ডুলা হিসেবে প্রথম বার্থ এটেন্ড: ভুলব না কখনও

১.

দশ তারিখ একটা ক্লাস (CBE practical class)  নিয়ে ফিরলাম। আমার প্রাকটিকাল ওয়ার্কের মায়ের অবস্থা ভাল না। ভাল না মানে লেবার এগিয়ে আসছে তা বাহ্যিক সবকিছুতে প্রকাশ পাচ্ছে।  আরও সপ্তাহখানেক আগে থেকেই আসলে প্রাকটিস কনট্রাকশন (Braxton hicks) শুরু হয়েছে। চেহারা সুরতও জানান দিচ্ছে। 

এজন্য এগার তারিখেও ক্লাস রাখলাম। আল্লাহর কাছে চাচ্ছিলাম একটা দিন যেন পাই।  একসাথে চারটা মডিউলের প্রিপারেশন নিয়ে গেলাম। যা ভেবেছিলাম, তাই। ওর শরীর আরও গুছিয়ে এসেছে। নয় নম্বর ক্লাসটা শেষ হল। 

গত দুইদিনের মজিউলগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল মা এবং তার পরিবারের পক্ষের সাপোর্ট পারসনের জন্য। যেভাবে মাকে ট্রেইন করছিলাম একইভাবে   নাসিমা আপাকেও (গর্ভবতী মায়ের নিজের মা) সবকিছু ক্লিয়ার করে দিচ্ছিলাম তার রোল সম্পর্কে। পিছনের কিছু ক্লাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও বেশ কয়েকবার করে তাদের মনে করিয়ে দিলাম।

ফেরার সময় আমাকে এগিয়ে দিতে এলেন নাসিমা আপা। উনাকে নরম কাপড়, কাঁথা, বাবুর গরম জামা আর ধাত্রীর জন্য গ্লভস, নতুন ব্লেড রেডি রাখতে বললাম। হসপিটাল যাওয়া লাগলে গাড়ি যেন রেডি থাকে সেটারও ব্যবস্থা রাখতে মনে করিয়ে দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “কী মনে হয় আপা,  আজকের রাতটা পার হবে?”

কিছুটা দ্বিধা, কিছুটা শঙ্কা নিয়ে বললেন,  “ মনে তো হয় রাইতে ব্যাথা উঠব। রাইত হইলে কি আপনাকে জানালে আপনি আসতে পারবেন?” 

ব্যাথা উঠলেই যেন আমাকে জানানো হয়, আমি অবশ্যই আসব বলে বাসায় ফিরলাম। এতগুলো ক্লাস  আমার বাসায় এসেই করে গেছে নাজমা। কখনও মা, কখনও বোন, কখনও খালার সাথে। কিন্তু শেষের দিকে আর ওর শরীরে কুলাচ্ছিল না। দুইদিন আমাকে ওদের বাসায় যেতে হল। এটাকে আল্লাহর একটা ব্লেসিংই বলব আমি। একদম হুট করে প্রসবের দিনই হাজির হওয়ার চেয়ে আগেভাগে জানাশোনা থাকল। আবার নাসিমা আপাকেও সবকিছু রিভাইস করে বলা গেল। আলাদা করে আর্লি লেবারে কী হবে, কী করা লাগবে বলে এলাম। 

পডকাস্ট

পুরো গল্পটি কয়েকদিন আগে নাসরিন সুলতানা নিজে শুনিয়েছেন, এটা তার রেকর্ড। যেহেতু নারীদের সেশন ছিল, তাই আপনার যদি এর মাঝে এক্সেস থাকে, তাহলে নিচের গুগল বা ইয়াহু বাটনে ক্লিক করে লগিন করলে সেশনটির রেকর্ড দেখতে পারবেন।

ফ্রী সেশন - নারীদের জন্য Membership Required

You must be a ফ্রী সেশন - নারীদের জন্য member to access this content.

Already a member? Log in here

এছাড়া এই ফরম পুরন করে এক্সেস রিকোয়েস্ট করতে পারেন।

আরো জানুনঃ মাতৃত্ব দৌলা সেবা

২.

