একজন মানুষের শরীরে হাজার হাজার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব রয়েছে ।  খালি চোখে দেখা যায়না এরকম অনেক রকম উপাদান আছে মানুষের শরীরে যা মানুষের শরীরকে সুস্থ রাখতে কাজ করে যাচ্ছে। মাইক্রোবায়োম ( Microbiome) এমনই একটি উপাদান যা মানুষের শরীরে শিশু অবস্থা থেকে রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থা গড়ে তুলতে কাজ করে যায়।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই মাইক্রোবায়োম একটি শিশুর শরীরে আসে তার মায়ের শরীর থেকে। মায়ের গর্ভে পানি ভাঙ্গার সময় থেকে এই ট্রান্সফার শুরু হয়, চলমান থাকে শিশুর ব্রেস্টফিডিং কাল পর্যন্ত।

শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে মাইক্রোবায়োম কিভাবে কাজ করে এবং শিশুর শরীরে মাইক্রোবায়োম তৈরি হয় কিভাবে, এই নিয়ে আজকের আর্টিকেল।

মাইক্রোবায়োম (Microbiome) কী?

একজন মানুষের শরীরে যত কোষ আছে তার প্রায় তিন গুণ বেশি আছে মাইক্রোঅরগানিজম বা মাইক্রোব ( Microbe), যাকে বাংলায় বলা যায় অণুজীব বা জীবাণু, ছোট ছোট জীবিত প্রাণ। এরা আমাদের শরীরে বসবাস করে একা অথবা কলোনি আকারে। এই মাইক্রোব আমাদের শরীরের ভেতর বাহির সবখানেই থাকে। আমাদের নাক, মুখ, চোখ, ত্বক, কান, প্রাইভেট পার্ট এবং নাড়ী ভুঁড়ির শেষাংশে থাকে ।

নানান রকম ফাঙ্গি, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্রটোযায়া ইত্যাদি মাইক্রোবকে একসাথে বলা হয় “হিউম্যান মাইক্রোবায়োম” যারা একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে বসবাস করে শরীরে রোগ প্রতিরোধ, শক্তি অর্জন ও প্রতিরক্ষামূলক ভিটামিন উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় মাইক্রোবায়োমের ভূমিকা কেমন?

মানুষের শারীরিক সুস্থতায় মাইক্রোবায়োমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাইক্রোবায়োম যেসব কাজ করে তার মাঝে উল্লেখযোগ্য কিছু হচ্ছে-

১। পরিপাকক্রিয়া ও মেটাবলিজমে সাহায্য করে
২। ভিটামিন ও নিউরো কেমিক্যাল উৎপাদন করে
৩। হরমোনের সাথে নানান রকম ক্রিয়া-বিক্রিয়া করে
৪। শরীরকে শত্রু জীবাণু সম্পর্কে সচেতন করে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে
৫। খাদ্যবস্তু ভেঙ্গে শক্তি তৈরি করে
৬। পরিপাকতন্ত্র ও মস্তিষ্কের মাঝে সম্পর্ক রয়েছে বলে মাইক্রোব আমাদের মনের ভাব ও আচরণকেও প্রভাবিত করতে পারে।

এগুলো ছাড়াও চিকিৎসাবিজ্ঞানে মাইক্রোবায়োমের আরও বিশদ ভূমিকা বর্ণিত আছে। ।

শিশুর ইমিউনিটি বৃদ্ধিতে মাইক্রোবায়োমের গুরুত্ব

আমরা আগেই জেনেছি মানুষের শরীরে মাইক্রো বায়োম নানান রকম উপকারী ভূমিকা পালন করে। এই কাজগুলো শিশু অবস্থায়ই শুরু হয়। নতুন শিশু পৃথিবীতে আগমনের পর নানান রকম বন্ধু ও শত্রু জীবাণুর সংস্পর্শে আসে। মায়ের পেটের চেয়ে আলাদা রকমের খাবার তাকে খেতে হয় ও নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। এসকল কাজে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে শিশুকে সাহায্য করে মাইক্রোবায়োম।

