ছোটবেলায় আমার বাবা প্রায়ই আমাদের জন্য বই কিনে আনতেন, যখন আমরা বই পড়া কী তা ভালোভাবে বুঝতামও না। বাবা-মা মিলে আমাদেরকে ছবিগুলো দেখিয়ে সেগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন। আমরা খুব মজা করে ছবিগুলো দেখতাম। অনেক সময় অলক্ষ্যে বইয়ের পাতা উল্টাতে গিয়ে ছিঁড়ে ফেলতাম। কিন্তু বাবা তারপরও আমাদের জন্য নতুন বই কিনে দিতেন। আমরা খেলনা দিয়ে যত সময় কাটিয়েছি তার চেয়ে বেশি সময় বই নিয়ে কাটিয়েছি। তখন টিভি কিংবা কম্পিউটার দেখার প্রচলন তেমন ছিল না। তাই বই থেকে নতুন কিছু জানা আমাদের জন্য অন্যরকম অনুভূতি ছিল। বাবা সব সময় কিছু না কিছু পড়ে শোনাতেন। বিশেষ করে অফিস থেকে আসার পরে আমরা তার কাছে বই পড়ার জন্য অপেক্ষা করতাম। আর যখন আমরা নিজেরা পড়তে শিখলাম তখন আরও বেশি করে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লাম।

যদিও বাবা নিজেও পড়তে পছন্দ করতেন, তাই আমাদের জন্য বই কিনে দিতেন, কিন্তু এটি আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান উপহার ছিল। বাবা-মা কেন বাচ্চাদের ছোটবেলায় বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলবেন, তা আমি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি আমি মা হওয়ার পরে। আমি ছোট বাচ্চাদের সাথে কথা বলা এবং তাদের সাথে সময় কাটানো সম্পর্কে খুব বেশি জানতাম না, কারণ আমি নিজে খুব কম কথা বলা একজন মানুষ। কিন্তু আমার মেয়ে হওয়ার পরে আমার এক পরিচিত বোন আমার মেয়ের জন্য একটি ক্লথ বুক আর কিছু বোর্ড বই উপহার দিলেন, যখন ওর বয়স তিন মাস। আমি আমার মেয়েকে সেগুলোর ছবি দেখাতাম, গল্প বানিয়ে বলতাম, প্রাণীর শব্দ করে শোনাতাম যা আমার মেয়ে খুব পছন্দ করত। যেহেতু আমি একা তার দেখাশোনা করতাম, তাই বই পড়ে, ছবি দেখে, গল্প করে তার সাথে আমার সময় কাটানো অনেকটা সহজ হয়ে গেল। তার আর আমার মধ্যে একটা গভীর আবেগময় বন্ধন গড়ে উঠল। সে নিজে বইয়ের পাতা উল্টাতে চাইত, নিজে শব্দ বলত। এগুলোর মাধ্যমে তার মোটর দক্ষতা (Motor Skill) উন্নত হল। শুধু তাই নয়, তার চোখের সংযোগের মাধ্যমে আমি তার আবেগগুলোকে ভালোভাবে বুঝতে পারতাম।

কেন আমারা ছোটবেলা থেকে শিশুদের বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলব

শিশুদের Early childhood development মানে “শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশের” জন্য বই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।  বইয়ের মাধ্যমে আপনি আপনার শিশুর সাথে বাস্তব ধারণা দেয়ার সাথে সাথে তার কল্পনা শক্তিকে বিকশিত করতে পারবেন।  বইয়ের মাধ্যমে শিশুদের Early learning বা তাদের কোন কিছু দ্রুত শেখাতে সহায়তা করে।  আসুন জেনে নেই কেন আমারা আমাদের শিশুদের ছোটবেলায় বই দেব।

নতুন শব্দ ও ধারণা: বই পড়ার মাধ্যমে শিশুরা নতুন নতুন শব্দ এবং ধারণা শিখে।

 কল্পনাশক্তির বিকাশ: গল্পের চরিত্র এবং ঘটনাগুলির সাথে নিজেকে যুক্ত করে শিশুরা তাদের কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে।

মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের বিকাশ: বই পড়ার সময় শিশুরা ভাষা, চিন্তাশক্তি, মনোযোগ এবং স্মৃতিশক্তি ব্যবহার করে, যা মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশকে উদ্দীপিত করে।

শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি: নতুন নতুন শব্দ শিখে শিশুরা তাদের শব্দভাণ্ডার বাড়ায়। গল্পের বাক্যগুলো অনুসরণ করে শিশুরা সঠিকভাবে বাক্য গঠন করতে শিখে।

পড়ার ও লেখার দক্ষতা বৃদ্ধি: নিয়মিত বই পড়ার মাধ্যমে শিশুর পড়ার গতি এবং বুঝার ক্ষমতা বাড়ায় এবং লেখার দক্ষতা বিকশিত করে।

বইয়ের মাধ্যমে শিশুরা নতুন জগৎ, নতুন চরিত্র এবং নতুন অভিজ্ঞতা অন্বেষণ করে।

সৃজনশীলতা বৃদ্ধি: গল্পের ঘটনাগুলির উপর ভিত্তি করে শিশুরা নিজেরাই গল্প তৈরি করতে পারে।

সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বিকাশ: গল্পের চরিত্রদের মতো শিশুরাও বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করার উপায় খুঁজে বের করে।

 আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে: বই পড়ার মাধ্যমে শিশুরা নতুন জিনিস শিখে এবং নিজের ক্ষমতার উপর বিশ্বাস করে শিশুরা আত্মবিশ্বাসী হয়।

সহানুভূতি বৃদ্ধি করে: গল্পের চরিত্রদের অনুভূতি বুঝতে শিখে শিশুরা অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়।

সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধিঃ বইয়ের গল্প নিয়ে আলোচনা করলে শিশুর অন্যদের সাথে কথা বলার দক্ষতা বৃদ্ধি করে।

গল্পের চরিত্রদের মধ্যকার সম্পর্ক দেখে শিশুদের মাঝে অন্যদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার দক্ষতা বিকশিত হয়।

বাচ্চাদেরকে বই পড়ায় আগ্রহী করে তুলতে বাবা-মায়ের করণীয়

প্রযুক্তির যুগে বাচ্চাদের বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তোলা একটু চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। তবে, বাবা-মা হিসেবে আপনি অনেক কিছু করতে পারেন:

*যেমন আপনি  নিজে বই পড়ার অভ্যাস করুন। বাচ্চাদের দেখান যে আপনিও বই পড়তে ভালোবাসেন।

*নিজের বই পড়ার সময় নির্ধারণ করুন, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় বই পড়ার জন্য বসুন। বাচ্চাদেরও এই অভ্যাসে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করুন।

 *বিভিন্ন ধরনের বই সংগ্রহ করুন। বাচ্চাদের বয়স ও আগ্রহ অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের বই সংগ্রহ করুন। কার্টুন, গল্প, জ্ঞানীয় বই, সব ধরনের বই রাখতে পারেন। বই সব সময় কিনতেই হবে এমন না। আপনি বাসায় থাকা ম্যাগাজিন,  ছবি সহ যেকোনো কিছু দেখিয়েও এই অভ্যাস করতে পারেন।

*বাচ্চাদের জন্য কাহিনী বলা অনেক কাজে দেয়। বিশেষ করে নিজের জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো তাদের উপযোগী করে বলা। এতে তাদের কল্পনাশক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং বই পড়ে অন্য ঘটনা জানার আগ্রহ বাড়বে।

*নিয়মিত লাইব্রেরি নিয়ে যান। সেখানে বাচ্চারা নিজের পছন্দমতো বই বেছে নিতে পারবে। বই ধরে দেখতে পারবে। তাদের ভালো লাগবে।

*আমি চেষ্টা করি  বাচ্চাদের সাথে বই পড়ার পর আলোচনা করতে। তারা কী বুঝেছে, কী ভালো লেগেছে, এসব নিয়ে কথা বলতে। বই পড়ার মাঝখানেও কথা বলি।

*ঈদ বা অন্য কোনো উপলক্ষে বাচ্চাদের বই উপহার দেই। পরিবারের সদস্যদের সাথে বই পড়ার প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে পারেন।  

নিজের এবং বাচ্চাদের মোবাইল, ট্যাবলেট বা কম্পিউটার ব্যবহারের সময় সীমিত করে বই পড়ার সময় ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি।  

সর্বপরি আমাদের বাবা মায়েদের অনেক  ধৈর্য ধরতে হবে। ফলাফল পেতে সময় লাগতে পারে। ধৈর্য ধরে বাচ্চাদের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করে বই পড়াকে একটি মজাদার অভিজ্ঞতা করে তুলতে পারলেই আপনি আপনার সন্তানকে বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারবেন।