ইতিবাচক মনোভাব একটা চর্চিত বিষয়। এই কথার অর্থ হলো মানুষ সাধারণত ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে না বরং চেষ্টা এবং চর্চার মাধ্যমে সে অর্জন করতে পারে। স্বাভাবিক অবস্থার পাশাপাশি গর্ভাবস্থায়ও একজন নারীর জন্য ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখা বেশ জরুরী। কারণ তার মানসিক অবস্থা গর্ভস্থ সন্তানের ভালো থাকার উপর সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু একজন স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় একজন গর্ভবতী নারীর জন্য ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখা দ্বিগুণ কঠিন কারণ এসময় হরমোনগত কারণে একজন নারী যে পরিমাণ মুডসুইং সহ অন্যান্য শারীরিক অস্বস্তির মুখে পড়েন সেগুলো সামলে মনকে সামাল দেয়া নিতান্তই কঠিন। ধর্ম, বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম, বিভিন্ন অনুপ্রেরণা এবং অনুশাসনের মাধ্যমে ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখা এবং চর্চা করায় দারুন উৎসাহ দেয়। একজন মুসলিম নারী জন্য প্রেগনেন্সিতে ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখার প্রেরণা যোগাবে এই লেখা
সাইকোলজির সাথে ধর্মের সম্পৃক্ততা নিয়ে বরাবরই বিভিন্ন গবেষণায় আলোচনা উঠে এসেছে। পজিটিভ সাইকোলজি যদিও একুশ শতকের শুরুর দিকের একটি টার্ম, কিন্তু একটু গভীরভাবে দেখলেই বোঝা যায়, ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস ও জীবনব্যবস্থার সাথে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আজকের লেখায় আমরা দেখবো ইসলামের সাথে পজিটিভ সাইকোলজির সম্পর্ক কোথায় এবং কেমন।
প্রথমে জানা যাক, পজিটিভ সাইকোলজি কি। পজিটিভ সাইকোলজি হচ্ছে সাইকোলজির একটি শাখা যেখানে মানবজীবনের ইতিবাচক শক্তি, গুণাবলি ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অর্থপূর্ণ জীবনযাপনের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। ‘এটি এক ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা যেখানে মানব কর্মক্ষমতার সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে কাজ করা হয়। এর লক্ষ্য হলো ব্যক্তি ও সমাজের সমৃদ্ধিতে সহায়ক গুণগুলো আবিষ্কার করা ও তার প্রসার ঘটানো।’ (Seligman, 2005)
অপরদিকে, ইসলাম হলো একেশ্বরবাদী ধর্ম, যার মূল হলো এক ও একমাত্র স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য । ইসলাম শব্দটির উৎপত্তি سلم থেকে, এই শব্দমূল থেকে তিনটি শব্দ এসেছে, إستسلام বা আত্মসমর্পণ, سلام অর্থাৎ শান্তি ও سلامة যার অর্থ শুদ্ধতা।
ইসলাম এ তিনটি অর্থই বহন করে। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি যখন পরিপূর্ণভাবে সর্বশক্তিমান স্রষ্টার প্রতি আত্মসমর্পণ করে এবং শুদ্ধভাবে তার ইবাদত করে তাহলে সে দুনিয়া ও আখিরাতে শান্তি-সম্প্রীতিতে থাকবে।
সর্বশক্তিমান স্রষ্টার প্রতি আত্মসমর্পণ= পৃথিবীতে শান্তিতে বসবাস
শুধু যে মুসলিমরাই একজন স্রষ্টার প্রতি আত্মসমর্পণ করে তা নয়, বরং প্রত্যেকেই ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয় একজন স্রষ্টার প্রতি বশ্যতা স্বীকার করে। পৃথিবীতে কে কখন জন্মগ্রহণ করবে এ বিষয়ে কি আমাদের হাত আছে? অথবা কেউ চাইলেই কি নিজের ইচ্ছেয় তার অসুস্থতা নিরাময় করে ফেলতে পারে? কিছু রোগের চিকিৎসা আছে, কিছুক্ষেত্রে নেই। আবার কারো কারো শরীরে কোনো চিকিৎসাই কাজ করে না, এ সবকিছুই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী স্রষ্টার হাতে।
“তারা কি আল্লাহর দ্বীনের পরিবর্তে অন্য দ্বীন তালাশ করছে? আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, তাঁরই অনুগত হবে এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাবে।”- (আল কুরআন, ৩:৮৩)