বিজ্ঞানিদের মতে, শিশুর “ইমিউন সিস্টেম” বা রোগ প্রতিরোধ পদ্ধতির সর্বোত্তম গঠনে কাজ করে মাইক্রোবায়োম। তাছাড়া, মায়ের শরীরকে প্রসব ও দুগ্ধপানের জন্য উপযোগী করে তুলতেও কাজ করে এই মাইক্রোবায়োম।

শিশুর শরীরে মাইক্রোবায়োমের বীজ বপন পদ্ধতি

মায়ের গর্ভে থাকার সময়ই একটি শিশু মায়ের শরীর থেকে তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করে। সেই সাথে শিশুর শরীর তৈরি হয় বাইরের পৃথিবীর সাথে মানিয়ে নেবার জন্য। সেই কাজের প্রয়োজনীয় রসদও শিশু মায়ের শরীর থেকেই যোগাতে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় শিশুর শরীরে মাইক্রোবায়োমের বীজ বপনও হয় মায়ের শরীর থেকেই!

বিজ্ঞানীদের মতে, শিশুর পরিপাকতন্ত্রে “সঠিক ব্যাকটেরিয়া”কে আসতে হবে “সঠিক সময়ে এবং সঠিক পদ্ধতিতে”। এটি না হলে বাচ্চার ইমিউন সিস্টেম ঝুঁকির মুখে থাকবে ও ভারসাম্যহীন আচরণ করবে। এই সঠিক পদ্ধতির শুরু হয় ভ্যাজিনাল ডেলিভারির মাধ্যমে।

মাইক্রোবের ব্যাপারে একটি খুব মজার ব্যাপার হচ্ছে মাইক্রো বায়োম প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অতিবাহিত হয় ও এই ধারা ক্রমচলমান থাকে। একজন মানুষের হাতের ছাপ যেমন স্বতন্ত্র , তেমনি তার মাইক্রোবায়োমও। এই স্বতন্ত্র মাইক্রব মায়ের শরীর থেকে ভ্যেজিনাল ডেলিভারি ও ব্রেস্টফিডিং এর মাধ্যমে শিশুর শরীরে প্রবেশ করে।

এখানে আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, যদি আপনার পূর্বতন সকল মাতামহ থেকে আপনার মা পর্যন্ত সকলের ভ্যাজিনাল ডেলিভারি হয় ও সকলেই এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং করেন  তবে তাদের সকলের মাইক্রোবায়োম আপনার কাছে চলে আসবে ও আপনিও যদি একই কাজ করেন তবে সেসব মাইক্রোবায়োম আপনার সন্তানদের কাছেও যাবে। কী দারুণ না ব্যাপারটি!

শিশু মায়ের গর্ভে থাকার সময়ই মাইক্রোবায়োমের সংস্পর্শে আসে বলে বিজ্ঞানিরা নিশ্চিত হতে পারেননি। শিশু এম্নিওটিক ফ্লুয়িডের ভেতরে থাকে বলে মাইক্রোবায়োমের সাথে যুক্ত হতে পারেনা বলেই বিজ্ঞানিদের ধারণা। তবে তাদের সন্দেহ, খুব সামান্য পরিমাণ হলেও হতে পারে।

তবে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে যখন প্রসবকাল উপস্থিত হয়ে মায়ের পানি ভেঙ্গে যায় তখন শিশু মাইক্রোবায়োমের সংস্পর্শে আসে। তাই এটিকেই বীজ বপন বলা যেতে পারে। এরপর মায়ের বুকের স্পর্শ ও নিয়মিত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার মাধ্যমে মাইক্রোবায়োম স্থাপন পরিপূর্ণ হয়।

ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি ও মাইক্রোবায়োমের সম্পর্ক

বাচ্চা যখন মায়ের গর্ভে এম্নিওটিক স্যাকের ভেতরে থাকে তখন সে মায়ের মাইক্রোব পায়না, এটি আমরা আগেই জেনেছি। যখন পানি ভেঙ্গে যায় তখন এই স্যাকের নিরাপত্তা নষ্ট হয় ও বাচ্চা মায়ের স্বতন্ত্র মাইক্রোবায়োম অর্জন করে। মায়ের মাইক্রোবায়োম বাচ্চার নাক, মুখ, ত্বক, কান দিয়ে প্রবেশ করে, এমনকি কিছু মাইক্রোবায়োম বাচ্চা গিলেও ফেলে।

যেহেতু নরমাল ডেলিভারির সময় মায়ের পরিপাকতন্ত্র থেকে, বাতাস ও মায়ের স্পর্শ থেকে, স্কিন টু স্কিন বা ক্যাঙ্গারু কেয়ার (Kangaroo Care)  ও পরবর্তীতে ব্রেস্ট ফিডিং থেকে বাচ্চা মাইক্রোবায়োম পায়, তার মানে বাচ্চার শরীরের ইমিউন সিস্টেম তৈরির প্রথম ধাপ হচ্ছে নরমাল/ ভ্যাজিনাল ডেলিভারি।

বুকের দুধ ও মাইক্রোবায়োমের সম্পর্ক

নতুন শিশু পৃথিবীতে আসার পর তার প্রথম ও প্রধান খাবার হচ্ছে মায়ের বুকের দুধ। মায়ের বুকের দুধ এমনভাবে তৈরি যেখানে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় সব রকমের পুষ্টি উপাদান, স্বাদ, সহজপাচ্যতা ইত্যাদি সবকিছু বিদ্যমান।

মায়ের বুকের দুধে থাকা নিউট্রিয়েন্ট, এন্টি ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান, হরমোন, মাইক্রোব ইত্যাদির পাশাপাশি রয়েছে “ অপাচ্য বিশেষ সুগার” যা শিশুর শরীরে হজম হয়না। তাহলে এগুলোর কাজ কী?

ভ্যাজিনাল ডেলিভারির মাধ্যমে যেসব মাইক্রোব শিশুর শরীরে এসেছে, সেগুলোর জন্য এই “অপাচ্য সুগার” খাবার হিসেবে কাজ করে।  এই অপাচ্য সুগার খাবার খেয়েই “সঠিক মাইক্রোব” শিশুর পরিপাক তন্ত্রে বাসা বাঁধে। নয়তো ক্ষতিকর মাইক্রোবও শিশুর পরিপাক তন্ত্রে জায়গা করে নিতে পারে।  

শিশুর শরীরে মা থেকে প্রথম যে মাইক্রোব আসে, সেগুলোর মাঝে এমন অনেক মাইক্রোব থাকতে পারে যা শিশুর জন্য ক্ষতিকর। বুকের দুধ খাবার মাধ্যমে এখানে একটি ভারসাম্য তৈরি হয় যা শিশুর ভবিষ্যৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। চমৎকার একটি প্রক্রিয়া!

তাই শিশুর শরীরে মাইক্রোবায়োমের সঠিক কার্যক্রম তৈরির জন্য শুধু ভ্যাজিনাল ডেলিভারি নয়, সেই সাথে খেয়াল রাখতে হবে শিশুকে পূর্ণ মেয়াদে বুকের দুধ খাওয়ানোর দিকেও।

শিশুর শরীরে মাইক্রোবায়োম তৈরির প্রতিবন্ধকতা

যেহেতু আমরা জেনেছি যে শিশুর শরীরে মাইক্রোবায়োম প্রবাহের সবচে কার্যকরী উপায় হচ্ছে ভ্যাজিনাল ডেলিভারি ও পরবর্তীতে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং , তার মানে হচ্ছে এই কাজে বিপরীত হলে সেটিই মাইক্রোবায়োম প্রবাহের পথে  বাঁধা  হয়ে দাঁড়াবে।

