প্রেগনেন্সিতে আলট্রাসনোগ্রাফী সম্পর্কে বিস্তারিত

একজন নারীর জরায়ুতে দুটি শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর নিষেকে তৈরি হয় একটি ভ্রূণ, খুব ধীরে ধীরে সেই ভ্রূণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় নয় মাস সময়ে পরিপূর্ণ হয়ে প্রসবের জন্য উপযোগী হয়। এই সময়ে প্রতিটি ধাপে ভ্রূণের বৃদ্ধি, গঠন ও গর্ভের অন্যান্য সবকিছু ঠিক আছে কিনা জানাটা খুবই জরুরী। কোন জটিলতা থাকলে আগেই ব্যাবস্থা নেয়া যায় যেটি মা ও শিশুর জীবন রক্ষাকারী ভূমিকা পালন করে।

গর্ভকালে যেসব মেডিক্যাল চেকআপ করা হয় একজন মাকে, তার মাঝে অন্যতম হচ্ছে আলট্রা সনোগ্রাম( Ultra Sonogram)  যার মাধ্যমে মায়ের গর্ভের ভ্রূণের সঠিক বৃদ্ধি ও অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। একটি গর্ভকালে বেশ কয়েকবার আলট্রাসনোগ্রাম করতে হয়। কিন্তু অনেকের মাঝেই আল্ট্রাসনোগ্রাম নিয়ে ভুল ধারণা রয়েছে। আজকের আর্টিকেলে গর্ভবতীর করণীয় আল্ট্র সনোগ্রাম নিয়ে বিস্তারিত থাকছে।

আল্ট্রাসনোগ্রাম ( Ultra Sonogram) কাকে বলে?

আল্ট্রাসনোগ্রাম টেস্ট বা স্ক্যান হচ্ছে একটি ছবি দেখার পরীক্ষা। আমাদের শ্রবণ ক্ষমতার বাইরের বিশেষ এক ধরনের শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে শরীরের ভেতরের ছবি দেখার মাধ্যমে এই পরীক্ষা করা হয়।

এক্ষেত্রে “প্রোব” নামের ছোট ও ভোঁতা একটি যন্ত্র শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে স্পর্শ করা হয় ও সেখান থেকে তরঙ্গ গিয়ে কম্পিউটারে ছবি ভেসে উঠে ও সেই ছবিটি আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট হিসেবে প্রিন্ট করা হয়। সেই রিপোর্টেই দরকারি তথ্য সাজানো থাকে।

আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষাকে আল্ট্রাসাউন্ড বা আল্ট্রা নামেও ডাকা হয়। 

প্রেগ্নেন্সিতে কখন ও কতবার আল্ট্রা করাতে হবে?

 প্রেগ্ন্যান্সিতে যেসব আল্ট্রা করানো হয় সেগুলো হচ্ছে-

প্রথম আলট্রা

এটি করানো হয় প্রেগ্ন্যান্সি শুরুর ৪-৫ সপ্তাহের মাঝে। নারীরা সাধারণত নিজেদের শারীরিক পরিবর্তন দেখে বুঝতে পারেন যে তারা গর্ভবতী। বর্তমানে সবাই কিট টেস্ট এর মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে তিনি আসলেই গর্ভবতী কিনা।

অনেকেই এরপরে আল্ট্রা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। কিন্তু কিট টেস্ট এর ফলাফল ভু্লও আসতে পারে। তাই একটি আল্ট্রা করিয়ে নিলে গর্ভধারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়, সেই সেই সাথে ভ্রূণের অবস্থান সঠিক জায়গায় মানে জরায়ুতে কিনা সেটি জানা যায়। পাশাপাশি, প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ নির্ণয় করা যায়।

অনেক সময় জরায়ুর বাইরে টিউবে নিষেক ঘটে যাকে বলা হয় এক্টপিক প্রেগ্ন্যান্সি (Ectopic Pregnancy)।  এর ফলে টিউব ফেটে গিয়ে মায়ের জীবনেr হুমকি তৈরি হয়, কখনো টিউব অপসারণ করতে হয় যার ফলে ভবিষ্যতে সন্তান ধারণ ঝুঁকির মুখে পড়ে।

