে বললো এটা কোনো সমস্যা না। শেষের দিকে পজিশন ঠিক হয়ে যায়।
৩২ সপ্তাহ থেকে শুরু হল আমার ডেলিভারির জন্য প্রস্তুতি। নিয়মিত না হলেও সপ্তাহে ৩/৪ দিন টানা ১ ঘন্টা হাঁটার চেষ্টা করেছি। লো কমোডে বসার মত স্কোয়াট ব্যায়াম করতাম। অন্য ব্যায়াম করতে পারতাম না। করলেই মাংশপেশীতে টান পড়ত। তারপরে ৩/৪ দিন নড়াচড়া করতে পারতাম না। শেষের দিকে হাঁটা আর খেজুর খাওয়া ছাড়া আর কোনকিছুই নিয়মিত করি নাই।
৩৬ সপ্তাহের শেষ দিন আল্ট্রাসাউন্ড করলাম। আলহামদুলিল্লাহ পজিশন সেফালিক আসলো। আমি রাত্রে ৯টায় খাবার খাওয়া শেষ করে সিএনজি করে বাবার বাসা থেকে নিজের বাসার জন্য রওনা দিলাম। এক ঘন্টা জ্যামে বসে থেকে বাসায় পৌছালাম। রাত ১১টা থেকে পা ব্যাথা করা শুরু হলো। এত ব্যাথা হচ্ছিল যে বসে নামাজ পড়লাম। এরপর ঘুমানোর জন্য চেষ্টা করি, দেখি ব্যাথা কিছুতেই কমে না। ব্যাকপেইনও শুরু হলো। প্রসব বেদনার ব্যাপারে যত পড়াশুনা করেছি, কোথাও পায়ে ব্যাথার কথা পাইনি। এর কিছুদিন আগে মাসল ক্র্যাম্প হয়েছিল পায়ে। মনে করলাম ওটারই ব্যাথা হবে। একবারের জন্যও মনে হয়নি আমার লেবার পেইন শুরু হয়েছে। ১২টার দিকে আমার স্বামী ডাক্তারকে ফোনে আমার অবস্থা জানালেন। উনি সাথে সাথে আমাকে হসপিটালে ভর্তি হতে বললেন। এখনও তিন সপ্তাহ বাকি আর আমার সামান্য পায়ে ব্যাথার জন্য এত রাতে হসপিটালে যেতে বলায় বেশ অবাক হলাম। পরিচিত সবাই বারবার বলছে নির্ধারিত দিনের আগে কারোরই বেদনা উঠেনা। যাই হোক, আমার স্বামী কোনোভাবেই আমার না শুনলেন না। একরকম জোর করেই আমাকে ১ঃ৩০ টার দিকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার পরে আমার সিটিজি, পিভি চেক করা হলো। আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো আমার সারভিক্স ৩ সে.মি ডায়ালেটেড। এবং আমার কনট্রাকশনও বেশি। প্রসব বেদনা নিয়ে যেমন ভয় ছিল ওইরকম কিছুই লাগল না। এমনকি হাসাপাতালে যাওয়ার পরে পায়ের ব্যাথাও কমে গেলো। ডাক্তার জানালো বাচ্চা পরের দিন সকাল নাগাদ বের হতে পারে। যেহেতু আমি প্রাইমি, সময় বেশি লাগবে। আমাকে ঘুমানোর জন্য ওয়ার্ডে শিফট করে দিল। সকাল ৭ টায় আরেকবার পিভি চেক করে দেখল। ৪ সে.মি ডায়ালেটেড। ডায়ালেশন ধীরে ধীরে হচ্ছে দেখে আমি যাতে ক্লান্ত হয়ে না যাই শেষ পর্যন্ত এজন্য প্যাথেডিন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হলো। এরপর ১১ঃ৩০টায় আবার পিভি চেক করে দেখল, তখন ৬ সে.মি. ওপেন এবং বাচ্চাও অনেকখানি নিচে চলে আসছে। তখন পর্যন্ত সেরকম ব্যাথা লাগছিল না। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ অনেক সহজ করে দিয়েছিলেন সবকিছু। ডাক্তার তখন পিটোন শুরু করতে বললেন এবং পানি ভেংগে দিলেন। কী যে বিচ্ছিরি লাগে এসময়। রক্ত, গরম পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। আর পিটোন দেওয়ার পর থেকেই ব্যাথা বাড়তে থাকল। সত্যিকারের প্রসব বেদনার স্বাদ পেতে শুরু করলাম। আল্লাহ সব মাকে মাফ করে দিন। কী ভয়াবহ ব্যাথা একজন মাকে সহ্য করতে হয়!