রাতে ফিরে চারটা মডিউলের পরীক্ষা দেয়ার কাজও শেষ করে রাখলাম। রিসাসিটেশন টেকনিকের পেইজটা আরেকবার পড়ে রাখলাম। সিপিআর দেয়ার ভিডিও দেখে রাখলাম। আশা করছি লাগবে না। নরমালি লাগে না,  মাত্র ১% বাচ্চার এক্সটেনসিভ রিসাসিটেশন হেল্প লাগে৷  তবুও যদি দরকার লাগে আরকি। আমি আসলে রেডি থাকছিলাম নিজেও। বাচ্চাদের বাবাকেও বলে রাখলাম সামনে ৭ দিনের মধ্যে যেকোন একদিন তোমাকে দরকার লাগতে পারে। 

বেশ একটু ভয়ও পাচ্ছিলাম কি? শঙ্কা তো কিছুটা ছিলই৷ কারণ Birth is not without risk. সবকিছু যেন সহজ হয় আল্লাহর কাছে দয়া চেয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে ঘুমাতে গেলাম। 

৩.

বারো তারিখ সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে ফোন এল অচেনা নম্বর থেকে। নাসিমা আপার ফোন। শেষরাতে থেকে ব্যাথা শুরু হয়েছে। বাড়ছে। এখন বেশ ভালই বেড়েছে। মিডওয়াইফ এসছে কি না জিজ্ঞেস করে আমি আসছি বলে রেখে দিলাম। 

জানতাম যেকোনদিন লেবার শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু আজকেই হবে তা ভাবিনি। চোখ বন্ধ করে সামনের করণীয়গুলো সাজিয়ে ফেললাম। আল্লাহ ভরসা।

সিস্টার আয়েশা আল হাজ্জারকে ওয়াটসএপে জানিয়ে রাখলাম যে লেবার শুরু হয়েছে। আমি এটেন্ড করতে যাচ্ছি।  কোন উপদেশ থাকলে দিতে। ডুলা প্রাকটিকালের উইন্ডো এখনই খুলে দিবেন জানালেন সিস্টার। দুয়া করে দিলেন।

মাতৃত্বেও জানানো দরকার। ইনুআপুকে জানালাম। ওয়াসিফা আপুকেও জানিয়ে কোন এডভাইস থাকলে দিতে বললাম। 

এদিকে সকালে রান্নার জন্য মাছ মাংশ রাতে বের করা ছিল, সেগুলো আবার তুলে রাখলাম রেফ্রিজারেটরে। দ্রুত খিচুড়ি বসিয়ে বাচ্চাদের বাবাকে ডাকলাম। সবকিছু বলে সেকেন্ড হাফে অফিস যেতে বললাম কারণ আশা করা যায় বারোটার মধ্যে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।

ওযু করে এসে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে ঘুমন্ত বাচ্চাদের  ওদের বাবার কাছে রেখে রওনা দিলাম। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোন কিছুই সহজ নয়,  আর আল্লাহ সহজ করলে কারও ক্ষমতা নাই কঠিন করার। 

খেজুর শেষ হয়ে গিয়েছে। গত কয়েকদিনে  কয়েকটা পেইজে খোঁজ নিয়েছি  কিন্তু সময় পাওয়া গেল না। ডুলা ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম আগেই৷ এত সকালে দোকান খোলা থাকবে না৷ কিন্তু বড় মাদ্রাসার সামনের দোকানটা খোলা পাওয়া যেতে পারে । হাঁটতে শুরু করলাম।  যেতে যেতে ওয়াসিফা আপুর সাথে ফোনে কথা হল। খেজুরও পাওয়া গেল। কয়েক মিনিটেই পৌঁছে গেলাম আলহামদুলিল্লাহ। 

৪.

