প্রসব বা লেবার নারী জীবনের অন্যতম বড় ঘটনা। এই বড় ঘটনা ঠিকমতো পাড় করতে আপনার প্রস্তুতি দরকার। কারণ লেবারের শারীরিক বেদনা মানুষের সাধারণ ব্যাথা সহ্য করার সীমা ছাড়িয়ে আরো কিছু বেশি (৪৫ ডেল বনাম ৫৭ ডেল)।

এই প্রস্তুতি দুই ধরনের: শারীরিক ও মানসিক। এই লেখায় শারীরিক প্রস্তুতির একটি উপকরণ বার্থ বল নিয়ে আলোকপাত করবো।

Source: Hospital Naluri Website

বার্থ বল কী ?

বিভিন্ন ব্যায়ামের অনুসঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত জিম বল থেকে বার্থ বল (Birth ball) একটু বড়। গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন ব্যায়ামে এবং প্রসবের সময় ব্যাথা ব্যবস্থাপনার (labor pain management) এর অংশ হিসেবে বার্থ বল বা বার্থিং বলের ব্যবহার হয়ে থাকে।

লেবার পেইন মোকাবেলা করার প্রচলিত মেডিকেল হস্তক্ষেপ হলো এপিড্যুরাল। তবে অনেকে প্রাকৃতিক প্রসব চাইতে পারেন এবং এপিড্যুরালের মতো Intervention নাও চাইতে পারেন। তাদের জন্য বার্থবল বেশ কাজের।

সন্তান প্রসব ও লেবারের সময় বার্থ বলে নিজের সুবিধামতো পজিশনে বসে একজন মা ব্যাথার বোধ কমাতে পারেন। বার্থিং বলের ব্যবহার গর্ভাবস্থা বা প্রসবে নিরাপদ বলে বিবেচিত।

অনেক সময় আপনার কাছে বার্থ বল নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে জিম বল বা exercise ballও ব্যবহার করতে পারেন।

বার্থ বল ও জিম বলের পার্থক্য

দেখতে একই রকম হলেও বার্থিং বল ও জিম বলের মাঝে কিছু পার্থক্য আছে।

১. আকার

জিম বল ৪৫ – ৭৫ সেন্টিমিনার ব্যাসের বিভিন্ন আকারের হয়। অপরদিকে বার্থবল দুটো সাইজে পাওয়া যায়। ৬৫ ও ৭৫ সেন্টিমিটার। আমাদের দেশে নারীদের গড় উচ্চতার কারণে ৬৫ সেন্টিমিটারের বল বড় মনে হলে এরচেয়ে ছোট (৪৫ ও ৫৫ সেন্টিমিটার) জিম বলগুলো অনায়াসে ব্যবহার করা যাবে।

২. বানানোর উপকরণ

উভয়ধরনের বল ভিনাইল বা প্লাস্টিক দিয়ে বানানো হয়, তবে বার্থ বল জিম বলের তুলনায় বেশি পুরু হয়।

৩. নিরাপত্তা ব্যবস্থাঃ

উভয় ধরনের বলের মাঝে সবচেয়ে বড় পার্থক্যের জায়গা হলো বার্থ বলে এন্টি স্লিপ ব্যবস্থা থাকে, যাতে একজন মা বলে বসা অবস্থায় পিছলে পড়ে না যান। প্রসূতি মায়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে এরকম করে বানানো হয়। এছাড়া একটু দামি বলে এন্টি বার্স্ট ব্যবস্থা থাকে, যাতে পাঙ্কচার হওয়া বলের বাতাস একেবারে বের না হয়ে যায়।

স্বস্তির বিষয় হলো জিম বল কিংবা বার্থবল উভয়টাই বিশেষভাবে বানানো যাতে এটা একজন পূর্ণবয়ষ্ক মানুষের ওজন নিতে পারে। ভাল মানের বার্থবল ৩০০ কেজি পর্যন্ত ওজন নিতে পারে।

ব্যবহারিক সতর্কতাঃ

বার্থ বল ব্যবহারের সময় দুটো বিষয় খেয়াল করবেনঃ
১. বলটি যেন পুরোটা ফোলানো থাকে। আংশিক ফোলানো বল পিছলে যেতে পারে এবং গর্ভবতী মা বল থেকে পড়ে যেতে পারেন।
২. বলটি বার্স্ট প্রতিরোধী (burst resistant) কী না দেখে নিন।

বার্থবলের সঠিক সাইজ কীভাবে চিনবেন?

বলের উপর বসার পর আপনার কোমর যদি হাটুর চেয়ে সামান্য একটু (১০ সেন্টিমিটার) উপরে থাকে, তাহলে এই বলের সাইজ আপনার জন্য যথার্থ। এছাড়া বলে বসে দুই পা সমান্তরালে রেখে হাটু যদি ৯০ ডিগ্রী কোণে থাকে, তাহলেও সেটা চলনসই। খেয়াল রাখবেন, বলে বসে আপনার কোমর যেন হাটুর নিচে নেমে না যায়। এরকম হলে আপনার আরেকটু বড় বল কেনা উচিত।

বার্থ বলে বসার সঠিক পজিশন
Source: Tommys.org

সবচেয়ে ভাল হয় যদি আপনি সরাসরি দোকান থেকে বার্থ বল দেখে কিনতে পারেন। এতে পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ পাবেন এবং ভুল হবার সম্ভাবনা কমে। এছাড়া বলের গুণগত মান দেখে নেয়ার সুযোগ থাকে।