এছাড়াও সারভিক্স, ডিম্বাশয় বা পেটের অন্য জায়গায় নিষেক ঘটতে পারে।

এসকল সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে গর্ভধারণের ৪-৫ সপ্তহের মাঝে আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষাটি।

যদি ভ্রূণের অবস্থান সঠিক না হয় তবে বিকল্প উপায়ে চিকিৎসার মাধ্যমে সেটির সমাধান করা যায়। তাই গর্ভধারণের শুরুতেই একটি আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

দ্বিতীয় আলট্রা

গর্ভকালের দ্বিতীয় আল্ট্রা করার পরামর্শ দেয়া হয় ৬-৮ সপ্তাহের মধ্যে। এইসময় বাচ্চার হার্টবিট দেখতে পাওয়া যাবার কথা। সেটি নিশ্চিত হতেই এই সময়ে পরীক্ষাটি করা হয়।

তৃতীয় আল্ট্রা

গর্ভাবস্থার ১১ থেকে ১৩ সপ্তাহের মাঝে একটি আল্ট্রা করা হয় গর্ভের শিশুর কোন জন্মগত রোগের ঝুঁকি আছে কিনা সেটি দেখতে।

চতুর্থ আল্ট্রা

গর্ভাবস্থার ১৮-২৪ সপ্তাহের মাঝে একটি আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করা হয় যাকে বলা হয় এনোম্যালি স্ক্যান। এর মাধ্যমে শিশুর হাড়ের গঠন, পাকস্থলী, মুত্রথলি, কিডনি, স্নায়ুতন্ত্র, হার্ট ইত্যাদি সব ঠিক আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করা হয়।  

প্রসবকালীন প্রস্তুতির জন্য ৩৬-৩৮ সপ্তাহে একটি আল্ট্রা করার দরকার হয় যাতে বাচ্চার অবস্থান, পানির পরিমাণ ও অন্যান্য সবকিছু থেকে বুঝা যায় নরমাল ডেলিভারির জন্য চেষ্টা করা যাবে নাকি  সি-সেকশন লাগবে। 

এছাড়াও ডপলার স্টাডির মাধ্যমে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা সেটি দেখা হয়।

বায়ো ফিজিক্যাল প্রোফাইলের মাধ্যমে শিশুর নড়াচড়া, পানির পরিমাণ ও অন্যান্য বিষয় দেখা হয়। এছাড়াও গর্ভাবস্থায় যেকোন অসুবিধা দেখা দিলে প্রয়োজনীয় আল্ট্রা দরকার হতে পারে।

সর্বমোট কতবার আল্ট্রা করা দরকার?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা( WHO) এর মতে অন্তত একবার আল্ট্রা সনোগ্রাম করা কথা বলা হয়েছে। 

আমাদের দেশে সাধারণত মোট তিনবার আল্ট্রা সনোগ্রাম করতে বলা হয়। 

প্রথমে ১০-১৪ সপ্তাহে, এরপর ১৮-২২ সপ্তাহে ও সেশবার ৩৬-৩৮ সপ্তাহে। তবে এই সময়কালটি নির্দিষ্ট নয়। একেক বিশেষজ্ঞ একেক রকম মতামত দিতে পারেন। সবচে ভালো হয় প্রেগ্ন্যান্সির শুরুতেই একজন ডাক্তারের ফলো আপে থাকলে, সেই ডাক্তার যতবার দরকার মনে করবেন ততবার আল্ট্রা করাটাই সবচে ভালো। এতে বেশি বা কম পরীক্ষা করার ঝামেলা তৈরি হয়না।