গিয়ে নাজমার সাথে দেখা করে বোঝার চেষ্টা করলাম লেবার এখন কোন পর্যায়ে আছে? কনফিডেন্ট দেখলাম তাকে। এটা পজিটিভ। বেশ স্ট্রং কনট্রাকশন, তবে একেকটা ৪৫ সেকেন্ডের বেশি না এখনও । সাড়ে সাতটা বাজে। দেখা যাক। নাজমাকে হাঁটতে বলে  মিডওয়াইফ আন্টির সাথে পরিচিত হলাম। নাসিমা আপাকে বললাম নাজমাকে খেজুর ধুয়ে দিতে আর সকালের খাবার দিতে। ইন বিটুইন কন্ট্রাকশনে খেয়ে নিক সকালের খাবার। লম্বা পথ বাকি। প্রচুর শক্তি দরকার।

পুরো পরিবেশটা আমার ভীষণ ভাল লাগল। একটা বার্থ এনভায়রনমেন্ট যেমন হওয়া দরকার ঠিক তেমনই। তারা নিজেরাই হোমবার্থ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চার বছর বয়সী আরেকজন সন্তান আছে নাজমার। সেও হোমবার্থ। নাজমার খালার দীর্ঘদিনের বিরতিতে কোলের সন্তানটিও হোমবার্থ।  পরিবারের অন্য সদস্যদের গতিবিধি বলে দিচ্ছে তারা এই অভিজ্ঞতার সাথে পূর্বপরিচিত। 

৫.

লেবার খুব ভালভাবে প্রগ্রেস করছে। দশটা নাগাদ কনট্রাকশন ৫-৭ মিনিট বিরতিতে ৬০-৭০ সেকেন্ড করে হতে থাকল। খেজুর খাওয়া, হাঁটাহাটি চলল। সকালের খাবারের তেমন কিছুই খেতে পারল না সে। কিন্তু শক্তি তো দরকার। দুধ গরম করে কিছুক্ষণ পরপর দেয়া হল। পানি খেতে বললাম বার বার। ডিম সেদ্ধ খেল একটা। আর কয়েকবার প্রস্রাব করে এল। সবকিছু সুন্দরভাবে মনে রেখেছে নাজমা, আমি কেবল সময়ে সময়ে মনে করিয়ে দিচ্ছি। 

প্রসব কীভাবে হ্যান্ডেল করবেন সেটা নিয়ে জানতে প্রিনাটাল কোর্স করুন, নিজের জন্য উত্তম বিনিয়োগ

একেকটা কনট্রাকশন শুরু হলে ব্যাথার আতিশয্যে সে কখনও তার খালার গলা ধরে ঝুলে পড়ছে। কখনও মিডওয়াইফকে ধরে। আর কখনও আমাকে। এই মুহুর্তে আসলে সাপোর্ট পারসনের শরীরে প্রচন্ড শক্তি দরকার হয় তা প্রথমবারের মত বুঝলাম। মা নিজের শরীরের ভার পুরোটা ছেড়ে দেয়। নাজমাকে বারবার বলে আসছিলাম কনট্রাকশনের সময় পুরো শরীরের মাসল রিল্যাক্স করে দিতে। আর ডিপ ব্রিদিং করতে। সে চেষ্টা করে যাচ্ছিল। 

রাতে ব্যাথা শুরু হওয়ার পর থেকে সে ঘুমায় নি বা ঘুমাতে পারে নি। লেবার যেভাবে আগাচ্ছে এভাবে আগাতে থাকলে আশা করছি পার হয়ে যাবে আল্লাহর রহমতে । কিন্তু কোন কারণে লেবার যদি দীর্ঘ হয় তাহলে সে ক্লান্ত হয়ে পড়া স্বাভাবিক।  

মনে রাখা দরকার আর্লি লেবার শুরু হয়েছে এমন সময় যদি নরমালি মায়ের ঘুমের সময় হয়, তখন অবশ্যই মাকে ঘুমিয়ে নিতে হবে।

দশটার দিকে বাচ্চাদের বাবা ফোন দিয়েছে। মুয়াজ কথা বলবে। ঘুম থেকে জেগে গেছে।  ফোন কানে নিয়েই সে বলল, আম্মা আমাকে তুমি আজকে নিয়ে যাবা বলছিলে। নিয়ে যাও নি তো। বললাম বাবার কাছে খেয়ে নাও, সময় হলে মা নিয়ে আসব তোমাকে। 

সাড়ে দশটার পরের দিকে নাজমা বমি করে দিল। প্রচন্ড বমি। ট্রানজিশন পর্যায়ের খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা,  অনেক মায়ের হয়, অনেকের হয় না৷ বুঝলাম লেবারের প্রথম ধাপ শেষ হতে যাচ্ছে ইনশাআল্লাহ। কনট্রাকশন অনেক ফ্রিকোয়েন্ট আর তীব্রতর হচ্ছে।  বারোটার মধ্যে বাবু হয়ে যাবে এরকম একটা ধারণা করছি আরকি। এরপর আরেকবার বমি। 

