বাচ্চা পালনে একঘেয়েমি? সমাধানের সুরাহা যখন আপনার মধ্যেই...

বাচ্চা লালনপালন, বাচ্চার জন্য রাত জাগা, কোনরকমে খাবার গেলা, দুই মিনিটে গোসল করা, বাচ্চাকে চব্বিশ ঘণ্টা দেখাশোনা করা….
নিঃসন্দেহে একজন মায়ের জন্য কঠিন কাজ।
দিনের পর দিন, রাতের পর রাত নিজের দিকে না তাকিয়ে বাচ্চাকে বড় করে তোলা। মোটেই সহজ কাজ নয়।

অনেক সময় ক্লান্তি, বিষণ্ণতা ভর করে সেই মায়ের মনে। মনে হয় দূরে কোথাও পালাই। কিছুটা সময় নিজের মতো কাটাই। ভাবেন কেউ আমার কষ্ট গুলো, রাত জাগা গুলো, আমার একঘেয়েমি জীবনটাকে অনুভব করুক।
কিন্তু বাস্তবে তার ভিন্ন প্রতিফলন দেখা যায়।
একজন মায়ের যে কষ্ট হচ্ছে, কখনও কখনও শরী-মন কোনটাই কুলাচ্ছে না। এটা যেন তার পাশের মানুষ গুলো বুঝতেই চায় না।
তখন বিষণ্নতা গুলো আরও বেশি গ্রাস করে।
সত্যি বলতে একজন মায়ের জন্য সাপোর্ট প্রয়োজন। তার পরিবার, তার কাছের মানুষের সাপোর্ট।
কারণ একজন মাকে প্র‍্যাগ্নেন্সির শুরু থেকে বাচ্চা বড় করা অব্দি নানা ধরনের শারীরিক, মানসিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। হটাৎ করে একজন মা আবিষ্কার করেন তার জীবনের ছক পালটে গেছে।
পরিবর্তনের ধারায় খাপ খাওয়াতেই একটা লম্বা সময় চলে যায়। সেই পরিবর্তনে কখনও পরিবার, কাছের মানুষ গুলো সঙ্গী হয় তো কখনও সেই মায়ের পথচলাটা একরকম একারই হয়ে থাকে।

তবে পরিবারের সদস্যদের সাপোর্টের পাশাপাশি কিছু জিনিস অনুসরণ করা তাই ভীষণ প্রয়োজন একজন মায়ের জন্য।
প্রথমতই,

👉 সেলফ মোটিভেশন

নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়া, নিজেকে নিজের হয়েই কাউন্সিলং করা। আপনার পাশে সারাক্ষণ কেউ থাকবে না। সবসময় আপনার শরীর, মনের পরিস্থিতি অন্য কেউ বুঝবে না। অন্য কারও সাপোর্ট সাময়িক।
কিন্তু আপনার নিজের জন্য নিজের সাপোর্ট সর্বক্ষণের।
নিজেকে তাই পজিটিভ চিন্তা, পজিটিভ কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখুন। কিছু পজিটিভ মানুষের সান্নিধ্যে থাকার চেষ্টা করুন।
অনেকটাই ভালো লাগবে।

👉 বাচ্চার সান্নিধ্য উপভোগ

ধরুন আপনি জানেন প্রচন্ড গরমে দুপুরের রান্নাটা আপনাকেই করতে হবে। সেই সময় আপনি যখন ভাববেন কাজটা অনেক কঠিন। দেখবেন কাজটা দ্বিগুন কঠিন। কারণ নেগেটিভিটি।
আপনার বাচ্চা পালনটাও অনেকটা সেরকম। আপনি যখন বাচ্চা লালন পালন, বাচ্চার ছুটাছুটি, দুষ্টুমি, বাচ্চার অকারণ বকবক আনন্দের সাথে নিতে শিখে যাবেন। তখন দেখবেন কঠিন এই কাজের মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন। আর যেখানে আনন্দ থাকে সেখানে ভালবাসা থাকে। আর যেখানে ভালবাসা, আনন্দ এক হয়ে মিশে যায় সেখানে কষ্ট, একঘেয়েমি অনেকটাই নাই হয়ে যায়।

তাই বাচ্চার সান্নিধ্য, বাচ্চার হাসিমুখ, তার দুষ্টমি, তার খেলাধুলা, হাড়ি-পাতিল, পেয়াজ-রসুন এমনকি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা ঘরটার দিকেও ভালবাসা নিয়ে তাকান।
ভাবুন, একটা সময় আমার বাচ্চাটা বড় হয়ে যাবে। তখন আমি চাইলেও আর এসব এঞ্জয় করতে পারব না।

👉 ধৈর্য্য এবং সবর

অনেকেই এই জায়গাটায় এসে খেই হারিয়ে ফেলেন। ধরুন, আপনি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছেন। বাচ্চা এসে আপনার কাজের তেরোটা বাজিয়ে গেল।
আপনার ফোন থেকে এমন কাউকে কল দিয়ে বসল অথবা মেসেজ পাঠিয়ে দিল যে আপনি রীতিমতো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেলেন।
আপনার গুছানো ঘর, বিছানা মুহূর্তেই উলট পালট করে দিল।
আপনার পছন্দের বইটা পড়তে দিল না।
আপনি ফোনটা ধরার সাথে সাথেই আপনার হাত থেকে সেটা সরিয়ে দিল।
ইত্যাদি নানা অকাজ করে বসল।
দেখা গেল আপনার সুস্থ, সুন্দর মুডটা মুহুর্তেই নষ্ট হয়ে গেল।

