প্রতিদিন সকালে উঠে বাচ্চাদের টিফিন বানানো বিশাল একটা ঝক্কির কাজ। কিন্তু টিফিন না দিলে বাচ্চাদের তো অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকতে হবে। অথবা তারা স্কুল ক্যান্টিন থেকে চিপস, চকলেট খেয়ে নিবে।
তাই সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রধান চিন্তা থাকে আজ টিফিন কি দিব? সবচাইতে সহজ টিফিন হলো পাউরুটি অথবা নুডুলস। কিন্তু সেটাও তো দিতে পারি না সব সময়। কেননা, একই রকম টিফিন প্রতিদিন দিলে, ওরা খাবেনা। ফেরত নিয়ে আসবে।
আমাদের ছোটবেলায় টিফিনে জেলি দিয়ে পাউরুটি দিলেই ধন্য হয়ে যেতাম। আর দিতো মনে হয়, রুটি আর ভাজি। সেটা পুরো স্কুল জুড়ে মনে হয় বাচ্চাদের অপছন্দের খাবার। তখনো, এখনো!! টিফিনে আর কি দিত আম্মুকে জিজ্ঞেস করতে হবে!! ক্লাস ফোর থেকে সরকারি স্কুলে ভর্তি হওয়ায়, সেখান থেকেই টিফিন খেতাম। যেদিন যা দিত। সরকারি টিফিন। অনেকেই খুব অপছন্দ করতো। আমার কাছে খারাপ লাগত না। সরকার থেকে আমাদেরকে কিছু একটা খাবার দিচ্ছে বিনিময়ে মাসে মাত্র ২৫ টাকা দিতাম। তাই কৃতজ্ঞচিত্তে খেয়ে নিতাম। অনেকেই ভাবের ঠেলায় এসব খাবার খেতে পারতো না!!
অনেক মোটা মোটা পাউরুটির সাথে মাখন আর চিনি থাকতো একদিন, থাকতো সিঙ্গারা, থাকতো পুরি..... আর কি থাকতো?...... মনে পড়ছে না। দিবা শাখায় পড়ার কারণে এগারোটার পরে স্কুলে যেতাম। যাওয়ার আগে ভাত বা রুটি, কিছু না কিছু খেয়েই যেতে হতো বাসা থেকে। নতুবা আম্মু বাসা থেকে বের হতে দিত না। বিকালে স্কুল থেকে ফিরে আবার ভাত খেতাম!!
এখনকার বাচ্চাগুলো সকালবেলা বাসা থেকে বেশিরভাগ সময় না খেয়ে আসে। যার কারণে দেখা যায় এসেম্বলিতে ঠুস ঠাস করে দুই একজন মাথা ঘুরে পড়ে যায়। প্রায় ক্লাসেই দেখা যায় দু একজনের মাথাব্যথা, পেটব্যথা ....কারণ তারা না খেয়ে আছে। এরা আবার টিফিন টাইমে ও খায় না, বাসা থেকে খাবার আনে না, আবার স্কুল কলেজ শেষে ও কিছু খেতে পারে না। তখন কোচিং বা প্রাইভেটে পড়তে চলে যায়। মেয়েগুলো মনে করে না খেয়ে খেয়ে জিরো ফিগার নায়িকা হতে পারবে!!
বাসা থেকে বের হওয়ার আগে তাই আমরা চেষ্টা করি বাচ্চাদের মুখে খেজুর বা কলা বা বিস্কুট এ জাতীয় খাবার দিতে। তারা মাঝে মাঝে খায় মাঝে মাঝে খেতে চায় না!!!
