সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েছি। ঠিক তখনই বিয়ের পিড়িতে বসলাম। জানতাম না সংসার কিভাবে করে। গায়ে হাওয়া বাতাস লাগিয়ে চলা উড়নচণ্ডী জীবন যাকে বলে।

হাজব্যান্ডও তখন সদ্য চাকরিতে যোগ দিয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলে। তাই দায়িত্ব আর পরিবারের প্রত্যাশার চাপ যেন একসাথে এসে পড়ল। নতুন শহরে নিজেদের গুছিয়ে নেয়া, সাথে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে একটি কঠিন সময়। ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে বাচ্চা নেয়ার মতো আগ্রহ দুজনার কারোরই ছিল না।

দেখতে দেখতে বিয়ের তিন বছর কেটে গেল। বাচ্চা নেয়ার মনোভাবটা তখনও তৈরি হয়নি। সত্যি বলতে বাচ্চা নিয়ে কোন আবেগ অনুভূতিও ছিল না।
ঠিক সেই সময় কিছু মেয়েলি সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে বলল আপনার যে ধরনের সমস্যা তাতে কনসিভ করা কঠিন হতে পারে।

যেই আমার বাচ্চা নিয়ে কোন আবেগ অনুভূতিই ছিল না সেই আমার একটা বাচ্চার জন্য ভেতরটা কেমন উলট পালট হয়ে গেল।
অচেনা এক ছোট্ট প্রাণকে জীবনে পাওয়ার জন্য বুকের ভেতর উথাল পাথাল ঢেউ। হাজব্যান্ড অনেক করে বুঝাল। এই দুনিয়ায় সবার বাচ্চা থাকে না। তাদের জীবন কি চলছে না?আমাদেরও সেভাবেই চলবে।

কিন্তু আমার মন যে কিছুতেই চলে না। কিছুতেই বুঝ মানে না। নাওয়া খাওয়া সব ছেড়ে ইউটিউবে ডাক্তারদের ভিডিও দেখা শুরু করলাম। কোথাও কোন সমাধান মিলে কিনা।
এভাবে চলল বেশ কিছুদিন।

ভাবলাম ঢাকার একজন খুব সুপরিচিত ফার্টিলিটি স্পেশালিষ্টকে দেখাবো। উনার সাথে দেখা করার আগে ভাবলাম একটা কিট টেস্ট করি। পিরিয়ড ডেট মিস হওয়ার সপ্তাহও পার হয়নি যদিও। ভাবলাম উনি জানতে চাইলে যেন ডিটেইলস বলতে পারি।

খুব বেশি থেকে বেশি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কিটে হালকা দুটো লাল দাগ। যেই লাল দাগের প্রত্যাশায় অসংখ্য মেয়ে প্রতিনিয়ত রবের দরবারে হাত উঠায়।
আমি বুঝলাম আমার ভেতর জন্ম নিয়েছে আরেকটা অস্তিত্ব।

আমি বুঝলাম আমার রব আমাকে হতাশ করেননি।

গল্পের সমাপ্তি এখানে হলে সুন্দর হতো। কিন্তু প্রেগনেন্সি যখন তিন মাস, তখন হটাৎ করে এক সন্ধ্যায় আবিষ্কার করলাম হালকা ব্লিডিং হচ্ছে। বাসায় তখন আমি আর আমার শাশুড়ি। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে ভাবলাম কি করব এখন!
ভাইয়া নিউরো স্পেশালিষ্ট। ভাইয়াকে তৎক্ষনাৎ ফোন দিলাম। ভাইয়া বলল তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে যা।
এইখানে আমাদের ডাক্তারদের আসলে করার কিছু থাকে না।
হাজব্যান্ড তখন অফিস থেকে ফেরার পথে। তাকেও ফোন দিলাম। সে বলল,আম্মাকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে আস। আমি সরাসরি হাসপাতালে যাচ্ছি।

হাসপাতালে যাচ্ছিলাম আর রবকে ডাকছিলাম। দুনিয়ার সব দোয়া বোধহয় সেদিন একসাথে করেছিলাম।

হাসপাতালে যাওয়ার পর ডাক্তার প্রয়োজনীয় টেস্ট গুলো করালেন আগে। টেস্টের রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর ডাক্তার আমাকে ডাকলেন। খুব সুন্দর করে রিপোর্ট দেখিয়ে বললেন,দেখুন বাচ্চা জরায়ুর একদম শেষের দিকে চলে আসছে। এখনই বের হয়ে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া শুরু হয়ে গেছে তার।
আপনি উপরওয়ালার কাছে দোয়া করুন। আমরা শুধু চিকিৎসা করতে পারি।
উনার ব্যবহারটা এত অমায়িক ছিল। একজন ডাক্তারের ব্যবহার একজন রোগীর মানসিক সুস্থতার জন্য কতটা দরকার সেদিন কিছুটা হলেও টের পেলাম। উনার জন্য আজও আমি মন থেকে দোয়া করি।

বেশ অনেকদিন পর ভাইয়া বলেছিল এরকম ক্ষেত্রে সাধারণত মিসক্যারেজ হয়ে যায়।
কিন্তু আমি সেই ভাগ্যবতী মা যাকে রব মিসক্যারেজের মতো কষ্টটা দিলেন না। শুকরিয়া তার দরবারে।