কিন্তু একটা জিনিস ভেবে দেখুন। এইযে আপনার বাচ্চা যেই কাজ নামের অকাজ গুলো করল। একজন বাচ্চা হিসেবে তার জন্য এটা করাই স্বাভাবিক।
সে যখন কারও ফোনে কল দিয়ে বসে সে কিন্তু এই কাজটা বুঝে করে না।
সে শুধু এইটুকু বুঝে আপনার সময় গুলো কেবল তারই জন্য।
সে আপনার কাছে সময় চায়। চায় আপনার মনযোগ।
একজন পিতা-মাতার এই ক্ষেত্রে ধৈর্য্য এবং সবর অত্যন্ত প্রয়োজন।
বাচ্চা নিয়ে অনেক সময় অনেক প্রয়োজনীয় কাজ করতে আপনার কষ্ট হবে। আর সেটা সবর নিয়ে আপনাকেই সামলাতে হবে। কারণ দিনশেষে আপনার জীবনটা তাকে ঘিরেই।
বাচ্চা কাউকে ফোন দিয়ে বসল। আপনি তাকে বুঝিয়ে বলুন। একজন বিবেকবান মানুষ অবশ্যই এই জিনিসটা বুঝবে।

👉 বাচ্চাকে সময় দেওয়া

আমরা অনেকেই মনে করি বাচ্চাকে সময় দেয়া মানেই বাচ্চার পাশে থাকা। এখন সেই পাশে থাকার মানে যদি হয় আপনি আপনার কাজে ব্যস্ত। অথবা আপনার হাতে একটা ডিভাইস। আপনি সেই ডিভাইসে বুদ হয়ে আছেন।
এইদিকে আপনার বাচ্চা আপনাকে কি বলছে আপনি শুনতেই পাচ্ছেন না।
এটা কখনোই বাচ্চাকে সময় দেয়া হতে পারে না।
আপনি যখন বাচ্চার জন্য আলাদা করে দশ, পনের, বিশ মিনিট সময় দিবেন তখন সেটা কেবল তার জন্যই রাখুন।
বাচ্চাকে সময় দেয়ার আরেকটা বড় ব্যাপার হচ্ছে এটা নিজেকেই একরকম সময় দেয়া।
এই যে আপনি তার সাথে কথা বলছেন, তার গল্প শুনছেন, তার সাথে বেড়াতে গেলেন। এটা বাচ্চার সাথে সাথে নিজের জন্যও একটা রিফ্রেশমেন্ট।
যদি আপনি সেটা উপভোগ করতে পারেন।

👉 বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরতে শিখুন

নিজের ব্যক্তিগত জীবনের রাগ কষ্ট বাচ্চার উপর প্রকাশ করবেন না। বরং যখন হতাশা, কষ্ট নিজেকে ঘিরে ধরে তখন আলতো করে বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরুন।
জানেন তো বাচ্চার শরীরে জান্নাতের গন্ধ থাকে।

👉 সন্তান, শ্রেষ্ঠ আপনজন

ধরুন আপনার দু চোখ চাপিয়ে কান্না এসেছে। আপনি দেখবেন আপনার ছোট্ট, অবুঝ বাচ্চাটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তার চোখ, মুখ মূহুর্তেই বিষণ্ণ হয়ে গেছে। তার মানে আপনার কষ্ট আপনার সন্তানকেও কষ্ট দেয়।
বাবা-মা হিসেবে আপনার সন্তানের সুখটা যেমন আপনার কাছে সবচেয়ে দামি। ঠিক তেমনি আপনার সন্তানের কাছেও আপনার সুখটা সবচেয়ে দামি।
পার্থক্য হচ্ছে বাচ্চা সেটা বুঝিয়ে বলতে পারে না। কিন্তু আপনি পারেন।

আপনার মন খারাপের সময় আপনাকে কিন্তু সেই জড়িয়ে ধরে। আপনার কপালে আলতো চুমুর স্পর্শটা আপনার সন্তানের মতো করে কেউ দিতে পারে না।
দুনিয়ায় এই যে এত বড়, এত একনিষ্ঠ আপনজন আপনার রব আপনাকে দিল। আপনি কি এটা নিয়ে সন্তুষ্ট হবেন না?
শুকরিয়া আদায় করবেন না?

এই পৃথিবীতে অনেক বাবা-মা আছেন যারা একটা বাচ্চার জন্য প্রতিনিয়ত হাহাকার করছেন।
হতে পারতেন আপনিও তাদের একজন।
আপনার কোল আলো করে যে আপনার দুনিয়াটা রাঙিয়ে দিল সে আপনার সন্তান।
তার আধো আধো বুল,
তার কলকল সোরগোল,
তার হাসির রোল,
আপনার একঘেয়েমি জীবনে সেই তো আপনার সুখের গল্প। একান্ত নিজের বলে আপনার যদি কিছু থেকেই থাকে সে আপনার সন্তান।
সমস্ত কষ্ট, একঘেয়েমির মাঝে দাঁড়িয়েও তাই নিজেকে পজিটিভ রাখুন।

সর্বশেষ হালনাগাদ করা হয়েছেঃ আগস্ট ২০, ২০২৫