শিশুর টয়লেট ট্রেনিং - ঘরোয়া/ দেশীয় ও ফর্মাল পদ্ধতি

শিশু জন্মের পর তার সার্বিক যত্ন নেবার পাশাপাশি প্রস্রাব-পায়খানা ম্যানেজ করা যেন একটা চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পটি বা টয়লেট ট্রেনিং খুব সাহায্যকারী একটি বিষয়। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় পটি করা শেখানোই পটি ট্রেনিং। এক্ষেত্রে পি (pee) এবং পটি (Potty) ট্রেনিং – দুইটি আলাদা হয়, যেহেতু দুটোর অভ্যাস দুরকম।

শুনতে সহজ মনে হলেও কাজটা অতটা সহজ নয় যেহেতু বাচ্চারা নিজেদের মর্জিমাফিক চলে। তবে কিছু কৌশল অনুসরণ করে শিশুর পটি ট্রেনিং এর কাজটি একটু সহজ করা যায়।

পটি ট্রেনিং পদ্ধতি

শিশুর পটি ট্রেনিং নিয়ে যতো আর্টিকেল আপনি পাবেন, সেগুলো মূলত আলোচনা করে ফর্মাল মেডিক্যাল ট্রেনিং সিস্টেম নিয়ে। তবে, ফর্মাল পদ্ধতির পাশাপাশি আমাদের দেশীয়/ ঘরোয়া পদ্ধতিও কিন্তু শিশুর পটি ট্রেনিং এ যুগ যুগ ধরে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

তাই আজকে আমরা পটি ট্রেনিঙের ফর্মাল ও ঘরোয়া দুই পদ্ধতি নিয়েই আলোচনা করবো।

দেশীয় পদ্ধতি

এটি হচ্ছে আমাদের দেশের মা- চাচীদের বহুল চর্চিত কিছু টিপস ও ট্রিক্স এর প্যাকেজ। এই ক্ষেত্রে শিশুর সাথে কিছু বিশেষ শব্দ ও আচরণ করা হয়, যার ফলে শিশু পি- পটি করতে প্রস্তুত হয়। তবে, এই পদ্ধতির তেমন কোন মেডিক্যাল রেফারেন্স নেই, তাই এটি একেকজন একেকভাবে চর্চা করেন।

কখন শুরু করবো

দেশীয় পদ্ধতিতে পটি ট্রেনিঙে যেহেতু ধরা বাঁধা কোন নিয়ম নেই, তাই এটি শুরু নিয়েও কোন নির্দিষ্ট বয়স নেই। এমন তত্থ্যও পাওয়া গিয়েছে যেখানে শিশুর জন্মের ৭ দিনের সময়ই শিশুকে পি দেবার জন্য সিগন্যাল দেয়া হচ্ছে।

তাই বলা যায়, শিশু জন্মের ১৫-৩০ দিন পর থেকেই এটি শুরু করা যায়।

কিভাবে করবো

দেশীয় পটি ট্রেনিং কে আসলে ট্রেনিং না বলে সিগ্নেলিং বলাই বেটার। এখানে শিশুকে ট্রেইন করার চেয়ে বেশি খেয়াল রাখা হয় শিশুর পি- পটির অভ্যাসটিকে মনিটর করে সেই মোতাবেক শিশুকে পটিতে বসানোর। মানে, শিশুর কখন পি পটি করার বেগ চাপে, এটা অভিভাবক বুঝে নেন এবং ওই সময়টাতে শিশুকে উপযুক্ত স্থানে নিয়ে যান, এতে করে শিশুর পটি নিয়ে এলোমেলো অবস্থা এড়ানো যায় এবং আস্তে আস্তে বয়সের সাথে সাথে শিশু ট্রেইন হয়ে যায়। আমাদের গ্রামীণ সমাজে এমনটাই চলে আসছে বহুবছর ধরে।

তো এই পটি ট্রেনিং এর জন্য বেশ কিছু উপায় অবলম্বন করতে হয়-

১। শিশুর পি-পটি অভ্যাস বুঝতে হয়। এই কাজটা শিশুর অভিভাবক করে থাকেন। মা, নানি, দাদী- এই ধরনের আত্মীয়রাই এই কাজটি বেশি করেন।

এক্ষেত্রে ছোট্ট শিশুর স্বাভাবিক পি পটির অভ্যাস খেয়াল করে সেই সময়গুলোতে শিশুকে পি- পটি করার জন্য সিগনালিং করতে হবে।

