ঢাকায় আসার পর আমার স্বামীর একটা মেজর অপারেশন হল। আমি আর আমার সতের মাসের ছোট্ট মুয়াজ তখন হসপিটাল এটেনডেন্ট হিসেবে ছিলাম চারদিন। রমজান মাস চলছিল তখন। ক্লান্তিতে ভেঙে আসা শরীর দেখে একপ্রকার বুঝে গিয়েছিলাম হয়তো আমি কনসিভ করেছি।

চাচ্ছিলামই অল্প গ্যাপে সন্তান আসুক। বাড়ি ফিরে চেক করে দেখলাম আলহামদুলিল্লাহ মুয়াজ একটা ভাই বা বোন পেতে যাচ্ছে। এর মধ্যেই মুয়াজের একটা বড় অসুখ হল। কী অসুখ ডাক্তাররা ধরতে পারেন না। তখন ঢাকায় নতুন। আমার প্রথম ট্রাইমেস্টার গেল মুয়াজকে নিয়ে হসপিটাল দৌড়াতে দৌড়াতে। ঢাকার বড় কোন হসপিটাল বাদ থাকল না। প্রেগন্যান্সির কথা ভুলে বুকের মানিককে নিয়ে সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনই হসপিটালে কাটতে লাগল। যেদিন ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট বা কোন টেস্টের দিন থাকত সেদিন মুয়াজের সারাদিনের খাবার দাবার রেডি করে নিয়ে যেতাম। ভাত, তরকারি, ফলমূল, দুধ, নাস্তা সব। হসপিটালের ক্যান্টিনে খেয়ে নিতাম আমরা, সাথে বাবুর খাবারগুলো গরম করে নিতাম।

মুয়াজের হাড়ের টিবি ধরা পড়ল। খুবই রেয়ার কেইস বাচ্চাদের জন্য। ট্রিটমেন্ট শুরু হল আলহামদুলিল্লাহ। 

শারীরিকভাবে খুব দূর্বল হয়ে পড়লাম আমি। এত দুর্বল আগে কখনও হই নি। এত বেশি মর্নিং সিকনেস, মুয়াজের অভারঅল দেখাশোনা, ওর ডাক্তারদের এপয়েন্টমেন্টস, ওর ওষুধ খাওয়ানো,  বাড়ির সব কাজ, সবমিলিয়ে আমার শোচনীয় দশা হয়ে গেল।

যেহেতু আমার কম গ্যাপে সন্তানের ইচ্ছা ছিল এজন্য এমন মায়েদের জার্নি নিয়ে জানার চেষ্টা করতাম। বিভিন্ন গ্রুপে  কম গ্যাপে ২য় বাচ্চা হওয়া  মায়েদের শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে দেখে একটা ব্যাপার বুঝতে পারছিলাম যে শরীরকে স্ট্রং রাখার কোন বিকল্প নাই,  খাবারের ঘাটতি হতে দেয়া যাবে না। একটা দুধের বাচ্চা,  তার দেখাশোনা সেই সাথে শরীরে আরেকজনকে বড় করা আবার সংসার আগলে রাখা ; এই সবকিছু ঠিকভাবে পার করতে হলে আমার দরকারি পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। এটা নিয়ে আমি কাজ শুরু করলাম।

কিন্তু মর্নিং সিকনেস এত বেশি ছিল যে টাফ হয়ে যাচ্ছিল। আমার ফুপুকে এজন্য আনলাম। ফুপু প্রায় দেড় মাস ছিলেন। গ্রামের মানুষ বন্দি থাকতে পারছিলেন না। এরপর চলে গেলেন। উনার চলে যাওয়ায় সবাই খুব রাগ হয়েছিল।  কিন্তু আমি আর ওদের বাবা খুবই কৃতজ্ঞ ছিলাম। পুরো প্রেগন্যান্সি থাকলে তো ভালই হত কিন্তু এই দেড়টা মাস যে থেকে গেছেন এটাই আমাদের জন্য বিশাল একটা হেল্প ছিল আলহামদুলিল্লাহ। 

