নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে আমি এখন এক কন্যা সন্তানের মা, আলহামদুলিল্লাহ্। আমার বাবু হওয়ার পর ডেলিভারি নরমাল হয়েছে শুনে সবাই অবাক হয়েছে! এই অভিজ্ঞতাটাই আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করব।
একটু শুরু থেকে বলি। বাচ্চা হওয়া ব্যপারটাই আমার অনেক কষ্ট লাগত যেহেতু আমি পরিশ্রম করতে চাই না। কিন্তু বিয়ের পর ভাবলাম যে আল্লাহর বিধান, মানতেই হবে। সেই সুবাদে আর দশটা সাধারণ নারীর মতো আমি পিল খাইনি, চিনিও না! এ কথা বললাম কেননা আমার ধারণা পিলের নেগেটিভ ইফেক্টের কারণে সিজারের সংখ্যা অথবা নানান জটিলতা বেড়ে গিয়েছে। বিয়ের দুই বছর পর আমি কনসিভ করি যা নিশ্চিত হই দুই মাস দশ দিন পর। এর মাঝে অনেক দৌড় ঝাঁপ হয়েছে। সুতরাং সামান্য ব্লিডিং হতে লাগল। ডাক্তার সম্পূর্ণ বেডরেস্ট দিল, সাথে ওষুধ।
কিছুদিন বেডরেস্ট নিতেই চাকরির ডাক আসল। বাধ্য হয়ে জয়েন করলাম, কোনভাবেই সেটা বিলম্বিত করা যাবে না তাই। এর মাঝে ওষুধ খেয়ে আল্লাহর ইচ্ছায় ব্লিডিং বন্ধ হোল। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যেহেতু আমি বিভিন্ন জায়গায় স্থানান্তর হয়েছি তাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় ডাক্তার দেখাতাম। এর মধ্যে তিনবার মাত্র এক জায়গাতে যাওয়া হয়েছিল তা হোল মোহাম্মদপুর মেটারনিটি হসপিটাল। ওরা আমার EDD দিয়েছিল ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬।
অফিসে গিয়ে দুইজন মেয়ে কলিগ পেয়েছি যাদের দুইজনেরই সিজার হয়েছিল, যদিও দুইজনই নরমালের জন্য চেষ্টা করেছিলেন। উনারা অফিস থেকে EDD-এর আগের দিন ছুটি নিয়েছিলেন। ব্যাংকিং জবে কাজের চাপ তুলনামূলকভাবে বেশি। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এক মাস আগে ছুটি নিব, পরে ছুটি পাই বা না পাই। আর ইচ্ছে ছিল জব করবো না, তাই আরও দৃঢ় মনোভাব ছিলাম। ১ মাস আগেই ছুটি নিলাম আলহামদুলিল্লাহ্। ঘরে থেকে খাওয়া, রেস্ট আর ঘরের কাজ করতাম সহজেই। ক্লান্ত লাগলে কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিতাম। কেন যেন total bedrest আমার কাছে কার্যকর মনে হতো না। ফরয সালাতগুলো দাঁড়িয়েই আদায় করতাম। আমি প্রেগন্যন্সী নিয়ে বেশি পড়াশোনা করিনি। সিদ্দিকা কবীরের একটা বই পড়েছিলাম মাত্র। আমার বাবা-মা বলেছিলেন যেন প্রতিদিন সকালে টানা আধা ঘণ্টা হাঁটাহাটি করি। তাই করতাম। ক্লান্ত হয়ে যেতাম তাই দশ মিনিট পর পর একটু ব্রেক নিতাম।
নতুন জায়গায় এসেছিলাম তাই ১০/১১ ফেব্রুয়ারি ইসলামি ব্যাংক এর একজন গাইনি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। উনি আমাকে চেকআপ করে প্রথমেই বললেন যে বেবি আমার ওজন আর উচ্চতার তুলনায় বেশ বড়; সিজার করা লাগবে। এমনকি উনি এটাও বললেন না যে নরমাল ডেলিভারির জন্য চেষ্টা করবেন! উনার চেম্বার থেকে বের হয়ে আমি বিরক্ত হলাম।
এমনিতে ছোটবেলা থেকেই আমি ব্যথা কাতর স্বভাবের মেয়ে। এর মাঝে মোহাম্মদপুরে মেটারনিটিতে একদিন ডাক্তারের অপেক্ষায় লেবার রুমে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেখানে পর্দার আড়ালে সেই সময় একজনের নরমাল ডেলিভারি হচ্ছিল। সেই মেয়েটার চিৎকার শুনে আমি আরও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, মনে হয়েছিল দৌড়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসি। আমার বেবি নিয়ে আমি কী করব, কিভাবে হবে, আমার আরও একটু বড় আকৃতির হওয়া দরকার ছিল ইত্যাদি নানা কথা মনে এসেছিল! সেই আমিই কিন্তু চাইছিলাম যে বেবি নরমাল ডেলিভারিতেই হোক। কেননা আমার অগাধ বিশ্বাস ছিল যে প্রাকৃতিক/স্বাভাবিক যেটা সেটাই উত্তম। এ ব্যপারে আমার মা আমাকে সাহস দিতেন আলহামদুলিল্লাহ্।
ওই ডাক্তারের কাছে আর যাইনি। ২০ তারিখ সকালে আমার পানি আসতে লাগল ব্লাডের সাথে। মাকে জানালে মা ঢাকায় আসলেন। বাসার সামনেই মেরি স্টোপসে দেখালাম। তারা জিজ্ঞেস করাতে বললাম যে ব্যথা অত তীব্র না তবে কিছুক্ষণ পর পর হচ্ছে। এমনিতে এক সপ্তাহ থেকেই আমার সামান্য ব্যথা অনুভব হচ্ছিল। মেরি স্টোপসের ডাক্তার বললেন সব ঠিক আছে, নরমাল ডেলিভারি হবে। বাসা কাছে থাকলে চলে যান, গিয়ে হাঁটাহাঁটি করবেন। তাই করলাম। কিন্তু যত সময় যাচ্ছিল ব্যথাও তত তীব্র হচ্ছিল। ঘুমাতে যাওয়ার আয়োজন করেও রাত ১টায় হাসপাতালে গেলাম। ২০ ফেব্রুয়ারীর রাত, হাসপাতালে যারা ছিল তারা ভেবেছিল কোন রোগী হয়ত আসবে না। পরের দিন সরকারী ছুটি। আমাকে দেখে তারা বলল যে সিজার করতে হবে পর দিন; সেই একই কারণ দেখালেন যে আমার বেবি বড়। আমার মা তাদের বোঝালেন যে এর চেয়েও ছোট বয়সের, দুর্বল মানুষের নরমাল ডেলিভারি হয়। তারা কনভিন্সড হলেন। যেহেতু শিফট পরিবর্তন হয় তাই রাতের ডাক্তার বিকেলে আমি যে ডাক্তারকে দেখিয়েছিলাম তাকে ফোন দিলেন। উনি বললেন যে নরমাল ডেলিভারি হবে। এরপর উপস্থিত ছিলেন যারা তারা হ্যান্ড চেকআপের মাধ্যমে বললেন যে বেবি হলেও আগামীকাল বিকেলে হবে। এদিকে আমার ব্যথা তীব্রতর হতে থাকে। ব্যথা কমানোর জন্য ইঞ্জেকশন দেয়া হলেও কোন ফল হয়নি। ভোর পাঁচটায় তারা আমাকে লেবার রুমে নিলেন। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল যা দেখে আমার মাও আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলেন আর ভাবছিলেন যে তারা যদি আমাকে দাঁড়িয়ে বা বসে পুশ করতে বলত তাহলে খুব ভালো হতো! কিন্তু আমি ছিলাম শুয়ে, তারাই আমাকে ওভাবে থাকতে বলেছিল। অবশেষে সকাল ৭:১০ এ আমার বাবু হয়। বাবুর ওজন ছিল ৩ কেজি ২০০ গ্রাম। আমার ৩/৪টা সেলাই লেগেছিল।
শেষের দিকে একসময় ব্যথার কষ্টে আমিও বলেছিলাম সিজার করতে কিন্তু ডাক্তার জানিয়েছিলেন যে তখন আর সেটা করার সময় নেই। আশ্চর্য ব্যপার হোল বেবি হওয়ার সাথে সাথে যেন মনে হোল আমার কিছুই হয়নি আলহামদুলিল্লাহ্। এটাই আসলে আল্লাহর উপর ভরসার ফল।
[লিখেছেনঃ আমাতুল্লাহ]