প্রযুক্তি নির্ভর দুনিয়ায় প্রযুক্তি ছাড়া একটা মূহুর্তও যেন কল্পনা করা যায় না।মোবাইল,টেলিভিশন এখন ঘরে ঘরে,হাতে হাতে।প্রযুক্তির অনেক সফল ব্যবহারে আমাদের জীবনের অনেক কিছুই এখন হাতের নাগালে।মুদ্রার যেমন উল্টোপিঠ আছে ইলেকট্রনিক সেসব ডিভাইসেরও কিছু খারাপ দিক আছে বৈকি।
ডিভাইসের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ক্রমেই একটা প্রজন্মকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে সেটা বলাবাহুল্য।
ডিভাইসের আসক্তির কারণ
- কর্মক্লান্ত দিনশেষে মা চান একটু বিশ্রাম।কিংবা একটু সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করতে কিংবা ফোনে কথা বলতে।সেই মা হোক গৃহিণী কিংবা কর্মজীবী।
- বাচ্চার দুষ্টামি বন্ধ করতে,বাচ্চাকে চুপচাপ বসিয়ে রাখতে বাচ্চার হাতে একটু সময়ের জন্য ডিভাইস তুলে দেন।সেই একটু সময় একটা সময় এসে ঘন্টার কাটা ছোয়।ঘন্টার কাটা একসময় অবিরতভাবে বাড়তেই থাকে।
- সারাদিন অফিস,ব্যবসা,কাজ সামলিয়ে এসে বাবারাও চান একটু অবসর যাপন।বাচ্চার দুষ্টামি বন্ধ করতে বাচ্চার হাতে ডিভাইস দেয়ার তখন বিকল্প কোথায়!
- বাচ্চা খেতে চাচ্ছে না।একটা ডিভাইস হাতে ধরিয়ে খাওয়ানোর কাজটা সহজে করিয়ে ফেলা যায়।বাচ্চাকে পেট ভরে খাওয়ানোর মতো একটা জটিল কাজ এক নিমিষেই খতম।কিন্তু এতে খাবারের প্রতি বাচ্চার অনীহাই জন্মায়।সে জানেও না সে কি খাচ্ছে,কিভাবে খাচ্ছে।
- অনেক বাবা-মা আছে যারা দুজনেই কর্মজীবী।সারাদিন বাচ্চাটা হয়তো দাদা-দাদি,নানা-নানি কিংবা বুয়ার কাছে থাকে। বয়সের ভারে তারাও ক্লান্ত থাকে।চব্বিশ ঘন্টা বাচ্চা সামলানোর মতো শারীরিক,মানসিক সক্ষমতা তাদের থাকে না।আর কাজের বুয়ারও ধৈর্য্য কুলিয়ে উঠে না।যেখানে বাবা-মাই ক্লান্ত সেখানে কাজের বুয়া থেকে সঠিক পরিচর্যা আশা করা নেহায়েত বোকামি ছাড়া কিছু না।তারাও চায় হাফ ছেড়ে বাঁচতে।বাচ্চার হাতে তাই ধরিয়ে দেয়া হয় ডিভাইস।
- শহুরে বাচ্চাদের খেলাধুলা করার জায়গা খুবই অপ্রতুল।বাধ্য হয়েই অনেকটা দীর্ঘ সময় তাকে ঘরে থাকতে হচ্ছে।ঠিক সেই সময়ে তার বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠে ডিভাইস।
- বর্তমানে ইনফার্টিলিটি,অধিক বাচ্চা না নিতে চাওয়া,যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি নানা কারণে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে।যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে বাচ্চাদের উপর।বাচ্চারা খেলার সাথী না পেয়ে একাকিত্বে ভুগছে।সেই একাকিত্বের জায়গা পূরণ করতে হাতে তুলে নিচ্ছে ডিভাইস।
ডিভাইস আসক্তির মানসিক বিপদ
বলা হয় বাচ্চার জন্মের পর প্রথম পাঁচ বছর তার মানসিক বিকাশ হয় সবচেয়ে বেশি।এই সময়ে বাচ্চা প্রথম হাটতে শিখে,কথা বলতে শিখে,খেলতে শিখে।মোট কথা এই সময়ে সে যা দেখে,যা শুনে,যা নিয়ে খেলে তার সবকিছুই সে অবচেতন মনে শিখতে থাকে।মস্তিষ্কের গঠনে এই সময়টা তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঠিক সেই সময়ে যখন তার ডিভাইস আসক্তি হয় তখন বাস্তবিক অর্থে কি হয়-