আল্লাহ কখনও আমাকে একা ছাড়েন নি। প্রথম প্রেগন্যান্সির সময়ও ছত্রিশ সপ্তাহ পর্যন্ত একাই ছিলাম।  আল্লাহ পার করিয়ে নিয়েছিলেন আলহামদুলিল্লাহ। এবার তো দেড়মাস ফুপু দেখে গেলেনই। এরপর আমি খুব দ্রুত নিজেকে গুছিয়ে নিলাম আর আল্লাহ সব সহজ করেও দিলেন। আমার পুরো পরিবারের জন্যই সুস্বাস্থ্য ফোকাস করে একটা রুটিন জরুরি ছিল। কিছুদিন আগে মেজর একটা অপারেশন করে ফেরা আমার স্বামী, টিবির মত ঘাতকব্যাধি নিয়ে আমার এতটুকুন শিশুসন্তান আর আরেকটি প্রাণ বয়ে বেড়ানো আমি ; প্রত্যেকের জন্যই।

মুয়াজের ওষুধ চলবে টানা একবছর পর্যন্ত।  একটা ডোজও মিস করা যাবে না, মিস করলেই আবার শুরু থেকে শুরু। সাথে তার খ্যাদ্যাভাস ঠিক রাখা। আলহামদুলিল্লাহ সে ওজন হারাচ্ছিল কিন্তু  যা খাচ্ছিল আমি সন্তুষ্ট। 

মুয়াজ নরমাল ডেলিভারির বাবু। এবারও একই প্ল্যান। আগেরবারের মত এবারও আমরা কারও সাথে ইডিডি শেয়ার করিনি। অপ্রয়োজনীয় কোন ডক্টর ভিজিট এবং আল্টাসনোগ্রামও করিনি। আগেরবারের ডক্টরকেই এবারও পেয়ে গেছি হাতের কাছেই । ডাক্তার প্রতিমাসে চেকআপের জন্য বললেও আমি প্রথম ট্রাইমেস্টারে একবার,  দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে একবার (এনোমালি স্ক্যান) এবং তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে  একবার এই তিনবার ডাক্তার ভিজিট ও ইউএসজি করি। 

দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার পর্যন্ত আমি কেবল খাওয়া আর ঘুম ঠিক রাখলাম আর বাড়ির সব কাজ করতে থাকলাম। আমার স্বামী চাচ্ছিল আমি যেন কাজ সহজ করি,  মানুষ দিয়ে করায়ে নিই। যেহেতু রোজ হাঁটতে যাওয়া আমার জন্য সম্ভব ছিল না এজন্য পুরো প্রেগন্যান্সিজুড়ে বাড়ির কাজ করাটাই আমার জন্য একটিভ থাকার পক্ষে সহায়ক ছিল। ঘরমোছা আর বাথরুম ক্লিনের জন্য আগের মতই মানুষ থাকল। বাকি কাজ নিজে করতে থাকলাম।

তৃতীয় ট্রাইমেস্টার থেকে আমি বিভিন্ন রিসোর্স রিভাইজ করা শুরু করলাম। বড়পুত্র হওয়ারও আগে থেকে প্রেগন্যান্সি ও লেবার নিয়ে পড়তে ভাল লাগত। সেসব ওয়েবসাইট, ইউটিউব চ্যানেল ঘাঁটাঘাঁটি, বিভিন্ন ডুলাদের ভিডিও, নরমাল বার্থের ভিডিও দেখা এবং বার্থস্টোরি পড়া। এগুলো নিজেকে এম্পাওয়ার করতে খুব হেল্পফুল ছিল আলহামদুলিল্লাহ।  

বড়পুত্র হয়েছিল বিয়াল্লিশ তম সপ্তাহে। সুতরাং এবারও ধরেই নিলাম ইডিডি পার হবে। ইডিডির ঠিক চারদিন আগে মা আর লআম্মাকে (চাচি) আনলাম। এবার তো ইডিডি বলাই লাগে। এই চারদিনে আমার মাথা খারাপ করে ফেললেন দুজন, যদি বাবুর কিছু হয়ে যায়, হেন হয় তেন হয়, একটা যেন আল্ট্রা অন্তত করে দেখি কী অবস্থা। কিন্তু আমি কেবল হাসি আর ঘুরে বেড়াই। তাদের এদিক ওদিক ঘুরতে পাঠাই যাতে বোর হয়ে না যান।