সেই হিসেবে বলা যায় প্রচলিত সি-সেকশন ডেলিভারি ও পরবর্তীতে বাচ্চাকে ফর্মুলা দুধ দিলে শিশু একে তো কম মাইক্রোবায়োম পাবে, অপরদিকে শিশুর শরীরে সঠিক ও ক্ষতিকর মাইক্রোবায়োমের ভারসাম্য নষ্ট হবে যার প্রভাব শিশুকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হতে পারে।

সেই হিসেবে বলা যায় সি-সেকশন ডেলিভারি ও ফর্মুলা দুধ খাওয়ানো শিশুর শরীরে মাইক্রোবায়োম প্রতিস্থাপনে সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

সি-সেকশন ও ফর্মুলা দুধ কি তবে আমাদের শত্রু

প্রতিটি জিনিসেরই পজিটিভ ও নেগেটিভ দিক রয়েছে। মাইক্রোবায়োমের এতো গুরুত্ব জানার পর যাদের সি সেকশনে বাচ্চা হয়েছে ও প্রয়োজনের তাগিদে যারা বাচ্চাকে ফর্মুলা দুধ দিয়ে থাকেন, তারা নিশ্চয় মানসিকভাবে আশাহত অনুভব করবেন।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিভিন্ন সংকটময় পরিস্থিতিতে মা ও শিশুর অধিকতর কল্যানের জন্যই আমাদেরকে সি-সেকশন ও ফর্মুলা দুধের উপর নির্ভর করতে হয়। সেই পরিস্থিতিতে এগুলো আমাদের জন্য নিয়ামতস্বরূপ।

সমস্যা তখন দেখা দেয় যখন অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশন হয় ও ফর্মুলা দুধে বাচ্চাকে অভ্যস্ত করানো হয়। এসব ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখা দরকার আমরা আমাদের শিশুকে তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকে বঞ্চিত করছি।

সঠিক ও পরিপূর্ণ প্রি-নাটাল জ্ঞান অর্জন করার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশন এড়িয়ে নিরাপদ ভ্যাজিনাল ডেলিভারি সম্ভব হয় ও মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকেন যা মা ও শিশুর সাস্থের জন্য সবচেয়ে উপকারী।  

 মাতৃত্ব প্রিনাটাল কোর্সের বিস্তারিত জানতে এখানে দেখুন। 

পাশাপাশি, ভবিষ্যতে আমরা এমন গবেষণা আশা করতে পারি যেখানে সি-সেকশনেও কিভাবে শিশুকে মায়ের মাইক্রোবায়োমের সংস্পর্শে আনা যায় সেই পদ্ধতি জানা যাবে।

তবে এটুকু স্বীকার করতেই হবে প্রাকৃতিক নিয়মের চেয়ে সেরা কিছুই হতে পারেনা। সেই সাথে প্রয়োজনে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কৃত্রিম পদ্ধতির সেবা নিতে দ্বিধা করা যাবেনা।

সবশেষে বলা যায়, শিশুর শরীরে মাইক্রোবায়োমের সরবরাহ সবচে বেশি হয় মায়ের কাছ থেকে ভ্যাজিনাল ডেলিভারি, স্কিন টু স্কিন টাচ ও এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং এর মাধ্যমে। তাই আজিবনের জন্য শিশুর সেরা রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থা নিশ্চিত করতে এই ব্যাপারে আমাদের সচেতন হওয়া দরকার। প্রাকৃতিক প্রসবের প্রাকৃতিক সুবিধাগুলো আমাদের মা ও শিশুর জন্য আল্লাহর দেয়া প্রাকৃতিক নিয়ামাত। এই নিয়ামাত সহজলভ্য করতে প্রি-নাটাল প্রস্তুতি ও দুয়া জারি রাখতে হবে। সেই সাথে শিশুর বড় হবার সাথে সাথে  সলিড খাবারের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে কেননা সেগুলো থেকেও শিশু দরকারি মাইক্রোবায়োম অর্জন করে থাকে।

তথ্যসূত্র

১। How a mother’s microbiome helps shape her baby’s developement
২। Microbiome mini course by Tony Harman