আমার যাইনাব এর বয়স যখন ১০মাস, তখন আমি সেকেন্ড টাইম কন্সিভ করি। রোজা শুরুর একদম আগে জানতে পারি প্রেগন্যান্সির নিউজ। আলহামদুলিল্লাহ, ৩০টা রোজা রাখতে পেরেছিলাম। যদিও অনেক খারাপ লাগতো, এদিকে বড়টাও ব্রেস্টফিডিং করতো। এবার এক্টিভিটি বলতে বড়টার দেখা শোনা ছিল। হাটাহাটি ও করতাম, তবে খুব বেশি না। একটা কোর্স করছিলাম, ওখানে যাওয়া আসা সব একাই করেছি।
আমার কোর্সমেটরা লাস্ট এক্সামের দিনই আমার থেকে জানতে পারেন আমি প্রেগন্যান্ট। আমাকে দেখে/ চলাফেরাতে উনারা কখনই বুঝেন নি । আমি আসলে নিজের উপর খুব সাহস রাখতাম। নিজেকেই নিজে এনকারেজ করতাম যে আমি পারবো ইন শা আল্লাহ। যাইনাব হওয়ার পরে পিরিয়ড সাইকেল চেঞ্জ হওয়াতে LMP নিয়ে কনফিউশান ছিল। টোটাল প্রেগন্যান্সিতে দুই বার আল্ট্রা করেছি-১৮ আর ৩০ সপ্তাহে। প্রথম টায় ২৭ ননভেম্বর আর পরেরটায় ২০ নভেম্বর আসে ডেট। আমাকে ডাক্তার ২০-২৭এই টাইমটা বললেন।
আমার দুই প্রেগন্যান্সির কোনটাতেই ফলস পেইন ছিল না। শেষের দিকে খেজুর, জমজমের পানি, সুরা ফাতিহা পড়া পানি খাওয়া শুরু করেছিলাম। ২০ তারিখ পার হয়ে যাওয়ার পরে আর patience থাকছিল না। লেবারের কোন সাইন-ই নাই । ২৩তারিখ সকালে উঠে কেন জানি মন এত খারাপ লাগছিল, কান্নাকাটি করে অনেক দু’আ করলাম যেন আল্লাহ লেবার পেইন টা শুরু করিয়ে দেন। মজার ব্যাপার সেদিন সকালেই আমার লেবারের সাইন শুরু হয়! খুবই মাইল্ড ব্যাক পেইন আর তলপেটে পেইন দিয়ে৷ এরপর প্রচুর পেলভিক ফ্লোরে চাপ লাগছিল আর ফ্রিকুয়েন্ট মিকচুরেশান হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম লেবার শুরু হয়ে গেছে।
আমি এক্সাইটেড ছিলাম, এই ভেবে যে আর বেশি সময় নেই আমার মামুনিকে কোলে নেওয়ার । এটা আসলে নিজেকে কুল রাখার/ মাইন্ড ডাইভার্ট করার টেকনিক যে পজিটিভ মাইন্ড সেট আপ রাখা। যাই হোক হাটাহাটি শুরু করলাম। ফ্লুইড ইন্টেক বাড়ালাম অনেক। একটা পানির বোতলে সুরাহ ফাতিহা ৭বার + জমজমের পানি মিক্সড করে রেডি রাখলাম। এভাবে সন্ধ্যা হলো। সন্ধ্যায় মিউকাস প্লাগ দেখলাম। পেইন তখনও তেমন বেশি না থাকলে উঠা শুরু করেছিল। আমি আলহামদুলিল্লাহ খুবই রিলাক্স আর কুল ছিলাম। উলটা আমাকে দেখে আমার আম্মু অবাক। উনার প্যালপিটিশান শুরু হয়ে গিয়েছিল । আমি উনাকে সাহস দিচ্ছিলাম যে এত টেনশানের কি হলো, বেবি হতে আরও সময় লাগবে, হসপিটালে এখনও যাওয়ার সময় হয় নাই এসব বলে।