ছত্রিশ সপ্তাহের পর থেকে আমি আমার স্কোয়াটিং আর হাঁটাহাঁটি প্রতিদিন শুরু করেছিলাম। তারা আসার পর সেসব ডাবল করে দিলাম। লআম্মার সাথে নদীর ধার পর্যন্ত হেঁটে যাই আবার আসি। দুই  ঘন্টা টানা  হাঁটি  দিনে। বাড়ির সব কাজ এজ ইউজুয়াল আমি করি। মা কুটে বেছে দেন। আমি কেবল চাচ্ছিলাম লআম্মা মুয়াজের খাওয়ানেটা রপ্ত করুক। লেবার একটা দিনেরই ব্যাপার। কিন্তু মুয়াজের টিবির ওষুধ খাওয়ানোর সাথে খাবারের ব্যাপারটাও খুবই রুটিনমাফিক আর গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

ইডিডি পার হয়ে গেল। কোন লক্ষণ নাই। আরও একটা সপ্তাহ গেল কেন লক্ষণ নাই। বাড়ির লোক পাগল করে ফেলল। কেবল ওদের বাবা আগেরবারের মতই পূর্ণ আস্থা রেখে চুপচাপ থাকেন। আমি বুঝে গেলাম মুরুব্বিরা তাদের কনসার্ণ প্রকাশ করবেনই, এটা নিয়ে এত মাথা খারাপ করার কিছু নাই। আমি লেবারে পূর্ণ ফোকাস দিলাম।

রোজদিন অপেক্ষা করি। হাঁটতে যাই। এসে রান্না করি। রেস্ট নিই। বিকেলে আবার হাঁটতে যাই। সন্ধ্যায় নাস্তা বানাই। দিনগুলি সুন্দর ছিল। একদিন হেঁটে মোহাম্মদপুর গিয়ে অনাগত সন্তানের জন্য কিছু শীতের কেনাকাটা করেও এলাম। 

পনের তারিখ সকালে প্রথমবারের মত ব্যাথা শুরু হল। এতটাই মাইল্ড যে আমি ব্রেক্সটন হিকস ভেবে আমলে নিলাম না। ঘড়ি দেখে ট্র্যাক করছিলাম অবশ্য। সারাদিন ঘন্টায় চারবার করে ব্যাথা আসে খুবই সামান্য থেকে চলে যায়। ঠিক পনের মিনিট পর আবার আসে। বাসার কাউকেই কিছু বলছি না। 

যেহেতু সারাদিনই একটা ট্র্যাকে থাকল, তখন মনে হল এটা লেবার পেইনই হবে। সন্ধ্যায় ওদের বাবাকে কল দিয়ে বললাম আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে। এদিকে আমি পরদিনের সমস্ত রান্না করে ফেললাম। হসপিটাল ব্যাগ কয়দিন আগে গুছিয়েছিলাম, সেটা আবারও রিচেক করলাম। বড়পুত্রকে খাওয়ায়ে দিলাম। সবার খাওয়া শেষে গুছিয়ে কিচেন ক্লোজ করলাম। বিছানাগুলো বদলে ফেললাম যাতে বাবু এলে পরিষ্কার বিছানায় থাকতে পারে। ঘরদোর পরিপাটি করে নিলাম। রান্নার কোথায় কী আছে সবকিছু মা আর লআম্মাকে আরেকবার বুঝিয়ে দিয়ে প্রায় সবকাজ শেষ করলাম। এখন বুঝি সেসব আসলে নেস্টিং বিহেভিওর ছিল।

সন্ধ্যায় ঘন্টাখানেক মাইলস সার্কিটের পাছু উঁচু করে শোয়া পজিশনে ছিলাম যাতে পেইনের ফ্রিকোয়েন্সী বাড়ে। বাড়ল আলহামদুলিল্লাহ। রাত আটটার পর থেকে ব্যাথা দশ মিনিট পর পর আসতে লাগল কিন্তু ডিউরেশন খুবই অল্প ৩০-৩৫ সেকেন্ড। ওদের বাবা এলে প্রথমবারের মত সবাই জানল আমার পেইন শুরু হয়েছে। তখন আমি মুয়াজের ২-৩ দিনের টিবির  ওষুধ, স্টিক, কাপ, গ্লাস সবকিছু একটা বক্সে নিয়ে ওর বাবাকে বলে রাখলাম ওষুধ খাওয়ানোর সবকিছু। ওর জামাকাপড়, স্ন্যান্কস, খেজুর সবকিছু গুছিয়ে রাখলাম।

