প্রসবের পরে একজন মা আবার পূর্ণ উদ্যমে সাংসারিক কাজে যুক্ত হবেন আবার বাচ্চার যত্ন নিবেন এরকম একটা সাধারণ ভুল ধারণা আমাদের দেশের মায়েদের মাঝে আছে। অথচ প্রসবের পরবর্তী সময়টা গর্ভাবস্থার বাকি তিনটা ট্রাইমেস্টার এর মতোই জটিল এবং সতর্কতার দাবি রাখে। পাশ্চাত্যে এজন্য প্রসব পরবর্তী সময়কে চতুর্থ ট্রাইমেস্টার বলে অভিহিত করা হয়।

প্রসবোত্তর সতর্কতা

দীর্ঘ নয় মাস অপেক্ষার পরে যখন আপনার সন্তান আপনার কোলে আসে, সেই রোমাঞ্চকর সময় অন্য কোন অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়না। এই রোমাঞ্চের পাশাপাশি আপনার মাঝে কিছুটা ভয় কাজ করা স্বাভাবিক। সন্তানের যত্নে কোনরকম ত্রুটি হয়ে যায় কী না, সেই চিন্তায় আপনি উদ্বিগ্ন হতে পারেন। নিজের হারিয়ে ফেলা সময়, স্বাস্থ্য সবকিছুর জন্য কিছুটা আফসোস ও হয়তো আপনার মাঝে কাজ করতে পারে। এই আফসোস, রোমাঞ্চ মিলিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিজের ও সন্তানের জন্য একটি সুন্দর শুরু করতে পারাটাই সফলতা।

যদি সিজার হয় তাহলে প্রথম কয়েকদিন বেশ ব্যাথা থাকতে পারে। আপনার ডাক্তার আপনাকে নানারকম সতর্কতা বলে দিবেন যেগুলো আপনাকে ব্যাথা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করবে। কিন্তু যদি প্রাকৃতিক প্রসব হয় তাহলে প্রসবের পরপরই আপনি সুস্থ্যবোধ করতে শুরু করবেন। তবে, সন্তানের পরিচর্যার জন্য আপনাকে নিজের প্রতিও যত্নশীল হতে হবে।  

সম্ভাব্য পরিবর্তন

প্রসবের সময় মায়েদের শরীরের হরমোনগুলো সুর তুলে, একযোগে কাজ করে।  অক্সিটোসিন নামক হরমোন যার নেতৃত্ব দেয়। প্রচুর হরমোন কাজ করে বলে মায়ের মাঝে নানারকম আবেগীয় পরিবর্তন দেখা দেয়, বিশেষ করে যারা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম নন। পাশাপাশি প্রসবের ধকলটা শরীরের ওপর দিয়ে যায় বলে শারীরিক নানারকম পরিবর্তনও আসতে পারে। 

আবেগীয় পরিবর্তন

  • পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন; সন্তানের প্রতি অনীহা কাজ করা বা অতিরিক্ত আকর্ষণ অনুভব করা, সন্তানকে মেরে ফেলতে চাওয়া বা অকারণেই খুব ভয়ে থাকা। 
  • বেবি ব্লু; অতিরিক্ত হতাশায় ভুগতে থাকা, দৈনন্দিন কাজের প্রতি অনীহা চলে আসা ইত্যাদি।

শারীরিক পরিবর্তন

  • জরায়ু তার আগের জায়গায় ফিরে আসার সময় প্রসবের পরেও প্রসবের মতোই ব্যথা দেখা দিতে পারে,
  • স্তনে ব্যাথা হতে পারে,
  • অশ্ব বা পাইলস দেখা দিতে পারে, 
  • হরমোনের অতি উপস্থিতিতে শরীরে শীত বা গরমবোধ একটু পরপর পরিবর্তন হতে পারে। 
  • নিফাসের রক্ত (পোষ্টপার্টেম হেমোরেজ) যাবে, প্রসব পরবর্তী শরীরের ওজন কমে যাবে।

সন্তানের যত্ন নিতে

নবজাতকেরা পেটের বহিরে মায়ের পেটের মতো পরিবেশ খোঁজে। তাদেরকে এই অপরিচিত পৃথিবীতে পুরোপুরি পেটের অনুভূতি দেয়া সম্ভব না। তবে, আশেপাশের পরিবেশ উপযোগী করে তাদের জন্য কিছুটা আরামদায়ক অবস্থান তৈরি করা সম্ভব।