২। শিশুর অভ্যাস আন্দাজ করার জন্য পি- পটি করার সময় খেয়াল রাখতে হবে, শিশুর মুখের ভঙ্গি বা শব্দ খেয়াল করতে হবে ও শারীরিক ভঙ্গি বুঝতে হবে। আবার শিশু কোন সময়গুলোতে পি- পটি করে বেশি, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। যেমন, ঘুম থেকে উঠার পর, ঘুমানোর কিছুক্ষণ পর, দুধ খাবার পর- এরকম নানান ব্যাপার খেয়াল করতে হবে। কিছু শিশু সময় বা বেলা ধরে পটি করে। যেমন দুপুর বা বিকেল। এই সময়গুলো খেয়াল রখতে হবে।

৩। শিশুর পি- পটির অভ্যাস বুঝতে পারলে পরের ধাপ বেশ সহজ। পটি করার সময় হয়েছে মনে হলে শিশুকে একটু সুবিধামত ভঙ্গিতে ধরে মুখ দিয়ে কিছু কথা ও শব্দ বলতে হবে।

এক্ষেত্রে আমাদের মুরুব্বিরা যেটা করতেন, খুব ছোট কোলের বাচ্চাদের এমনভাবে ধরতেন যেন পি- পটি ছড়িয়ে না যায়, আর মুখে সিশ সিশ শিইইইই টাইপ শব্দ করতেন। ফাঁকে ফাঁকে কমিউনিকেট ও করতেন। যেমন, এই তো ভালো বাচ্চা, আস আমরা সিস দেই। এই যে সিস দাও সিস দাও। এই তো দাদুভাই সিস দিবে এখন...।

এতে করে বাচ্চার  মস্তিষ্কে পি-পটি করা এবং এই শব্দ , ভঙ্গি ও কথার একটা যোগসূত্র তৈরি হয়। এতে বাচ্চা একটা ম্যাসেজ পায় যে এখন সিস করতে হবে।

৪। শিশু যখন বড় হতে থাকে, তখন সে বসতে পারলে , হাঁটতে পারলে তখন পটে/ কমোডে বসার ভঙ্গিতে বসানো যায়। এই কাজে অভিভাবক সাহায্য করেন। আস্তে আস্তে বাচ্চা নিজেই বসতে পারে। তবে তখনো বাচ্চাকে মনিটর করতে হয়। এবং নিজেকে ক্লিন করার ব্যাপারে শেখাতে হয়।

মোটা দাগে এভাবেই আমাদের দেশীয়/ ঘরোয়া পদ্ধতিতে বাচাদেরকে পটি ট্রেনিং করানো হতো।

আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি

এই পদ্ধতিটি মেডিক্যাল সায়েন্স অনুমোদিত এবং সুপারিশকৃত। এখানে নির্দিষ্ট গাইডলাইন মেনে শিশুকে পটি ট্রেনিং করানো হয়। এবার এই ব্যাপারে আলোচনা করছি।

কখন শুরু করতে হবে?

নিয়ম অনুযায়ী পটি ট্রেনিং এর আদর্শ সময় বাচ্চার বয়স ১৮ মাস থেকে ২০-৩০ মাস পর্যন্ত। ক্ষেত্র বিশেষে সেটা আবার চার বছরও হতে পারে।

পটি ট্রেনিং শুরুর আগের চেকলিস্ট

বাচ্চাকে পটি ট্রেনিং করাতে চাইলে কিছু জিনিস আগেই নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। 

যেমন- 

১। শিশু ঠিকভাবে হাঁটা/ দৌড় শিখেছে কিনা।

২। টয়লেট করার ব্যাপারটা বুঝতে পারে কিনা, মানে এটা যে আলাদা ব্যাপার এটা বোঝে কিনা। 

৩। প্যান্ট ভিজে গেলে অস্বস্তি প্রকাশ করে কিনা।

৪। পটির অভ্যাস ঠিক আছে কিনা। যেমন একবারেই তার কাজ শেষ হয় কিনা।

৫। ছোটবেলার তুলনায় বর্তমানে পটি করার প্রকাশ উন্নত হয়েছে কিনা। 

এই ব্যাপার গুলো ছাড়াও অভিভাবক হিসেবে বাচ্চার মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতির আরও সিগন্যাল আপনি নিজেই বুঝে নিতে পারবেন। এটা আপনার ও বাচ্চার আন্ডারস্ট্যান্ডিং থেকে আসবে।