মুয়াজের ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারটা এই প্রথমবার অন্য কারও থেকে হবে, এটা মুয়াজকেও ভাল করে বুঝিয়ে বলেছি গত কিছুদিন থেকে। “মা গেদুবাবু আনতে হসপিটালে যাব, তুমিও যাবে। তখন বাবা ওষুধ খেয়ে দিবে। ঠিকাছে? মা তখন থাকব না,  তুমি সুন্দর করে খেয়ে নিবে। গেদুবাবুকে নিয়ে এরপর মা তোমার কাছে চলে আসব।” আল্লাহ সবকিছু সহজ করেছিলেন। 

সবকাজ হয়ে গেলে আমি পেটপুরে খেয়ে নিলাম। রাতটা খুব আরাম করে ঘুমাতে চাই বললাম ওদের বাবাকে। কারণ হসপিটাল ত্রিশ চল্লিশ মিনিটের দূরত্বে ছিল আর পেইন দেখে আমার মনে হচ্ছিল রাতটা পাব ইনশাআল্লাহ।  এতক্ষণ পর্যন্ত আমি খুবই শান্ত, স্থির আর ভাল ফিল করছিলাম। কিন্তু ওদের বাবা হঠাৎ এম্বুলেন্স ডেকে ফেলল। ও চাচ্ছিল আমরা হসপিটালে গিয়ে অপেক্ষা করি। এই প্রথমবারের মত আমি অত্যন্ত বিরক্ত হলাম।

ঘুম আসলে খুব দরকার ছিল। আমি মোটেও এখন হসপিটালের ফরমালিটির মধ্যে দিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম না৷ লম্বা লেবারে যে পরিমাণ শক্তি লাগবে সেজন্য রাতটা আমি আমার মত ভাল করে ঘুমিয়ে নিতে চাচ্ছিলাম খুব করে। যাই হোক, ফোন দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে এম্বুলেন্স চলে এল। সবকিছু রেডিই ছিল। যাবার সময় কেউই বাসায় থাকতে চাইল না। সবাই মিলে প্রায় রাত বারোটার আগে আগেই হসপিটালে পৌঁছে গেলাম আমরা।

প্ল্যান হল কেবিনে সবাই অপেক্ষা করবে, আমি থাকব প্রি-লেবার রুমে। কিন্তু কেবিন পাওয়া যাচ্ছিল না। আমার স্বামী ডাক্তারের সাথে কথা বলে সেসব ফরমালিটিস শেষ করতে গেল। ওসব শেষ না হলে এদিকে আবার প্রি-লেবার রুমে এন্ট্রি হওয়া যাচ্ছিল না।  যা হয় হোক, এসব একদমই বিচলিত করছিল না আমাকে। আমি আমার নিজের দিকে ফোকাস রাখার চেষ্টা করলাম। কেবলই ভাবছিলাম রাতটা আমার ঘুমাতে হবে। মুয়াজ জেগে গিয়েছিল এম্বুলেন্সেই। হসপিটালের লম্বা করিডোরে আমি আর মুয়াজ হাঁটা শুরু করলাম, এমাথা-ওমাথা। ওর দুই বছরের এই ছোট্ট জীবনে এই প্রথম রাত যা সে মা ছাড়া কাটাতে যাচ্ছে। মায়ের বুকের মধ্যে ছাড়া তার ঘুম আসে না। আজ কীভাবে ঘুমাবে জানি না। ওর বাবা সাথে আছে এটাই আমার একমাত্র স্বস্তি। 