অধিকাংশ অভিভাবক দেখা যায় বাচ্চাদের টিফিনের বেলায় যদি খুব একটা যত্নবান না হয়, তবে বাচ্চাদের তেমন একটা খাবার দেয় না। অনেকে টাকা দিয়ে দেয়, অনেকে আবার স্কুলে আসার আগ ভাত খাইয়ে দেয় দু এক লোকমা।
কিন্তু এত দীর্ঘ সময় বাচ্চাগুলো যে স্কুলে থাকে, তখন তারা যদি না খেয়ে থাকে তবে তাদের গ্যাস্ট্রিক বা গ্যাসের সমস্যা তীব্র হতে পারে যে কোন সময়।
এক্ষেত্রে অভিভাবকগণ যদি আগের রাত্রে একটু গুছিয়ে নিতে পারে বাচ্চার টিফিনে পরের দিন কি দিবে তবে বিষয়টা বেশ সহজ হয়ে যায়। শর্টকাটে কিছু জিনিস ডিপ ফ্রিজে রেখে দেওয়া যায়। যেমন মুরগির বুকের মাংস ম্যারিনেট করে রাখা (চিকেন পপকর্ন বানানো যায় অথবা পরোটার সাথে চিকেন কিমা দেওয়া যায় অথবা বার্গারের চিকেন প্যাটি করা যায়) , চিকেন ফ্রাইয়ের জন্য মুরগি রেখে দেওয়া, কেক বানিয়ে রাখা, পিঠা, সুজি টাইপের খাবার যেটা বাচ্চারা খেতে পছন্দ করে এগুলো আগের রাত্রে বানিয়ে রাখা। ফ্রাইড রাইস বা ভাত ভাজিও মাঝে মাঝে দেওয়া যায়। মোটকথা যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু না কিছু খাবার বাচ্চার জন্য গুছিয়ে রাখলে সকালে সহজেই টিফিন দেওয়া যায়।
অনেকে বাচ্চার টিফিনের জন্য এত ঝামেলা করতে পারে না সকাল সকাল। সে ক্ষেত্রে অনলাইনে বেশ ভালো ভালো কিছু পেইজ আছে যারা বিভিন্ন ফ্রোজেন স্ন্যাকস আইটেম বিক্রি করে। ঝটপট যে কোন নাস্তার জন্য তাদের উপরে বেশ নির্ভর করা যায়। তবে অনলাইন থেকে খাবার কেনাটা অনেকের জন্য বেশ ব্যয়বহুল। আবার অনেকের জন্য খাবারের স্বাদ সন্তোষজনক থাকে না, টেস্ট বাডের ভিন্নতার কারণে। আমি নিজেও তাই চেষ্টা করি সব ধরনের খাবার নিজের হাতে বানাতে।
সপ্তাহে পাঁচ দিন পাঁচ রকমের টিফিন আইটেম চিন্তা করে রাখতে হয় মাথায়। কেননা একই রকমের টিফিন হলে বাচ্চারা সেগুলো খেতে চায় না সহজে। চেষ্টা করি যেই টিফিন দেই সেটা একটু বেশি করে দেওয়ার জন্য। দেখা যায় বাচ্চাদের সহপাঠীদের কেউ না কেউ হয়তো টিফিন আনে নাই। সে ক্ষেত্রে আমার বাচ্চারা মাঝে সাজেই তাদের টিফিনের একটা অংশ শেয়ার করে থাকে।
প্রতিদিন সকালে উঠে নিত্যনতুন খাবার দাবার রেডি করার কিছু ঝামেলাও আছে। বাচ্চাদের প্রত্যাশার মাত্রা বেড়ে যায়। স্কুলের জন্য প্রস্তুত হবার ফাঁকে ফাঁকে তারা এসে দেখে যায় কি টিফিন দেওয়া হচ্ছে। মাঝে মাঝে আগের রাত্রে অর্ডার করে রাখে কি খাবে সেটা। ছানা পোনার জন্য সারাদিন এতো ছোটাছুটি করি, দেখা যাবে বড় হলে তারা বলবে.... কিছুই করো নি আমাদের জন্য!!!
সকালে এত তাড়াহুড়ার মাঠ মাঝে উঠে তিনজনের খাবার দাবার রেডি করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাচ্চাদের স্কুল এবং আমার অফিসে পৌঁছানো মোটামুটি ছোটখাটো একটা যুদ্ধ। তার মাঝে যদি সময় মত রিক্সা না পাই তবে তো সেরেছে......
সহকর্মীরা মাঝেসাজে জিজ্ঞেস করে বাচ্চাদের টিফিনের আইটেম কেমন হতে পারে...... এই চিন্তা থেকে সকালে দৌড়াদৌড়ির মাঝে হঠাৎ হঠাৎ ছবি তুলে রাখা। এখান থেকে যদি কেউ টিফিন আইডিয়া পান সেটাও ভালো, কেউ যদি আরো আইডিয়া দিতে চান তাতেও অনেক খুশি হব।

(টিফিনগুলো আমার আট বছুরে ও ছয় বছুরে পুত্র কন্যার জন্য প্রস্তুত করা। )