পটি ট্রেনিঙের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র

 আপনি যদি সিদ্ধান্ত নেন যে এখন বাচ্চাকে পটি ট্রেনিং করাবেন, তবে আপনার কিছু জিনিস প্রয়োজন পরবে।

যেমন- পটি- ছোট বাচ্চাদের জন্য বাজারে নানান সাইজের ও ডিজাইনের পটি পাওয়া যায়। সেখান থেকে পছন্দমত একটি পটি বাছাই করবেন যেটি আরামদায়ক ও যথেষ্ট ধারণক্ষমতাযুক্ত হবে।  

কমড/ সিট- আপনি যদি সিদ্ধান্ত নেন যে বাচ্চাকে সরাসরি টয়লেট এ নিয়ে যাবেন, তবে বাচ্চা লো কমডে বসতে পারে কিনা দেখতে হবে।

আর হাই কমোড হলে সেটির জন্য বেবি সিট কিনে নিতে হবে।

শুরু হোক ট্রেনিং

পটি ট্রেনিঙের জন্য এবার আপনি ও আপনার বাচ্চা প্রস্তুত। তো এবার পটি ট্রেনিং শুরু করতে পারেন।

১। প্রথমেই দেখতে হবে বাচ্চা ডায়পারে অভ্যস্ত কিনা। যদি ডায়পারে অভ্যস্ত হয় তবে বাচ্চার হিসু- পটি করার সময়ের আন্দাজ করে সেই সময়গুলোতে বাচ্চাকে ডায়পার ছাড়া রাখতে চেষ্টা করতে হবে। এবং বাচ্চাকে প্রচণ্ড আগ্রহ, আদর ও উৎসাহ দিয়ে পটিতে বসানোর চেষ্টা করতে হবে।

২। বাচ্চার অভ্যাস অনুযায়ী বাচ্চাকে সেই সময়গুলোতে পটে বসান। এবং অল্প কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখতে চেষ্টা করুন। জোর করে নয় কিন্তু, বাচ্চাকে গল্প করে, উৎসাহ দিয়ে, দুস্তুমির ছলে বসিয়ে রাখুন। বাচ্চা যদি কয়েকবার পটে বসে পটি/ হিসু করে, তবে দ্ধরে নেয়া যায় টার ট্রেনিং দ্রুত হয়ে যাবে।

৩। বাচ্চাকে পটে বসানোর আগে চেষ্টা করবেন সে পটি করতে চায় কিনা বা করবে কিনা এটা বুঝে নিতে। যেহেতু অফিশিয়াল পটি ট্রেনিং শুরু হয় ১৮ মাস থেকে টাই এই বয়সী বাচ্চার অনেক অভ্যাস ই মা বুঝতে পারেন, বাচ্চাও অনেক কিছু বোঝাতে পারে। টাই নিজেদের বন্ডিং এ জ্বর দিন।

৪। বাচ্চার মানসিক অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করুন। সেকি পটিতে বসা পছন্দ করছে কিনা, টার পটি ক্লিয়ার হচ্ছে কিনা এগুলো দেখুন। যদি বাচ্চার খুব অপছন্দ হয় ও বাচ্চা কান্নাকাটি করে বা পটি ক্লিয়ার না হয়, তবে কিছু সময় এটা ইউজ করা বন্ধ রাখুন। বাচ্চা স্বাভাবিক হলে দুই তিন্দিন বা কিছু দিন  পড়ে আবার শুরু করুন।

৫। একেক বাচ্চার একেক রকম সময় লাগে ট্রেনিং সম্পন্ন করতে। তাই নিজে স্ট্রেস নেবেন না আর বাচ্চাকেও স্ট্রেস দেবেন না। জাস্ট একটু একটু করে বাচ্চার মেজাজ বুঝে ট্রেনিং এগিয়ে নিয়ে যান।

৬। দেখা যায় যে, বাচ্চারা দুই একদিন বেশ  সুন্দর ট্রেনিং মানতে পারে, আবার কয়েকদিন আগের অভ্যাসে ফিরে যায়। এটা স্বাভাবিক, অভ্যাস তৈরি হতে একটু সময় লাগবে। তাই বাচ্চা যদি সফলভাবে এক বারও পটি করতে পারে, প্রচুরর এপ্রিসিয়েট করবেন, বাহবা, সাবাশি দেবেন। চাইলে পুরস্কারও দিতে পারেন। এতে বাচ্চারা আরও উৎসাহিত হয়। 

৭। বাচ্চাকে পটি ট্রেনিং সম্পর্কিত গল্প, বই বা ছোটদের ভালো কার্টুন দেখানো যায়। এতেও ওরা উৎসাহিত বোধ করে। 

পটি ট্রেনিং নিয়ে কিছু বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন

১। বাচ্চাকে সরাসরি বাথরুমে নেয়া যাবে?

