বাচ্চা সবচেয়ে বেশি অনুকরণ করে মা কে। মা যা করে বাচ্চাও তাই করে।
যেমন মা বই পড়তে বসল। বাচ্চারও বই পড়তে ইচ্ছা হবে।
মা রান্না করতে গেল। বাচ্চারও রান্না করতে ইচ্ছা হবে। মা ঠিক কি কি রান্না করছে, কিভাবে রান্না করছে সেটা না দেখলে তার যেন চলবেই না।
মোটকথা মা যা যা করবে বাচ্চাকেও তাই করতে হবে।
কিন্তু মা এক প্লেট ভাত নিয়ে খেতে বসেছে। বাচ্চার কিন্তু এই মূহুর্তে খেতে ইচ্ছা করবে না।
এই মুহূর্তে মায়ের সাথে বাচ্চার আচরণ হবে বিরোধী দলের মতো। মা যেদিকে বাচ্চা অন্যদিকে।
অথচ তাকে যদি কোল্ড ড্রিংকস, চিপস, চকলেট খেতে বলেন সে কিন্তু বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিবে।
বাচ্চাকে তিনবেলা ভাত কিংবা হোম মেইড খাবার খাওয়ানো। মায়ের কাছে রীতিমতো একটা যুদ্ধের নাম।
বাচ্চার সাথে গল্প, কবিতা, খেলায়, মোবাইল দেখিয়ে ইত্যাদি নানা টালবাহানায় বাচ্চাকে কয়েক লোকমা ভাত খাওয়াতে পারা মায়ের জন্য যুদ্ধ জয়ের নামই বটে। বাচ্চার ছয় মাস বয়স থেকে শুরু হয় এই সলিড যুদ্ধ।
তো সেই সলিড শুরু করার কিছু সনাতন পদ্ধতি আছে। যুগে যুগে গ্রাম থেকে শহরে যেটা প্রচলিত।
বিষয়সূচী
প্রচলিত প্রথা গুলো ঠিক কি কি
🔸 বাচ্চা খেতে চাইছে না। জোর করে বাচ্চার মুখে খাবার দেওয়া। খাবার গিলতে না চাইলে গালে হালকা চাপ দিয়ে ধরে রাখা যতক্ষণ বাচ্চা খাবার না গিলে।
🔸 বাচ্চাকে চিত করে শুইয়ে চামচ দিয়ে মুখে খাবার ঢুকিয়ে দেয়া। এক বাটি খাবার শেষ করে তবেই বাচ্চাকে বসতে দেয়া।
🔸 বাচ্চার পেছনে খাবার নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা লেগে থাকা। এক প্লেট ভাত যতক্ষণ শেষ না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করা।
🔸 বাচ্চাকে চড়, থাপ্পড়, বকাঝকা দিয়ে খাবার খাওয়ানো।
🔸 বাচ্চাকে সুজি অথবা চালের গুড়া চিনি আর দুধ দিয়ে রান্না করে খাওয়ানো।
🔸 ভাত না খেলে ভূতের ভয় দেখানো।
পুরাতন শেষে বর্তমানের গল্পে ফেরা যাক।এখনকার অনেক মায়েরাই বাচ্চার পেট ভরাতে কি কি করেন?
মায়েদের ভুল
🔹 সলিড শুরুর দিন গুলোতে সবকিছুর পিউরি খাওয়ানো।
🔹 বাচ্চা রান্না করা খিচুড়ি খাচ্ছে না। খিচুড়ি ব্লেন্ড করে খাওয়ানো।
🔹 বাচ্চাকে টিভি অথবা মোবাইল দেখিয়ে খাবার খাওয়ানো। খুব পরিচিত একটা সমস্যা।
🔹 বাচ্চার জন্য বাজার থেকে নিত্যনতুন বিদেশী খাবার, ফলমূল ইত্যাদি আমদানি করা।
এই যে বাচ্চার খাওয়া নিয়ে এত এত পরিশ্রম। তারপরও কেন এত এত বাচ্চা প্রতিনিয়ত অপুষ্টিতে ভুগছে? কেন বাচ্চা খেতে চাইছে না? কেন খাবারের প্রতি অনীহা দিনের পর দিন বেড়েই চলে?