যেহেতু রাতে যদি হুট করে পেইন বেড়ে যায়, হস্পিটালে যাওয়া একটু টাফ হবে, তাই রাতের খাওয়া খেয়ে, ২ রাকাত নফল নামায পড়ে রেডি হয়ে নিলাম। আমার বড়টাকেও সাথে নিলাম। ওর ব্যাগ ও রেডি করে নিয়েছিলাম। হস্পিটালে যাওয়ার পরে কেবিনে এডমিট জলাম। সিটিজি, পিভি চেক করলেন ডিউটি ডাক্তার। যদিও উনি বললেন সারভিক্স ১ / ২ ফিংগার ওপেন, আমার খুব একটা সেটিস্ফাইং লাগে নি, আমি তো বুঝতে পারছিলাম যে লেবারের প্রগ্রেসন কেমন। যাই হোক, আম্মু, বড় পিচ্চি ঘুমিয়ে গেল। আমি হাটাহাটি চালু রাখলাম। ১০/১৫মিনিট হাটার পরে কিছুক্ষণ রেস্ট নিতাম। প্রচুর পানি খাচ্ছিলাম আর ব্লাডার প্রেসার আসা মাত্রই ক্লিয়ার করছিলাম।এই দুইটাই লেবার পেইন প্রগেসনের জন্য খুব জরুরি। রাত তিনটায় পেইনের তীব্রতা অনেক বাড়লো। স্ট্রংগ কন্ট্রাকশান হচ্ছিল।
কন্ট্রাকশান স্ট্রংগ হচ্ছিল রাত ৩টা থেকে। আমি কন্টিনিউয়াস হাটাহাটি করছিলাম। যখন কন্ট্রাকশান আসছিল স্কোয়াট করছিলাম আর করিডরের বারান্দার গ্রিল ধরে রাখছিলাম(তীব্র পেইন এ কোন কিছুতে সাপোর্ট দিলে/ পেইন টা ট্রান্সমিশন এর চেষ্টা করলে অনেকটাই আরাম পাওয়া যায়, আল্লাহ মারিয়াম(আঃ) এর লেবার পেইন এর সময় উনাকে এই টেকনিক জানিয়ে দিয়েছিলেন)।
আবু যাইনাব জেগে ছিলেন। আমি তখনও হাসি মুখে কথা বলছিলাম। উনি বার বার জানতে চাচ্ছিলেন ব্যাথা খুব বেশি কিনা। মিড ওয়াইফকে বলে ডিউটি ডাক্তারকে আনালাম, উনি চেক করে বললেন সারভিক্স এখন নাকি ২সেমি এর মতো খুলেছে! আমি কেন জানি বিলিভ করতে পারিনি, আমার লেবার পেইন এর প্রগ্রেসান এর সাথে কিছুতেই মেলেনি মনে হচ্ছিল। আবু যাইনাবকে ঘুমাতে বলে আমি আমার হাটাহাটি চালু রাখলাম। পেইন কোপ আপ করতে কিছু পজিশান ট্রাই করেছি, মাতৃত্ব গ্রুপে সেটার পোস্ট দিয়েছিলাম।
যাই হোক, এভাবে ফজর নামায এর সময় হলো, নামায পড়ে খুব আকুতি নিয়ে দু’আ করলাম। এদিকে ব্যাথা বেড়েই চলছিল। সকাল হলো। জানলাম সিনিয়র ম্যাডাম আসছেন। আমাকে দেখে স্টাফরা বলছিলেন রোগী দেখি সব জানে কি করতে হবে । এই পেইন নিয়েও খুব নরমাল থাকার চেষ্টা করছিলাম, নিজেকে বিগ ইভেন্টটার জন্য প্রিপেয়ার করছিলাম। সকাল ৯টার দিকে ম্যাডাম আসলেন। উনি চেক করে বললেন, সারভিক্স তো ৬/৭সেমি ওপেন! আধা ঘন্টার মধ্যে বাবু হয়ে যাবে।
এরপর উনি পানি ভেঙে দিলেন। আর সাথে সাথে কন্ট্রাক্সসান ও ডাবল হয়ে গেল। নিজেই হেটে লিফটে করে লেবার রুমে নামলাম। ডাক্তার ও অন্য স্টাফরা রেডি হচ্ছিলেন ডেলিভারির জন্য। এরপর যে পেইনটা হচ্ছিল সেটা অসহনীয়, তারপর চিৎকার না করে হিপ রোটেশান করছিলাম আর বিছানার হ্যান্ডেল ধরে বালিশ কামড় দিয়ে উবু হয়ে ছিলাম। হঠাৎ খুব প্রেসার আসতে থাকে, আমি তাড়াতাড়ি করে সবাইকে ডাক দিলাম। আমাকে ধরে লেবার টেবিলে তোলা হলো। এবার আমি আর নিজেকে ধরে রাখি নাই, শরীরের সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে পুশ করলাম। কয়েক টা পুশেই আলহামদুলিল্লাহ আমার আয়িশা দুনিয়ায় চলে আসলো বাবুকে কোলে নিয়ে সালাম দিলাম ।
আলহামদুলিল্লাহ এপিশিওটমি লাগেনি, তবে ফার্স্ট ডিগ্রি টিয়ার হওয়াতে অল্প স্টিচ লেগেছিল।
লিখেছেন: উম্মে যাইনাব