বেশ লম্বাটে একটা রুম। সারি সারি বেড। সব বেডেই মায়েরা শুয়ে আছে। ব্যাথায় কাতরাচ্ছে সবাই। সাথে একজন করে আছে। আমি কাউকে রাখিনি। মুয়াজের কাছে থাক সবাই, ও কার কাছে আরাম পাবে কে জানে। এই রুমে এসে সবচেয়ে বিরক্তিকর যেটা হল আমার বেড; একদম নার্স লাউঞ্জে লাগোয়া, মাথার উপর চড়া আলো,  একপাশে নার্সদের কেবিনেট, আর ঠিক সামনে নার্সদের টেবিল। সবকিছু ভুলে আমি নিজের দিকে ফোকাস করার চেষ্টা করছি। বেডের চারপাশে পর্দা টেনে ছড়িয়ে দিলাম। নার্স এসে ওদের কেবিনেটের পাশটা খোলা রাখতে বলল। আমি বললাম পুরোটাই আবৃত লাগবে আমার। লাইটও বন্ধ লাগবে। বেড ঠেলে খানিক সরিয়ে নিলাম যাতে তাদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন হয়। খিমার খুলে চুলগুলো ভাল করে বেনি করে নিলাম। এতক্ষণে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। ব্যাথা সেই দশ মিনিট পরপর ৩০-৩৫ সেকেন্ড স্থায়ী। বেশ কষ্ট হচ্ছে এখন, কিন্তু অসহনীয় নয়। এমন সময় নার্স এল। কিছু একটা ইনজেকশন হাতে। বললাম যা দেয়ার সকালে, এখন ঘুমাব। সে বলল, এটা এলার্জি চেক করতে দিবে অল্প একটু চামড়ার নিচে। এরপর কী? বলল, আর কিছুই না।  তখন দিতে দিলাম। ইনজেকশনের জায়গায় সে কলমে গোলদাগ দিয়ে চলে গেল। আমি ঘুমালাম।

খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল। ফজর পড়তে পারলাম। ব্যাথা একই ইন্টারভালে একই ডিউরেশনে আছে। এবার মাইলস সার্কিট পজিশনে আবার ঘুমিয়ে গেলাম।  প্রায় দুই ঘন্টা পর জেগে খুবই খিদা পেল। সাথে অসহ্য ব্যাথা।  কথা বলার মাঝে থেমে যেতে হচ্ছে। লআম্মা নাকি দুইবার ঘুরে গেছে আমি ঘুমাচ্ছিলাম। মুয়াজের আব্বা বলে দিয়েছে নাকি ঘুমিয়ে থাকলে না ডাকতে এজন্য এসে ফিরে গেছেন। তখন সকাল আটটা বেজে গেছে। মুয়াজের আব্বাকে ক্যান্টিন থেকে দুইটা ডিম, গরম স্যুপ আর রুটি তরকারি পাঠাতে বললাম। খেজুরগুলোও আনতে বললাম। 

মুয়াজ নাকি সারারাত বাবার বুকে ঘুমিয়েছে। কারও কোলে যায় নি। ওকে ঘড়ি ধরে ওষুধ খাওয়াতে এবং দুধ -রুটি খাওয়াতে বলে দিলাম। 

খাবার যখন এল কন্ট্রাকশন এত বেশি শক্তিশালী আসছিল যে হতদ্যম হয়ে যাচ্ছিলাম। ডিমের খোসাটা পর্যন্ত ছাড়াতে  পারছিলাম না। এদিকে খিদেয় বেহুশ।

একটা করে কামড় দেই আর গিলতে পারি না। এতটাই শক্তিশালী যে আমার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছিল। লেবার কতক্ষণ থাকবে জানা নাই। কিন্তু কিছুই খেতে পারছিলাম না, এই মুহুর্তে খুব অসহায় লাগছিল। খেজুর আর ডিম দুইটা কোনমতে জোর করেই খেলাম। আর পানি। খুব খেতে ইচ্ছে করছিল সবগুলো খাবার  কিন্তু আর কোনকিছুই খাওয়ার শক্তি ছিল না। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। 