~ জি নেয়া যাবে। কিন্তু এটা প্রেক্টিকাল না। বাথরুম জায়গাটা একটু রিস্কি। তাই বাচ্চার বয়স ও শারীরিক ক্ষমতা বুঝে বাথরুমে অভ্যাস করাতে হবে।

২। হাই কমোডে বসানো যাবে?

~ জি যাবে। বাচ্চা নিজে নিজে বসা শিখে গেলে হাই কমডে বসানো যাবে। তবে হাই কমডে বসার সঠিক পজিশন জেনে তবেই বাচ্চাকে বসানো উচিত।

৩। কতদিন লাগে?

~ আগেই বলা হয়েছে, এটার নির্দিষ্ট কোন সময় নেই। একেক বাচ্চার একেক রকম সময় লাগে। তবে মুটামুটি চার বছরের মাঝে বাচ্চারা পটি ট্রেনিং রপ্ত করে ফেলতে পারে।

৫। কখন ডাক্তারের শরনাপন্ন হতে হবে?

~ কিছু কিছু বাচ্চার ট্রেনিং কমপ্লিট হতে প্রচুর সময় লাগে। তবে যথাযথ চেষ্টা করার পরেও ----- বছরের মাঝে ট্রেনিং কমপ্লিট না হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।

পটি ট্রেনিং নিয়ে কিছু সাবধানতা

১। বাচ্চার প্রস্রাবের রাস্তায় চিমটি বা খোঁচা দেয়া যাবে না। খুব হালকা স্পর্শ করা যেতে পারে তবে সেটিও নিয়মিত করা যাবেনা।

২। খুব ঘন ঘন বাচ্চাকে পটিতে বসানোর দরকার নেই। কিংবা পটিতে দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখার দরকার নেই। বাচ্চা বিরক্ত হয় এবং বাচ্চার কষ্টও হয়। আগে থেকেই বুঝার চেষ্টা করতে হবে বাচ্চার পটির অভ্যাস কেমন। সেইভাবে পটে/ কমোডে বসাতে হবে।

৩। অনেকেই আছেন, পটি ট্রেনিং করতে যেয়ে ৪-৫ মাসের বাচ্চাকেও পটে বসিয়ে দেন, এটা করা যাবে না। এসময়য় বাচ্চাতো ঠিকভাবে বসাই শেখে না। বাচ্চা শক্ত হয়ে না বসতে পারা পর্যন্ত পটে বসান যাবে না। ৮-১০ মাসের দিকে পটে বসালেও পেছনে  হাত দিয়ে সাপোর্ট দিয়ে রাখতে হবে।

৪। বাচ্চা যদি পটে বসে পটি করতে না চায় তবে তার সাথে রাগারাগি, মারধোর বা অসুন্দর আচরণ করা যাবেনা। এটা প্রাকৃতিক বিষয়, এক সময় অভ্যাস হয়েই যাবে। তাই আদর দিয়ে কৌশল করে এগুতে হবে।

ডিস্ক্লেইমার- এই আর্টিকেলে উল্লেখিত দেশীয় পদ্ধতিটি বাংলাদেশের মা ও শিশুদের পর্যবেক্ষণ করে লিখা। মেডিক্যাল সেক্টরে এটি নিয়ে খুব বেশি তথ্য নেই। তাই এটিকে খুব অকাট্য না ভেবে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

অপরদিকে, আনুষ্ঠানিক পদ্ধতিটি মেডিকেলি প্র্যাকটিস করা হয়।

মা- বাবার প্রতি নির্দেশনা থাকবে, ব্যালেন্স করে ঝুঁকিমুক্তভাবে ঘরোয়া পদ্ধতিটি চর্চা করার, এরপর নির্দিষ্ট বয়সে বাচ্চার বিকাশ বুঝে ফর্মাল পদ্ধতিতে বাচ্চাকে পটি ট্রেনিং করানোর চেষ্টা করা। দুইটি পদ্ধতির সঠিক ভারসাম্য রাখতে পারলে আশা করি বাচ্চাদের পি- পটি ম্যানেজ করা একটু সহজ হবে।

তথ্যসূত্র

সর্বশেষ হালনাগাদ করা হয়েছেঃ ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৫