একজন ব্যক্তি যখন তার স্রষ্টার প্রতি আত্মসমর্পণকারী হয়, এর ফলে সে তার জীবনের ছোট থেকে বড় সবকিছুতে তার স্রষ্টা, তার পালনকর্তার প্রতি ভরসা করে। সে জানে, সে এমন এক স্রষ্টার অধীনে আছে যিনি সমস্তকিছুর স্রষ্টা, যিনি তার সব সমস্যার কথা জানেন ও শুনেন। সে জানে, তার জীবনে যা হয়েছে, যা হচ্ছে সবই তার স্রষ্টার সিদ্ধান্ত, এবং এর চেয়ে কল্যাণজনক কিছুই নেই। এভাবে একমাত্র স্রষ্টার প্রতি আত্মসমর্পণ মানসিক প্রশান্তি ও সন্তুষ্টিবোধ তৈরিতে সাহায্য করে।
মুসলিমরা বিশ্বাস করে, তাদের রব সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী। আমরা কখনো কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়ি দেখা যায় যা কিছু আমাদের বাহ্যিক দৃষ্টিতে ভালো মনে হয়েছিলো তার ফলাফল উল্টোটা হয়, আবার একইভাবে যে ঘটনায় আমরা হয়তো অসন্তুষ্ট, অখুশি হই, কখনো কখনো দিনশেষে সেটিই আমাদের জন্যে কল্যাণজনক প্রমাণিত হয়। কুরআনে আল্লাহ তায়া’লা বলেছেন,
“তোমাদের কাছে হয়তো কোন একটা বিষয় পছন্দসই নয়, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তোবা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না।” (আল কুরআন, ২:২১৬)
যখন আমরা মেনে নেই যে আমাদের কার্যক্ষমতা সীমিত, আমরা চাইলেও সবকিছু পারবো না, সবকিছুর জ্ঞান আমাদের নেই , তখন আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত হইনা। আমরা সর্বাবস্থায় কৃতজ্ঞ হই, অন্তত হতাশাগ্রস্ত না হয়ে বিপদে ধৈর্যধারণ করি। মনোবিজ্ঞানী Shearon এবং Sheiner তাদের গবেষণায় এ ধরনের পজিটিভ ইমোশনের কথা বলেছিলেন, “The positive emotions about the past include satisfaction, contentment, fulfillment, pride and serenity” অর্থাৎ অতীতে সংঘটিত বিষয়ে পজিটিভ ইমোশন হলো সন্তুষ্ট, প্রশান্ত, পরিপূর্ণ, গর্বিত ও নির্মল অনুভব করা।
একই গবেষণায় ভবিষ্যত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পজিটিভ ইমোশন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে আস্থা ও বিশ্বাসকে যা সরাসরি মুসলিমদের বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত, একজন মুসলিম বিশ্বাস করে, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র স্রষ্টাই তার রিযিকদাতা, তিনি যেমন মানুষের রিযকের মালিক, তেমন নদীর মাছ থেকে শুরু করে পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ সমস্তকিছুর রিযকের মালিক। কল্পনা করুন, যখন একজন ব্যক্তি জানে তার জন্যে নির্ধারিত রিযক তার অপেক্ষাতেই আছে, সে কতোটা নিরাপদ মনে করে নিজেকে! এ সময়ের অক্লান্ত ‘ইঁদুর দৌড়ে’ তাকে দৌড়াতে হয়না, সে জানে সবকিছুর পরেও সে তার নির্ধারিত অংশই পাবে। তাই সে যেকোনো কাজে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার পর স্রষ্টার প্রতি ভরসা করে এবং অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা থেকে বিরত থাকে।
“আকাশে আছে তোমাদের রিযক আর আছে যার ও‘য়াদা তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে।”- (আল কুরআন, ৫১:২২)
সুতরাং আমরা দেখি যে ইসলামের ব্যাসিক সংজ্ঞাই আমাদেরকে শেখায় স্রষ্টার প্রতি আত্মসমর্পণই শান্তি ও সম্প্রীতির একমাত্র পথ। এই বিশ্বাস ও স্রষ্টার সাথে নির্মল সম্পর্কের মাধ্যমে একজন মুসলিম সব ধরনের বিষণ্ণতা থেকে মুক্ত থাকে। (Shearon এবং Sheine এর মতে ভবিষ্যত সম্পৃক্ত বিষয়ে পজিটিভ ইমোশন বিষণ্ণতার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয় এবং এটা প্রমাণিত)। সবকিছুই নির্ধারিত এবং আমাদের জীবনের জন্যে নির্ধারিত সেটাপটাই হলো সর্বোত্তম সেটাপ, এই বিশ্বাস আন্তরিকতার সাথে বোঝা ও মেনে নেওয়ার মাধ্যমে কৃতজ্ঞ ও সন্তুষ্ট জীবনবোধ তৈরি হয়। পজিটিভ সাইকোলজির ভাষায় এসব বিষয়ই “Optical human functioning” অর্থাৎ মানব কর্মক্ষমতার সর্বোত্তম প্রতিফলন ঘটায় এবং আমাদের সমৃদ্ধির দরজা খুলে দেয়।
“বরং যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে আর সৎকর্মশীল হয়, তার জন্য তার প্রতিপালকের নিকট পুণ্যফল রয়েছে, তাদের কোন ভয় নেই, তাদের কোন দুঃখ নেই।”- (আল কুরআন, ২:১১২)