অনেকেই আর্থিক সমস্যার কারণে দরকার মতন আল্ট্রা করতে চান না বা পারেন না, সেক্ষেত্রে চেষ্টা করতে হবে অন্তত তিনবার যেন এই পরীক্ষা করা হয়। তবে বর্তমানে আমাদের দেশে প্রসূতি সেবার প্রতি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বের কারণে গর্ভবতী নারীদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে সরকারী ব্যাবস্থাপনায় পরীক্ষা নিরীক্ষা ও ডাক্তার দেখানোর সুযোগ রয়েছে। আপনার এলাকায় খোঁজ নিলেই প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে যাবেন।

তাই অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।

আল্ট্রাসনোগ্রাম সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

১। আলট্রা করলে গর্ভের বাচ্চার কোন ক্ষতি হয় না। আল্ট্রা সনোতে নিরাপদ শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয় বলে এটি গর্ভের শিশুর কোন ক্ষতি করেনা। অনেকেই এক্স-রে পরীক্ষার সাথে এটিকে গুলিয়ে ফেলেন। গর্ভবতী নারীদের এক্স-রে  পরীক্ষার ক্ষেত্রে কিছু বাঁধা আছে। তবে আল্ট্রায় কোন অসুবিধা নেই।

এমনকি বেশি সংখ্যক আল্ট্রা করলেও অসুবিধা নেই। তবে অপ্রয়োজনীয় আল্ট্রা না করাটাই স্বস্তির।

২। আল্ট্রা সনোগ্রাম কেবল শিশু মেয়ে না ছেলে হবে সেটি জানার করা হয়না। আমাদের দেশের মানুষের মাঝে একসময় এটি খুব সাধারন প্রবণতা ছিল, গর্ভবতীকে কেবল একবার আলট্রা করানোর জন্য আনা হতো তাও গর্ভের শিশু ছেলে না মেয়ে সেটি জানার জন্য। বর্তমানে অবস্থার যদিও উন্নতি হয়েছে তবুও যেন আল্ট্রার আকর্ষণ গর্ভের বাচ্চার লিঙ্গ পরিচয়। অথচ বাচ্চা ও মায়ের সুস্থতাই এখানে মুখ্য।

তাই ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক আল্ট্রা করাবেন, শিশুর লিঙ্গ পরিচয় জানার জন্য নয়।

৩। আল্ট্রা সনোগ্রাম নিরাপদ বলে বার বার এটি করার প্রয়োজন নেই, কেবল ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক পরীক্ষা করালেই যথেষ্ট।

৪। আলট্রা পরীক্ষার আগে ৬-৮ ঘন্টার খালিপেট ও প্রস্রাবের ব্যাগ থাকা উচিত। তাই আল্ট্রা করার আগেই এই প্রস্তুতি নিয়ে যাবেন।

৫। মুরুব্বিদের অনেকেরই ধারণা প্রেগ্ন্যান্সির শুরুতে আল্ট্রা করার দরকার নেই, বেশি বেশি আল্ট্রা করার দরকার নেই। এটি ভুল। প্রেগ্ন্যান্সির শুরুতেই আল্ট্রাসনোগ্রাফী করলে নানান জটিলতা এড়ানো সম্ভব হয়।

৬। অনেকেই ভাবেন আল্ট্রায় পর্দার খেলাফ হয়। এটিও ঠিক নয়।প্রায় বেশীরভাগ হাসপাতালে মেয়েদের জন্য নারী চিকিৎসক থাকেন। আবার মেয়েদের আলাদা বিভাগ থাকে যেখানে পুরুষরা যেতেই পারেননা। তাই খোঁজ নিয়ে পর্দার পরিবেশ আছে এমন হাসপাতালে যাবেন।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞানগুলো মানুষের কল্যানের জন্য। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে এই জ্ঞানের সুফল কাজে লাগানো উচিত। সুস্থ ও নিরাপদ গর্ভাবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় আল্ট্রাসনোগ্রাম করান কেননা সুস্থ মা ও শিশু দেশ ও উম্মাহর সম্পদ।

তথ্যসূত্র

১। গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাম কেন গুরুত্বপূর্ণ

২।গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাম কতবার

৩।গর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাম

৪। WHO Guideline for USG

সর্বশেষ হালনাগাদ করা হয়েছেঃ জানুয়ারি ১৯, ২০২৫