ব্যাথা অসহ্য হতে শুরু করলে ব্রিদিং এক্সারসাইজ করতে থাকলাম। এটা করার সময় ব্যাথা অনেকখানি সহনীয় লাগছিল। কিন্ত ব্যাথার তীব্রতা যখন আরও বাড়তে লাগলো, তখন আর কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। চেষ্টা করেছি নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখতে আর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে থাকলাম। প্রায় এক, দেড় ঘন্টা পর থেকে পুশ করার অনুভূতি আসতে লাগল। যেই বেডটাতে আমাকে রাখা হয়েছিল, তা মোটেও নরমাল ডেলিভারির জন্যে সুবিধাজনক ছিল না। আমি পুশ দেওয়ার জন্য কোন কিছুর সাপোর্ট পাচ্ছিলাম না। এজন্য ঠিকমত প্রেশার দিতে পারছিলাম না। পা ধরে কিভাবে পুশ করতে হবে দেখিয়ে দেয়ার পর ওভাবে দিতে থাকলাম। কিন্তু এত ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে একেকটা কনট্রাকশনের বিরতিতে ঘুম চলে আসত। কনট্রাকশন আসলে পুশ করতাম তারপর আবার ঘুমিয়ে যেতাম।
বাচ্চার মাথা একদমই নিচে চলে আসলে ডাক্তার এপিসওটমি করে দিল। বলল যে জোরে টানা পুশ করতে এবং আরও দেরি হলে বেবির মাথা লম্বা হয়ে যাবে। এটা শুনার পর সব শক্তি দিয়ে পুশ করতেই থাকলাম। তারপর দুপুর ১ঃ৩০ টার দিকে ৩.৫ কেজি ওজনের বাচ্চা বের হয়ে আসল, আলহামদুলিল্লাহ। সাথে সাথে এতক্ষণের অসহ্য ব্যাথা গায়েব হয়ে গেল। যদিও পেইন একদমই বন্ধ হয়ে যায় না। প্লাসেন্টা ডেলিভারিতে আরেক দফা ব্যাথা পেয়েছি। তবে এটা তেমন কষ্টকর ছিলো না। তারপর সেলাই করা হলো।
চামড়ার উপর সেলাইগুলোতে ব্যাথা পেয়েছিলাম। ৬টা সেলাই লেগেছিলো। আর এইভাবে শেষ হয়েছে আমার প্রায় ১৫ ঘন্টার লেবার পেইন, আলহামদুলিল্লাহ। আমার ডেলিভারির পরে অনেক সমস্যা হয়েছিল। অনেক বেশি ব্লিডিং, তলপেটে প্রচন্ড ব্যাথা, শরীরে কাঁপুনি আসা, সেলাইয়ের জায়গায় ইনফেকশন, শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়া। এজন্য প্রেগন্যান্সির সময়ের থেকেও প্রসবের পরে সাবধানে থাকাটা বেশি জরুরি। একজন মায়ের শরীর অনেক বেশি নাজুক থাকে। স্বাভাবিক প্রসব হলেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে এটা চিন্তা করা ভুল। সি-সেক বা নরমাল যেটাই হোক না কেন দুই ক্ষেত্রেই মায়ের নিজের যত্ন নেয়া এবং সাবধানে থাকাটা জরুরি।
কিছু পরামর্শ:
১. যতটা সম্ভব টেনশনমুক্ত এবং হাসিখুশি থাকা। সাথে সাথে পড়াশুনা এবং জানার মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করা। যা নিজের এবং বাচ্চার জন্য উত্তম হয়, তার জন্য আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দুআ করা।
২. নিয়মিত হাঁটাহাটি এবং সহবাস – এই দুইটা বিষয় স্বাভাবিক প্রসবে অনেক উপকারী।
৩. লেবার পেইনের সময় যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখা। এতে ব্যাথা অনেকটাই সহনীয় থাকে। ব্যাথা সহ্য করার অনেকরকম কৌশল আছে, তা আয়ত্ত্ব করা।
৪. প্রসবের পরেও নিজের ব্যাপারে যত্নশীল থাকা।
(লিখেছেনঃ উম্ম ফাতিমা)
[প্রসব পরবর্তী যত্ন নিয়ে পড়তে পারেন আর্টিকেল আসুন জানি প্রসব পরবর্তী যত্ন নিয়ে – মাতৃত্ব)]