  • নতুন নতুন পৃথিবীতে আসার পর প্রায় ২ বছর যাবৎ শিশুরা নিজেদেরকে অনুধাবন করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে, নিজেদের ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা বুঝার চেষ্টা করে। 
  • অনেক বাচ্চার ঘুম কম হয়। অনেকের দিনে ঘুমিয়ে রাতে জাগার প্রবণতা থাকে।  এটা দূর করার জন্য, দিন ও রাত আলো ও শব্দের মাধ্যমে বুঝিয়ে, একটা রুটিন গড়ে তুলার চেষ্টা করতে হবে।
  • নবজাতক কে তোয়ালে বা নরম কাঁথা দিয়ে এমন ভাবে প্যাঁচিয়ে রাখা যায়, যেন তাদের হাত শরীরের সাথে মিশে থাকে। যাকে সোয়াডলিং বলে।
  • পেট সহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গকে হালকা হাতে তেল দিয়ে ম্যাসাজ করতে হবে। এতে শিশুরা খানিকটা আরাম পায়। 
  • কিছু সময়ের জন্য শিশুর ত্বককে নিজের ত্বকের সাথে মিশিয়ে রাখুন (স্কিন টু স্কিন), এতে বাচ্চা নিরাপদ বোধ করে। বাবারাও এটি করতে পারবেন। 

নিজের পরিচর্যায়

আপনার থেকেই শুরু হবে সন্তানের যত্ন, পরিবারের খুঁটি যেহেতু আপনি, আপনার নিজের ঠিক থাকাটাই সবথেকে বেশি জরুরি। আপনার শারীরিক পুষ্টি, মানসিক সুস্থ্যতা, আপনার ভালো থাকা থেকেই শুরু হবে পরিবারের সুস্থতা। নিজের সুস্থতার যাত্রায়-

  • প্রথমে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত রাখুন, তারপর স্বামীর সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখুন। সর্বোপরি প্রোডাক্টিভ থাকার চেষ্টা করুন।  
  • প্রচুর পানি খাওয়া, অন্তত ৩-৪ লিটার। বিশেষ করে বাচ্চাকে যখন বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, শরীরে পানির ঘাটতি তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এজন্য যখনই বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে নিবেন, তখন নিজে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিবেন। 
  • তাজা ও ঋতুভিত্তিক দেশি ফল, বাদাম অথবা সবজির বীজ খেলে শরীরের অনেক মিনারেলসের ঘাটতি পূরণ হয়ে যাবে।
  • পিনাট বাটার দিয়ে ক্র‌্যাকার বিস্কুট, দই,  বিভিন্ন বাদাম, কিশমিশ, সীডস স্ন্যাক্স হিসেবে খেতে পারেন। 
  • দুধ এবং ফল খেয়ে শরীরে প্রোটিন সরবরাহ করতে পারেন। দুধ বা ফল সরাসরি খেতে ভালো না লাগলে শেইক বা স্মুদি বানিয়ে, ফ্রুট ব্রেড বা কেক বানিয়ে খেতে পারেন। লো ফ্যাট দই বা টকদইও ফল দিয়ে খাওয়া যায়। এছাড়া রাইস কেক, মাফিন খেতে পারেন।   
  • ব্যায়ামের ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে। 
  • প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুম আপনাকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে। কিন্তু পোস্টপার্টামে অনেক মায়েরা সর্বসাকুল্যে ৪-৫ ঘন্টা ঘুমাতে পারেন। সেজন্য বাচ্চা যখনই ঘুমাবে তখন একটু ঘুমিয়ে নিতে পারেন।

যা করা উচিৎ না

  • চা- কফি কম খাবার চেষ্টা করুন, অন্তত যতক্ষণ না আপনার বুকের দুধের প্রবাহ ঠিক হচ্ছে। 
  • ২ বছরের কমবয়সী বাচ্চারা মধু হজম করতে পারেনা। তাদের মুখে মধু দেয়া উচিৎ না। 
  • সন্তান প্রসবের পর সিঁড়ি বেয়ে চলা বা কোন ভারী বস্তুকে উপরে তোলা থেকে বিরত থাকুন। তবে যদি উপযুক্ত মনে হয়, ডাক্তারের পরামর্শে করতে পারেন। 
  • ডাক্তার যতক্ষণ না বলে ততক্ষণ সাঁতার কাঁটা ও গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকুন (যদি অভ্যাস থাকে)। 
  • সি সেকশনের পর আকস্মিক দৌড় দেয়া, বা অকস্মাৎ নড়াচড়া করা থেকে বিরত থাকুন। সবথেকে ভালো হয় যদি সেফটি বেল্ট পড়েন তাহলে।

প্রচলিত কিছু ভ্রান্তি

পোস্টপার্টামে ভালোমতো যত্ন না নিলে এর প্রভাব সারাজীবনের ওপর পড়তে পারে। আবার যত্ন নেয়ার জন্য খুব কুসংস্কারের আশ্রয় নেয়াও ক্ষতিকর প্রভাব ফেরতে পারে। আমাদের মাঝে পোস্টপার্টাম নিয়ে অনেকরকম ভ্রান্তি কাজ করে। 