পরের বারের বমির পর সে একরকম নিস্তেজ হয়ে গেল। রাতে ঘুমাতে না পারা, সকালে ঠিকমত খেতে না পারা, দুইবার  বমি সব মিলিয়ে ক্লান্ত হওয়াই তো স্বাভাবিক। 

এবার তার কিছুক্ষণ আরাম দরকার। আবার লেবারের এমন পর্যায়ে আছে তাতে একটিভ থাকাটা জরুরি। একদম হার্ড লেবার। নাজমাকে লেফট সাইড লাইং পজিশনে শুয়ে পড়তে বললাম। সেও যেন এটাই চাচ্ছিল। ডিপ রিল্যাক্সেশন দরকার। এই পজিশনে থাকলে লেবার প্রগ্রেসে কোন বাধা পড়ে না এবং স্ট্রং কনট্রাকশন সামাল দেয়া সহজ হয়। 

CBE practical এ এই পজিশনে তিনদিন তাকে ডিপ রিল্যাক্সেশন দেখিয়েছি, করিয়েছি। যদিও এটা তার সেকেন্ড বেবি , এই টেকনিক লাগুক কিংবা  না লাগুক কিন্তু এটা প্রাকটিস করিয়েছিলাম খুব গুরুত্ব দিয়ে। পুরোপুরি রিল্যাক্সেশনে যাওয়ার জন্য তাকে কোচ করতে থাকলাম আর তার মাসলগুলো আরামদায়কভাবে টিপে দিতে থাকলাম৷ মুখ খোলা, চোখ বন্ধ।  শরীর ছেড়ে দাও। এগুলো বারবার বলতে হচ্ছিল। 

এগারটার দিকে আবার ফোন। বারটার পর ওদের বাবার আর থাকার উপায় নাই। সেকেন্ড অপশন ভেবে রেখেছিলাম ইন কেইজ লাগলে ভাবির কাছে ওদের রাখব৷ জীবনে প্রথমবারের মত তারা বাবা বা মা ছাড়া একা  কোথাও থাকবে। ব্যাপারটা আসলে সহজ না৷ আজ পর্যন্ত কোনদিন কখনোই তাদের ছাড়ি নি। যাই হোক৷

সোয়া এগারটার দিকে নাজমা আবার হাঁটতে চাইলে ওকে উঠিয়ে দিয়ে সবাইকে বলে বেরিয়ে এলাম যে আধাঘন্টার মধ্যে ব্যাক করছি ইনশাআল্লাহ। নাজমাকে বেশ তাজা লাগছিল। বারবার বলে দিলাম যে নিজের শরীরে পুশিং আর্জ  এলে যেন পুশ করে। এর আগে না। একদম না৷ 

৬.

ঝড়ের বেগে এসে দুজনকে রেডি করে বড়জনকে ভাবির হাতে দিয়ে ছোটজনকে নিয়ে আবার বিশ মিনিটের মাথায় চলে এলাম লেবার রুমে।

শুনলাম আমি যাওয়ার পরপরই  মিউকাস প্লাগ বেরিয়ে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ।  

পুশিং আর্জ আসছে। প্রায়  বারোটা বাজে। আর আধাঘন্টা থেকে দুই ঘন্টার ব্যাপার ইনশাআল্লাহ। 

শুরু থেকে আমি  সূরা আরাফের ৫৪ নম্বর আয়াত আর সূরা ইউনুসের ৩ নং আয়াত এবং তিনক্বুল পড়ে ফুঁ দিচ্ছিলাম বারবার। আমাদের হাতে আসলে কিছুই নাই। আল্লাহ যা চাইবেন তাই হবে। আমরা কেবল আমাদের চেষ্টা করছি সর্বোচ্চ। 

এই প্রথমবারের মত পিভি চেক করলেন মিডওয়াইফ। নাজমা হাফ স্কোয়াটে আধশোয়া থাকল কিছু সময়। কিছুক্ষণ পরপর পজিশন চেইঞ্জ করতে বলছিলাম এবং নিজে দেখিয়ে দিচ্ছিলাম। পুশিং আর্জ এলে নিজে থেকেই পুশ করছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল কোন পজিশনেই সে আরাম পাচ্ছিল না। একে একে স্কোয়াট, বার্থ অন অল ফোর, হাফ স্কোয়াট, আধাশোয়া, এমনকি দাঁড়িয়েও চেষ্টা করা হল কিন্তু কোন পজিশনই যেন কম্ফোর্টেবল নয়!