অনলাইনে কিনতে হলে আপনার উচ্চতা-বলের আকারের অনুপাত মেনে কিনুন।

উচ্চতা অনুযায়ী বলের সাইজ

১. ৫ফুট বা এর কম উচ্চতার ক্ষেত্রে ১৮ইঞ্চি বা ৪৫সেমি বল কিনুন।

২. ৫ফুট ১ইঞ্চি থেকে ৫ফুট ৭ইঞ্চি উচ্চতা হলে ২২ইঞ্চি বা ৫৫সেমি বল নেবেন।

৩. ৫ফুট ৮ইঞ্চি থেকে ৬ফুট ১ইঞ্চি উচ্চতার ক্ষেত্রে ২৬ইঞ্চি বা ৬৫সেমি বল কিনবেন।

৪. ৬ফুট ২ইঞ্চি বা তার বেশি উচ্চতার জন্য ৩০ইঞ্চি বা ৭৫সেমি বল কিনবেন।

কারো উচ্চতা যদি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়, তারা প্রয়োজনে একটু বড় বল কিনতে পারেন।

এসব বল পিভিসি দিয়ে বানানো হয় বলে বেশ টেকসই এবং প্রেগনেন্সির পরেও সাধারন ব্যায়ামের জন্য ব্যবহার করা যায়। তাই গর্ভাবস্থার পর একে ফেলনা ভাবার কোন কারণ নেই। নিজের বার্থ বল নিজের সাথেই রাখুন, কারণ দেশের হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোতে এধরনের সরঞ্জাম থাকার সম্ভাবনা বেশ কম। তাছাড়া আপনি অন্যের বলে আরামবোধ নাও করতে পারেন।

বার্থ বল কখন ব্যবহার করবেন?

গর্ভাবস্থার যেকোন স্টেজে/ধাপে বার্থবল ব্যবহার করে ব্যায়াম করতে পারেন। শরীরের ব্যাথা, অস্বস্তি দূর করে শিথিলায়নে (relaxation) বা বাচ্চার পজিশন ঠিক করতে ৩২ সপ্তাহ থেকে এই বল দিয়ে ব্যায়াম করার পরামর্শ দেয়া হয়। আপনি যদি বল দিয়ে ব্যায়ামে আরাম না পান, তাহলে আপনার দৌলার সহায়তা নিন। একজন প্রশিক্ষিত দৌলা আপনাকে বার্থবল থেকে সর্বোচ্চ উপকারিতা পেতে গাইড করতে পারেন।

দৌলা আপনাকে যেভাবে সহায়তা করবেনঃ

  • গর্ভাবস্থার জন্য নিরাপদ ব্যায়াম করতে, আরামে বসতে শেখাবেন
  • লেবারের সময় জন্য বিভিন্ন অবস্থান অনুশীলন করতে শেখাবেন
  • আসল লেবারের সময় ব্যবহার করতে সহায়তা করে, যাতে আপনি প্রসব বেদনার সাথে মানিয়ে নিতে পারেন

ডেলিভারির পরে বার্থ বলের ব্যবহার

বার্থবলের সাথে জিম বলের পার্থক্যের কথা আগেই বলেছি, কিন্তু ব্যবহারের দিক থেকে দুটোর উদ্দেশ্য একই – বল দিয়ে ব্যায়াম করা। সন্তান প্রসবের পরেও তাই বিভিন্ন প্রয়োজনে বার্থ বলের ব্যবহার করতে হবে।

বলে বসে আরাম করাঃ

যেহেতু বলটি বাতাসে ফোলানো, তাই ভ্যাজাইনাল ডেলিভারির পর যোনি ও মলদ্বারের মাঝের জায়গায় যে ব্যাথা বা চাপ বোধ হয় সেটা দূর করতে বার্থ বলে বসে যায়। এজন্য বলের বাতাস কিছুটা কমিয়ে এর উপর আরাম করে বসতে পারেন।

আপনার যদি নরমাল ডেলিভারি (vaginal birth) হয়ে থাকে তাহলে প্রসব পরবর্তী সময়ে যোনি (vagina) এবং মলদ্বারের মধ্যবর্তী জায়গায় ব্যথা বা চাপ অনুভব করা বা অনেক্ষন বসে থাকলে কিছু অস্বস্তি হতে পারে। এই ব্যথা প্রশমণের জন্য আপনি আপনার বার্থ বলটিকে সামান্য বাতাস বের করে নিয়ে এতে আরাম করে বসতে পারেন। এতে আপনার অস্বস্তি কিছুটা কম হবে।

স্ট্রেচিং

বাচ্চা কোলে বসা

অনেক সময় কান্নারত বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হাটতে ক্লান্তি বোধ হতে পারে। বার্থ বলের বাতাস বের করে একে বসার উপযোগী করে বাচ্চাকে কাঁধে বা কোলে রেখে বসলেন এবং একটু একটু করে বাউন্স করলেন। এতে আপনি যেমন ভাল বোধ করবেন, তেমনি বাচ্চাও নতুন মুভমেন্টের স্বাদ পেয়ে ঘুমিয়ে যেতে পারে।

তাই বুঝতেই পারছেন, প্রসবের পরে বার্থবলকে ত্যাগ করার দরকার নেই, বরং এটা আপনার পোস্টপার্টামে দরকারি অনুসঙ্গ।