- প্রথমত ডিভাইস ব্যবহারে তার মস্তিষ্ক একটা জায়গায় স্থির হয়ে যায়।কথা বলার আগ্রহও তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়।ফলে বাচ্চাটা ক্রমশ অসামাজিক এবং আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠে।
- চিন্তাশক্তি কমতে থাকে এবং মনের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হয়।ডিভাইসের অনেক জিনিস দেখে সে হয়তো ভয় পায়।সেই ভয় তার মধ্যে মানসিক অস্থিরতার জন্ম দেয়।অনেক সময় দেখা যায় ঘুমের মধ্যে বাচ্চারা ভয়ে চিৎকার করে উঠে।কারণ মোবাইলে সে এমন কিছু হয়তো দেখেছে যেটা ঘুমের মধ্যেও ট্রমার মতো কাজ করছে।
- বাইরে খেলাধুলা না করতে করতে ডিভাইস,খাওয়া আর ঘুমের একঘেয়ে জীবনে একসময় হীনমন্যতা, হিংসা এবং ক্ষোভের জন্ম নেয়।একটা সঠিক মানসিক বিকাশ চরমভাবে ব্যহত হয়।
- বাচ্চার কাছে বাস্তবিক জীবনের চেয়ে ডিভাইসে দেখা জিনিস গুলোই বেশি জীবন্ত মনে হয়। খুব অবচেতন মনে সেগুলোর অনুসরণ করে একসময়। যেমন ডিভাইসের খাওয়া নিয়ে রাক্ষুসে প্রতিযোগিতা দেখে সে অভ্যস্ত হয়ে যায়।সে কিন্তু ওইটাই সঠিক মনে করছে।
- কিছু ভ্রান্ত সামাজিক প্রথা,আচার,অনুষ্ঠান তার কাছে স্বাভাবিক হয়ে যায়।যার ফলে ক্রমেই ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে সে সরে যায়।
- সঠিক ভুলের হিসাব বুঝে উঠার আগেই নীল জগতের অনেক ভুল গল্পে হয়তো সে হারিয়ে যাচ্ছে আপনার অগোচরেই।যার প্রভাব পরবর্তী জীবনভর বাচ্চাকে এবং অভিভাবক হিসেবে আপনাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।অহরহই ঘটছে এমন অসংখ্য ঘটনা।
- বাচ্চার কাছে বরেণ্য ব্যক্তি(নবী,রাসূল,সাহাবী), বাবা-মা আইডল না হয়ে আইডল হচ্ছে ডিভাইসে দেখা চরিত্র গুলো।কারণ সে তাদের দেখছে,তাদের জানছে এবং তাদেরকেই অনুসরণ করছে। কার্টুন,হলিউড,বলিউড তার মনে যতটা জায়গা করে নিচ্ছে ততটা অন্যকিছু প্রভাব ফেলছে না।
ডিভাইসের শারীরিক ক্ষতি
ডিভাইসে ক্ষতি কেবলই কি মানসিক? বরং মানসিক ক্ষতির সাথে সমানতালে তাল মিলিয়ে শারীরিক ক্ষতিও করে যাচ্ছে।
দৃষ্টিশক্তি
দিনের একটা লম্বা সময় সে যখন ডিভাইসে চোখ,কান বুঝে থাকে তখন খুব স্বাভাবিকভাবে এতে চোখের উপর একটা বিরূপ প্রভাব ফেলে।দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ খারাপের দিকে পৌঁছায়। দীর্ঘ সময় ধরে ডিভাইসের ব্যবহার শ্রবণ শক্তিতেও মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ
ডিভাইসের কিছু ক্ষতিকর রশ্মি যার ভয়াবহতা ব্যাপক। এই রশ্মি মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত করতে পারে। টিউমার হতে পারে।এছাড়াও মাথা ব্যথা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে।
স্থুলতা বা ওবেসিটি
শহরের বেশিরভাগ বাচ্চাই দেখা যায় স্থুল স্বাস্থ্যের অধিকারী। কারণ তাদের শারীরিক পরিশ্রম হয় না বললেই চলে। গবেষণায় দেখা যায় যেসব বাচ্চা মাত্রাতিরিক্ত ডিভাইস ব্যবহার করে,ডিভাইসে গেইম খেলে অভ্যস্ত তাদের স্থুলতার পরিমাণ অনেক বেশি।কারণ কার্ব জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া এবং শারীরিক পরিশ্রম না করা।