একসময় সে আধা শোয়া হয়ে হেলান দিয়ে থাকল ওর খালার শরীরে। কোনভাবেই সে আর পজিশন বদলাবে না। আসলে তার শরীর ছেড়ে দিয়েছে। ক্লান্তিতে এতটাই নুয়ে গেছে যে দুই কনট্রাকশনের মাঝের সময়টা সে ঘুমিয়ে পড়ছে। সময় নিতে দিলাম। এখন পর্যন্ত সবকিছু পজিটিভই আলহামদুলিল্লাহ।  কিন্তু সেকেন্ড বেবি হিসেবে তার পুশিং স্টেজ আরও সংক্ষিপ্ত হওয়ার কথা। অথচ সময় বয়ে যাচ্ছে। 

মেয়েটা শুরু থেকে শেষ পুরোটা সময় প্রচন্ড ধীর স্থির ছিল মাশাআল্লাহ। 

এবার আরেকবার বমি করল নাজমা। প্রায় পৌনে এক ঘন্টা ধরে ওই এক পজিশনে আছে সে। এর মধ্যে দুইবার পিভি চেক করে বাচ্চার মাথা একই জায়গায় আছে বললেন মিডওয়াইফ। 

নাজমার খালা যিনি, তিনি একসময় একটু অস্থির হয়ে গেলেন। যাবারই কথা। নাসিমা আপা একদম স্থির। তার টেনশন হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে কিন্তু তিনি স্থির আছেন। এমন অভিভাবক সবার হত!

এভাবে এক ঘন্টা যাওয়ার পর আমার ইন্সটিংক্ট একটু অন্যভাবে দেখছে বিষয়টা৷ প্রায় এক ঘন্টা ধরে বাচ্চার মাথা বার্থ ক্যানালের একই জায়গায় থাকাটা কোন কাজের কথা না। অত্যন্ত ক্লান্তির জন্য যথেষ্ট শক্তি দিয়ে পুশ করতে না পারা, দীর্ঘক্ষণ একই পজিশনে থাকা ইত্যাদি কারণ লেবারকে ভালভাবে প্রগ্রেস করতে হেল্প করছে না। 

এতক্ষণ আমি মাদার লেড পুশিং অর্থাৎ মা নিজে থেকে আর্জ বুঝে পুশ করবে এই নীতিতে চলছিলাম। কিন্তু এখন আমার মনে হল ওকে আমার পুশ করাটা গাইড করতে হবে। ঘড়িতে প্রায় দুইটা বাজে বাজে অবস্থা। 

নাজমা আসলে ঘুমিয়ে যাচ্ছে বারবার। এবার আমি একটু কঠোরভাবে বললাম “পজিশন বদলাও নাজমা। ওঠো। উঠতে হবে তোমার৷ যেভাবে ভাল লাগে সেই পজিশন নাও। কিন্তু এই অবস্থা বদলানো লাগবে। বাবুকে বের হয়ে আসতে হেল্প কর। ওঠো।”

সে উঠে এরপর সটান চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। আর আশ্চর্যজনক ঘটনা হল ক্রিকেট বলের সমান বাবুর মাথা এই প্রথমবারের মত দেখতে পেলাম আমরা৷  এবং তার দাঁত মুখ খিঁচিয়ে ধরা দেখে বুঝলাম আরেকটা পুশিং আর্জ এসছে। এবার আমার পালা। প্রায় চিৎকার দিয়ে বললাম, “পুশ করো নাজমা। সব শক্তি দিয়ে পুশ করো। কী একটুতেই থেমে যাচ্ছ! বাবুকে বেরিয়ে আসতে হেল্প করো। করো পুশ।  আরো জোরে দাও৷ থামো। থামো। (এই মুহুর্তে যোনিমুখে বাবুর হেডের সবচেয়ে প্রশস্ত জায়গাটা ছিল । থামতে বলার কারণ তখন পুশ করলে টিয়ার হয়ে যাবে।)  “