  • খাবারের মধ্যে ঝাল খাবার খেলে বাচ্চার পেট খারাপ হবে। বুলজেরিয়ার পিএইচডি ডক্টর দিমিত্রি ম্যারিনভ বলেন, ব্রেস্টফিডিং করানোর সময় মায়ের খাবার শিশুর শরীরে প্রভাব ফেলে না। তবে, ঝাল খাবার দুধের স্বাদে কিছুটা পরিবর্তন আনতে পারে, দুধের ঘনত্বেও প্রভাব ফেলতে পারে। তাই বাবা মায়েদের ঝাল খাবার একেবারে বন্ধ করে দেয়ার কোন আবশ্যকতা নেই। এটা নিয়ন্ত্রণ করলেই যথেষ্ট।
  • বেশি বেশি দুধ খেলে বেশি বেশি দুধ আসবে এমন একটা ভ্রান্তিও আমাদের মাঝে ঘুরে বেড়ায়। দুধ শরীরে ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনের জন্য ভালো হলেও এর মাত্রাতিরিক্ত গ্রহণ ক্ষতির কারণ হবে। 
  • ব্রেস্টফিড করানোর সময় মায়েরা গর্ভবতী হয়ে যেতে পারেন। আমাদের মাঝে অনেকেই মনে করেন ব্রেস্টফীড করানো মায়েরা গর্ভবতী হতে পারেন না। এটা সত্য না। নিফাসের নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলে মায়েদের শরীর আবারো সন্তান ধারণের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।

যখন সাহায্য নিতে হয়

  • সপ্তাহখানেক পরও যদি অনেক বেশি রক্তক্ষরণ হয় অথবা বড় রক্তপিণ্ড যায়; 
  • জ্বরের তীব্রতা বেড়ে গেলে, শরীরের তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের উপর হয়ে গেলে; 
  • যোনিপথের থেকে যদি দূর্গন্ধযুক্ত স্রাব বের হয়;
  • স্তন শক্ত হয়ে থাকলে বা ব্যথা থাকলে;
  • নতুন করে পেটে বা পায়ে তীব্র ব্যথা হলে, বুকে ব্যথা হলে বা কফ জমলে, বমির বেগ হলে;
  • যদি সেলাই থাকে আর সেখানে লাল হয়ে গেলে বা জায়গাটি গরম হয়ে গেলে। অথবা যোনিপথের আশেপাশের জায়গায় লাল হয়ে ফুলে গেলে;
  • যদি সুইসাইডের চিন্তা আসে, অনবরত মুড সুয়িং হতে থাকে, যা নেই তা নিয়েও ভাবতে থাকলে (হ্যালুসিনেশন)। 

কিছু টিপস

  • শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য প্রচুর দুআ করুন। 
  • প্রতিদিন সন্তানের খাওয়া, ঘুম, গোসলের জন্য নির্দিষ্ট একটা সময় ঠিক করে রাখুন এতে বাচ্চাটিও সময় অনুয়াযী কাজ করা শিখবে। 
  • আগে থেকে কাজের পরিকল্পনা গুছিয়ে রাখুন। ঘুমের অভ্যাস হয়ে গেলে, যখন নির্দিষ্ট সময়ে শিশু ঘুমানো শুরু করবে তখন, বা কেউ যদি শিশুকে নিয়ে রাখে কিছুক্ষণের জন্য তখন নিজের কাজ করে ফেলুন।
  • সম্ভব হলে হালকা গরম পানি রোজ গোসল করুন। 
  • ব্রেষ্টফিডিং এর আগে হালকা হাতে ব্রেস্ট মেসেজ করুন। 
  • হাজবেন্ডের সাথে বসে কোয়ালিটি সময় কাটানোর জন্য একটু সময় ঠিক করে রাখুন বা বের করার চেষ্টা করুন। 
  • প্রতিদিন একটা সময় করে সন্তানের সাথে কথাবার্তা বলুন, তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকুন, আপনার সঙ্গীকেও তা করার জন্য উৎসাহিত করুন। 
  • ঘরের কাজ ও রান্নাবান্না কিছুটা সীমিত করে নিন। 
  • অন্য যারা নতুন মা হয়েছে তাদের সাথে যোগাযোগ রাখুন। 
  • বাচ্চাকে দুধ দেয়ার সময়টাতে বই পড়ুন অথবা তিলাওয়াত করুন। সময় কাটানোর জন্য নিজেকে একটু রিলাক্স রাখুন।
  • নিজেকে পজিটিভ রাখার চেষ্টা করুন ও আত্মবিশ্বাসী হোন।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা: আফিফা রায়হানা