আসল কথাটা হল খাবারের ক্ষেত্রে বাচ্চাকে স্বাধীনতা না দেয়া। খাবার নিয়ে বাচ্চারও যে একটা মতামত থাকতে পারে এটাকে গুরুত্ব না দেয়।
খাবারটা গিলানোই যখন একমাত্র লক্ষ্য হয় তখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় বাচ্চার খাবারের প্রতি আগ্রহ জন্মে না। তাকে একদিন দুইদিন ভুলিয়ে, জোর করে খাবার খাওয়ালেন কিন্তু প্রতিদিন সম্ভব নয়।
বাচ্চার খাবার খাওয়াতে কিছু করণীয়
✅ সলিড শুরুর দিন গুলো থেকেই জোরাজোরি করে খাওয়ানোর চিন্তা বাদ দিন। বাচ্চাকে খাবারের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হতে দিন। বাচ্চাকে আস্ত ফল, সবজি স্পর্শ করতে দিন।
✅ বাচ্চার সলিড শুরু মানে বুকের দুধের পাশাপাশি অন্য খাবারে অভ্যস্ত হওয়া। সলিড শুরু মানেই তিনবেলা পেটপুরে খাবে এমনটা নয়।
✅ পিউরি অথবা ব্লেন্ডেড খাবারের মধ্যে খাবারের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। পারতপক্ষে এই জিনিস না দেয়াই ভালো।
✅ তিনবেলা বাচ্চাকে খিচুড়ি দিলে খুব স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চার সেটা ভালো লাগবে না। বাচ্চাকে এক বেলা খিচুড়ি দিলে অন্যবেলায় অন্য কিছু দিতে হবে। আর খিচুড়ি একদম খেতে না চাইলে খিচুড়ির বিকল্প যে খাবার গুলো দেয়া যায় সেগুলো দিতে হবে। যে করেই হোক খিচুড়ি দিতেই হবে এমনটা যেন না হয়।
✅ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বাচ্চাকে হাড়ির খাবার দিন। মানে নিজেরা যা খান তাই খেতে দিন। বড়দের জন্য যেটা ক্ষতিকর বাচ্চার জন্যও সেটা ক্ষতিকর। যেমন অতিরিক্ত তেল, ঝাল, মসলা, চিনি, লবণ।
বাচ্চাকে হাড়ির খাবার দেয়ার আরেকটা বড় সুবিধা হল পরবর্তীতে বড় হয়ে এটা খাব না, ওটা খাব না শব্দ গুলো বলবে না পারতপক্ষে।
✅ ঘুম থেকে উঠার সাথে সাথে বাচ্চার সামনে খাবার নিয়ে হাজির হবেন না। নিশ্চয়ই আপনি ঘুম থেকে উঠার সাথে সাথে এক গামলা ভাত খেতে পারবেন না। বাচ্চাকে ক্ষুধার অনুভূতি হতে দিন। ক্ষুধা লাগলে সে নিজে থেকেই খেতে চাইবে। প্রতিবেলা খাওয়ানোর আগে অন্তত এক দুই ঘন্টা আগে অন্য খাবার দেয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।
✅ দেশীয় প্রচুর ফলমূল আছে যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। বিদেশী মানেই ভালো এই ধ্যান ধারণা পরিবর্তন জরুরী।
✅ বাচ্চার পেট অত্যন্ত ছোট। আপনার নিজের প্লেট, নিজের পাকস্থলীর সাথে বাচ্চাকে কম্পেয়ার করা বন্ধ করুন।
✅ এক দুই বছর থেকেই তাকে জিজ্ঞেস করুন সে কি খেতে চায়। বাসায় যে যে খাবার গুলো রান্না হয়েছে তার নাম বলুন। তারপর তার যেটা আগ্রহ সেটা দিয়েই খাওয়ান। এটার সুবিধা হল প্রথমত বাচ্চার খাবারের প্রতি আগ্রহ জন্মাবে। দ্বিতীয়ত নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা জন্মাবে।
✅ মোবাইল, টিভি দেখিয়ে খাবার খাওয়ানো বন্ধ করুন। শিশু বিশেষজ্ঞরা এই ব্যাপারে সবসময় নিষেধ করেন। কারণ বাচ্চা মোবাইল টিভি দেখে খাবার খাচ্ছে মানে সে জানে না সে আসলে কি খাচ্ছে। তাছাড়া খাবার খাওয়ারও যে একটা সুন্দর নিয়ম আছে এটা সে শিখতে পারে না।
✅ বাচ্চাকে নিয়ে এক টেবিলে সবাই একসাথে খেতে বসুন। বাচ্চারা এইভাবে খাওয়াটা খুব উপভোগ করে। এছাড়া এর মাধ্যমে একটা সুন্দর পারিবারিক সম্প্রতিও তৈরি হয়।
✅ বাচ্চাকে আপনার হাতে খাইয়ে দেয়ার পাশাপাশি বাচ্চার নিজের হাতেও খেতে দিন। নিজের হাতে বাচ্চারা বেশি তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারে।
চাইলে বাচ্চাকে ফিডিং চেয়ার দিতে পারেন।
বাচ্চার খাবার নিয়ে বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি। দুটোই বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর। খাবারের পরিমাণের থেকে পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা বেশি। বাচ্চা স্থুল হওয়ার থেকে সুস্থ হওয়া জরুরী।