আলহামদুলিল্লাহ সে চট করে ধরতে পারল ব্যাপারটা এবং রিলাক্স করে দিল শরীর। আর এই মুহুর্তটাকে কী বলব আমি! সুবহানাল্লাহ!  বাচ্চার পুরো মাথা বের হয়ে খানিক ঘুরে গেল। এরপর আরেকবার “পুশ করো নাজমা” বলার সাথে সাথে টুস করে বাবুর পুরো শরীর বেরিয়ে এল! 

এই মুহূর্ত আমি আমার সমগ্র জীবন মনে রাখব। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য হয় না আর! এক জীবনে মানুষ আর কী কী অত্যাশ্চর্য জিনিস দেখার জন্য কাঙ্খিত থাকে!

৭.

ঠিক দুইটার কয়েক মিনিট আগে  বাবু হল। বাবুকে তুলে একটা কাপড়ে জড়িয়ে মায়ের বুকে দিলাম। নাজমা যেন স্বস্তি পেয়েছে এতক্ষণে। কোন টিয়ার হয় নি। মিডওয়াইফ প্লাসেন্টা বের করল। নাড়ি কাটতে মানা করল নাসিমা আপা৷ ইয়েস! চেয়েছিলাম এটা পরিবার থেকেই কেউ বলুক। আলহামদুলিল্লাহ গত ক্লাসে আবারও এই বিষয়টা তাদের রঙিন ছবি থেকে দেখিয়েছিলাম। যদিও আমি এলার্ট ছিলাম, অন্তত পাঁচ মিনিটের আগে কাটতে দিতাম না (WHO এর মতে কমপক্ষে ১-৩ মিনিট পরে কর্ড কাটতে হয়।)।  কিন্তু এই স্টেপটা তাদের পক্ষ থেকে কেউ নেয়াটা আমার আরেকটা  অর্জন আলহামদুলিল্লাহ। 

এরপর বাচ্চার বাবা আযান ও একামত দিল। 

কর্ড কাটা হল পঁচিশ মিনিট পর। আরও একবার স্বচক্ষে অবাক করার মত জিনিস দেখার সৌভাগ্য হল। তা হল ধবধবে সাদা বাবুটা কী সুন্দর লালচে টুকটুকে হয়ে গেল দেরিতে কর্ড কাটার কারণে।  ওদিকে নাজমা ফ্রেশ হয়ে এল। একগ্লাস কমলার জুস দেয়া হল তাকে। খেয়ে বাবুকে প্রথম  ব্রেস্টফিডিং করানো হল জন্মের চল্লিশ মিনিটের মধ্যে। মা ও বাবু দুজনেই সুস্থ আলহামদুলিল্লাহ। বাবুর মাথায় একটু ফুলে গেছে বার্থ ক্যানালে অনেকক্ষণ থাকার কারণে। এটা কয়েকদিনে চলে যাবে। নাজমাকে খাইয়ে ঘুম দেয়ার মত পরিবেশ দিতে বলে ঘন্টাদুয়েক পর আসব বলে ফিরে এলাম। বড়পুত্রকে কথা দিয়েছিলাম তাকে আনব বাবু দেখাতে। আসতে তো হবেই।

প্রচন্ড ক্লান্তি শরীরজুড়ে, কিন্তু খুব এম্পায়াওয়ার্ড মন আর ফ্রেশ একটা ব্রেইন নিয়ে ফেরত যাচ্ছি ছোটপুত্রকে সাথে নিয়ে। হাঁটছি।  প্রচন্ড  নির্ভার লাগছে। নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আনন্দিত। ফাবিআয়্যে আলায়ি রব্বিকুমা তুকাজ্জিবান। আলহামদুলিল্লাহ। 

- নাসরিন সুতনানা
AMANI Birth CBE & doula intern (মাতৃত্ব)  

সর্বশেষ হালনাগাদ করা হয়েছেঃ ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৫