ঘুমের ব্যাঘাত
অতিরিক্ত ডিভাইস আসক্তি ঘুমের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।একটা সময় এসে অতিরিক্ত চঞ্চলতা কিংবা অস্থিরতার জন্ম নেয়।
এছাড়া স্পিচ ডিলে নামক একটা শব্দ এখন খুব পরিচিত। বাচ্চার স্পিচ ডিলে বা দেরি করে কথা বলার একটা বড় কারণও এই ডিভাইস আসক্তি।
অতিরিক্ত ডিভাইস আসক্তি স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দিচ্ছে।বাচ্চার মধ্যে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি করছে।
ডিভাইস আসক্তি কমাতে করণীয়
ডিভাইসের সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার বাচ্চারাই হয়। গবেষকরা বলেন বাচ্চাকে দিনে সর্বোচ্চ ৪০-৪৫ মিনিট অথবা এক ঘন্টার বেশি ডিভাইস দেয়া উচিত না। অভিভাবক হিসেবে প্রয়োজনে আপনার নিজের ডিভাইস ব্যবহারের সময় সংকোচন করতে হবে। কারণ আপনার সন্তান আপনাকেই অনুকরণ করছে।
অভিভাবক হিসেবে আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয় শেষ বয়সে সন্তানের কাছে আপনি কি চান?বেশিরভাগ অভিভাবকই উত্তর দিবেন "সময়"। ঠিক সেরকমই সন্তানও আপনার কাছে একটু সময় চায়। তাকে প্রোডাক্টিভ কিছু সময় দিন।
তাকে নিয়ে প্রতিদিন ঘুরতে না নিয়ে যেতে পারুন কিন্তু ঘরে ফিরে তার সাথে গল্প করুন,আপনার শৈশবের গল্প শুনান,বাচ্চার নিজের কথা গুলো শুনুন,তার সাথে বসে ছবি আকুন,তার সাথে পাজল মিলান।এটুকুও কিন্তু বাচ্চার জন্য অনেক কিছু।
ডিভাইসের পরিবর্তে তার হাতে বই তুলে দিতে হবে।বইয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মাতে অভিভাবকদের নিজেদের হাতে বই তুলে নিতে হবে। নবী-রাসুলের জীবনী, বরেণ্য অন্যান্য ব্যক্তিদের জীবনী গল্পচ্ছলে শুনাতে হবে।মোটকথা তাদের আইডল ঠিক করার কাজটা শুরু করতে হবে শুরুতেই।
ছুটির দিনগুলোতে বাচ্চাকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে হবে।সে যেন প্রাণ এবং মাটির স্পর্শ পায় সেদিকে নজর দিতে হবে।
বাচ্চাকে আত্মীয়তার সম্পর্কের মানে বুঝাতে হবে।সময় পেলেই গ্রামে নিয়ে যেতে হবে।ডিভাইসের বাইরেও যে একটা সুন্দর জীবন তার জন্য অপেক্ষা করে আছে এটা বুঝাতে হবে।
বাচ্চাকে ডিভাইস দিয়ে খাবার গলাধঃকরণ না করিয়ে দিনে অন্তত একবার হলেও অভিভাবকরা বাচ্চাকে সাথে নিয়ে খাবার খান।খাবার শেষে গল্প করুন।
প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে সেই সময়ে কোরআন,হাদিস নিয়ে গল্প করতে হবে। ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিতটা শক্ত হওয়া ভীষণ প্রয়োজন।
শৈশবের দূরন্ত সময়ে একাকিত্ব এসে একটা বাচ্চাকে পড়ন্ত বিকেলের পৌঢ় বৃদ্ধ বানিয়ে ফেলুক এটা নিশ্চয়ই কারও কাম্য নয়। মাটি,প্রাণ,প্রকৃতি আর অভিভাবকদের না দিতে পারা সময়ের শুন্যতা পূরণে ডিভাইস নামক আসক্তিতে আপনার প্রিয় সন্তান জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য না হারাক।এটাই কাম্য। তাই ডিভাইস ব্যবহার সীমিত করুন নিজের জন্য,সন্তানের জন্য।