লআম্মা অনেক প্রশ্ন করছিল, খাওয়ানোর চেষ্টা করছিল আর এটা-ওটা গল্প। আমার একা থাকতে মন চাচ্ছিল। মুয়াজকে নিয়ে আসেন বলে তাকে পাঠিয়ে দিলাম। বিছানার একপাশ ধরে স্কোয়াট করছিলাম, আরাম হচ্ছিল না। খাওয়ার পর বেশ শক্তি আসছিল শরীরে।  বিছানা গুছিয়ে খিমারটা পরে পুরো পর্দা সরিয়ে দিলাম। হাঁটতে চাচ্ছিলাম। এরমধ্যে দুইবার জুনিয়র ডাক্তার এসে লেবার রুমে জেলপুশ করতে নিতে চেয়েছে। আমি যাচ্ছি যাব বলে ফেরত পাঠিয়েছি।  জেলপুশ যে কি জিনিস বুঝতে পারলাম না। এখন মনে হয় সেটা প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন জেল হতে পারে। আমি কোন পিটোসিন নিব না বলে যাই নি অবশ্য।  

এ সময় আমার মনে পড়ল সকালে আমি হাগু করিনি। হাগুর খুব চাপ আসছিল। রুমটা লম্বা হওয়ায় হাঁটছিলাম,  যখন একেকটা কন্ট্রাকশন আসছিল দেয়াল বা পিলার ধরে সামলে নিচ্ছিলাম। অসহ্যের কাছাকাছি চলে যাচ্ছিল ব্যাথা। লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছিলাম, বেশ সহজ হচ্ছিল।  একপাশের ওয়াশরুমে গেলাম, বন্ধ। ভিতরে কেউ আছে। কয়েকটা কন্ট্রাকশন অপেক্ষা করলাম। কিন্তু কেউ বেরোয় না। অপরপাশের ওয়াশরুমের দূরত্ব কাছে হলেও তখন আমার কাছে মনে হচ্ছিল সেটা এক সমুদ্র দূর। গেলাম,  ওটাও ভিতর থেকে বন্ধ!  আবার আগেরটাতে ফেরত এলাম। এবার খোলা পেলাম।

বাথরুম করতে বসার পর বাথরুম হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল আরও চাপ দেয়া লাগবে। আরও অনেক বেশি চাপ। কিছুক্ষণ পর আমার হঠাৎই মনে হল এটা বাবুর চাপ না তো! বাবু যদি এই জায়গায় হয়ে যায়!

তাড়াতাড়ি উঠে হাত ধুয়ে ওযু করে বের হয়ে এলাম। মনের মধ্যে কেমন একটা আবেগ ভর করেছে তখন,  যদি আর ফেরত না আসি! এসেই আবারও দেখি ডাক্তাররা এসছে নিতে। যেতেই চাচ্ছিলাম না। অবশেষে এই প্রথমবারের মত পিভি চেক করতে দিলাম। ৭ সেমি ওপেন। জুনিয়র ডাক্তারগুলো ভড়কে গেল, “ম্যাডাম আমাদের মেরেই ফেলবেন, তাড়াতাড়ি চলেন প্লিজ, আর না বইলেন না। সেকেন্ড লেবার, যেকোন সময় বেবি বেরিয়ে আসবে আপনার। ” 

এবার আর “না” করা গেল না। কিন্তু আমি আমার বড়পুত্রকে না দেখে তো যাব না। ওরা আমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছিল আর আমি বলেই যাচ্ছিলাম, “আমার বাবুকে নিয়ে আসেন, ওকে একটু  দেখব। একবার বুকে নিব।”  লেবার রুমে আমার ডাক্তার এই কথা শুনতে পেয়ে নার্সদের  বলল সামনে থেকে ওদের বাবার থেকে মুয়াজকে নিয়ে আসতে। আমার তখন এতটা ভাল লাগছিল যে খুশিতে কান্না পেয়ে গেল। 

এবার হল আরেক অপছন্দের জিনিস ; ডেলিভারি টেবিল। এভাবে শুয়ে তো আমি থাকব না। ডাক্তার তখন বেড উঁচু করে দিলেন। তবুও আমি স্কোয়াট করতে চাইলাম ফ্লোরে। কিন্তু ততক্ষণে ক্রাউনিং হয়ে গেছে। তীব্র পেইনের সাথে এতসব আর্গুমেন্ট করছিলাম আর যতক্ষণ কনট্রাকশন থাকছিল আমি কেবল “আল্লাহু আকবার”, “ লা হাওলা ওয়া লা ক্বুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ”, “হাসবিয়াল্লাহ”, “ ইয়া আল-ফাত্তাহ” এসব উচ্চস্বরে বলছিলাম। বেশ কিছু দুয়া মুখস্থ করেছিলাম লেবার সহজ হওয়ার, কিছুই মনে ছিল না তখন। 

ডাক্তারকে আগেই বলা ছিল এপিশিওটমি না দিতে কিন্তু ঘ্যাচ করে খানিকটা দিয়ে দিলেন। সবই বুঝতে পারছিলাম। এরপরই বাবু বেরিয়ে এল। কি যে শান্তি সুবহানাল্লাহ! ডাক্তার বললেন, এবার একটা কন্যা লাগবে, নাসরিন। কী বল? আমি  হেসে বললাম, অবশ্যই ইনশাআল্লাহ। এত তাড়াতাড়ি সবকিছু হয়ে গেল, বিশ্বাসই হচ্ছিল না। লেবার রুমে সর্বোচ্চ আধাঘন্টা হবে এসেছি। সকাল এগারটার বেশি বাজে নি তখন। সেলাই দিতে দিতে ডাক্তারের সাথে গল্প করছিলাম। এপিশিওটমি দেওয়ায় বেশ মনঃক্ষুণ্ন হয়েছি বললাম। সেলাই যেন সুন্দর হয় আর সাথে এটাও বললাম প্রথমবার ইনফেকশন হয়ে বেশ কষ্ট পেয়েছি, এবার যেন শক্তিশালী এন্টিবায়োটিক দেয়।

পোস্ট-ডেলিভারি রুমে বাবুকে দিয়ে গেল। সত্যি বলতে প্রথমবার বাবুকে কোলে নিয়ে মনে হচ্ছিল এ কার বাচ্চা আমাকে দিয়ে গেল! মোটেও নিজের বাবু মনে হচ্ছিল না। আসলে ব্রেইনে সেই গেদু মুয়াজের ছবিই সেঁটে গিয়েছিল! ফিডিং করালাম। চুমু দিলাম। পা এত লম্বা যে ঠ্যাংএর সাথে ভাঁজ হয়ে আছে!

কেবিনে এলাম দুপুর হয়ে এসেছে তখন। গোসল দিলাম। দুপুরের খাবার নিজে খেলাম। মুয়াজকে খাওয়ালাম আর গল্প করলাম। সে খুবই খুশি একটা গেদু ভাই পেয়ে। চেপে ধরছে একটু পর পর গিয়ে। বিকেলের আগেই হসপিটাল ছেড়ে বাসায় চলে এলাম। 

বড়পুত্র হওয়ার সময় বাড়ি ফিরে আমি একটা ঘন্টাও রেস্ট নিই নি। সেটার জরুরত আমি ফিল করেছি পরে বহু বহুদিন পর্যন্ত । এবার তাই মা আর লআম্মা এলেও তখন কোন কাজ করতে দেইনি কারণ প্ল্যান করে রেখেছিলাম ডেলিভারির পরের দুই সপ্তাহ আমি পুরোপুরি রেস্ট নিব।

পিঠাপিঠি সন্তান নিয়ে রেস্ট নেওয়া হয়তো বাস্তব কথা নয়, কিন্তু আমি পুরো দুইটা সপ্তাহ সাংসারিক কোন কাজেই নামিনি। শারীরিকভাবেও না, মাথাও দেই নি কোথাও। যা করার কর তোমরা। আমি কেবল ছোটজনকে খাইয়েছি আর চেঞ্জ করে দিয়েছি আর পুরোটা সময় বড়জনকে লেপ্টে রেখেছি আর গল্প করেছি ছোট আসায় তার কী কী মজা হবে সেসব। বাকি সময় ঘুম। 

আলহামদুলিল্লাহ এবারের প্রেগন্যান্সি ও লেবার আমার জন্য আল্লাহ অনেক অনেক সহজ করেছিলেন। আরও সহজ ছিল রিকভারি পিরিয়ড।   সহজ তো আল্লাহই করেন। হাসবিয়াল্লাহ ওয়া নি’মাল ওয়াক্বিল।