বাসায় ফিরলাম। শুরু হল নিয়ম করে ওষুধ আর ইঞ্জেকশন নেয়া। সাথে ছিল ফুল বেড রেস্টের মতো ভয়ংকর একটা কষ্ট। পাশ ফিরলেও অত্যন্ত সাবধানে পাশ ফিরতে হত।
তার কিছুদিন পর আবার দেখা দিল প্রেগনেন্সিকালীন ডায়াবেটিস। প্রচন্ড গরমে দুইবেলা শুকনো রুটি,নিয়ম করে হাটা, ডাক্তারের চেক আপ। প্রেশার বেড়ে যাওয়ার একটা সমস্যাও যোগ হয়েছিল শেষের দিকে।
এতকিছুর মধ্যে একটা ভালো দিক ছিল যে আলহামদুলিল্লাহ,আমি খেতে পারতাম আর বমি হতো না। অথচ সারাজীবন বাসে উঠা তো দূরের কথা বাস দেখলেও বমি হতো।
নিশ্চয়ই রব সাধ্যের বাইরে কাউকে কিছু চাপিয়ে দেন না।

লাস্ট ট্রাইমেস্টারে আম্মার কাছে চলে গেলাম। কথায় আছে মা ছাড়া নাকি মা হওয়া কঠিন। সত্যিই কঠিন। আম্মা অনেকটা ছোটবেলার আদর যত্নটা করতো। আমার কখন কি পছন্দ সামনে এনে হাজির করতো।
আম্মা চলে গেল বছর খানেক আগে। ভাবি,এরপর যদি মা হই মা ছাড়াই আমাকে মা হতে হবে। তার আঁচলের মনোরম প্রশান্তি এ জীবনে আর মিলবে না। নিজের সমস্ত দায়িত্ব নিজেকেই পালন করতে হবে।

EDD এর মাস খানেক আগে আবার ভাইয়ার কাছে চলে গেলাম। ভাইয়ার পরিচিত হাসপাতাল, ডাক্তার সব আছে সেখানে।

লক্ষণীয় একটা ব্যাপার হল আমরা অনেকটা স্থির হয়ে বসে থাকি যেন EDD ডেটের দিনই ব্যথা উঠতে হবে। আগে পরে উঠা যাবে না। আমাদের মাতৃত্বের জ্ঞানের বিষয়ে অজ্ঞতার ফসল এটা।

সেই নিয়মে আমিও প্রস্তুত ডেলিভারি ডেট একদম কাছাকাছি এলেই সিজার করে ফেলব।
এদিকে ডেলিভারি ডেটের যখন একুশ দিন বাকি তখন হটাৎ করে রাত দুইটা থেকে পেটটা চিনচিন করে ব্যথা করছিল। ভেবেছিলাম কন্সটিপিশনের কারণে হয়তো এমন হচ্ছে।এখনও ভেবে অবাক হই কতটা বোকা ছিলাম। ভুলেও মাথায় আসেনি এটা লেবার পেইন হতে পারে।
সকাল পাঁচটার দিকে আম্মাকে ডেকে তুললাম। বললাম আম্মা, পেট ব্যথা করছে।আম্মা অভিজ্ঞ মানুষ।আচ করতে পারলেন ব্যাপারটা।
ভাইয়াকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। ভাইয়া বলল আপাতত একটা গ্যাসের ট্যাবলেট খা। গ্যাসের কারণে হলে আধা ঘণ্টার মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।

আধা ঘণ্টা যাওয়ার আগেই ব্যথা চরম আকার ধারণ করছিল। বাসা থেকে হাসপাতাল যেতে দশ মিনিটের মতো লাগে। এই দশ মিনিটে ব্যথার যন্ত্রণায় আল্লাহর কাছে তওবা করা শেষ। ওইদিন প্রথম মনে হয় এত খাস দিলে আল্লাহর কাছে তওবা করেছিলাম।

হাসপাতালে পৌঁছালাম। পুরো হাসপাতালে কারোর তেমন ঘুম ভাঙেনি তখনও। শুনেছি লেবার পেইনের কষ্টটা নাকি বুকের পাজর ভেঙে যাওয়ার কষ্টের মতো। সাড়ে চার ঘন্টা সেই কষ্ট সহ্য করলাম। মানুষ যে এত চিল্লায়া কেন কান্না করে সেদিন প্রথম বুঝলাম।
ব্যথা বাড়ছে তো বাড়ছেই।ভয়ংকর সেই ব্যথা। এই ব্যথার যন্ত্রণা যদি কোন মায়ের মনে থাকতো তবে বোধকরি কোন মা দ্বিতীয়বার মা হতে চাইতো না।

প্রেশার, ডায়াবেটিস থাকার কারণে কখনও নরমাল ডেলিভারির চিন্তাও মাথায় আসেনি। নরমাল ডেলিভারির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ যেই জিনিসটা দরকার তার নাম সাহস এবং মানসিক প্রিপারেশন। যেটা আমার একেবারেই ছিল না।
আমার মতো অনেকেরই এই সাহস এবং মানসিক প্রিপারেশন জিনিসটা থাকে না বলেই হয়তো চারপাশে আমরা এত এত সিজারের গল্প শুনতে পাই। সিজারের পরে দিনের পর দিন কষ্ট সহ্য করতে আমরা রাজি থাকি কিন্তু সিজারের আগের ডেলিভারির কয়েক ঘন্টা পেইন আমরা সহ্য করতে পারি না।
নিজের এবং চারপাশের দেখা মানুষকে দেখা অভিজ্ঞতা থেকে এতটুকু বুঝতে পেরেছি।

সাড়ে নয়টার পর ওটিতে নিয়ে গেল। ইঞ্জেকশন দেয়ার পর যখন ব্যথা কমে গেল মনে হল। আহা!বড় বাঁচা বেঁচে গেছি।
একইসাথে সিজার এবং সাড়ে চার ঘন্টার নরমাল ডেলিভারির পেইন। দুটোই সহ্য করলাম।

মেয়ের এখন আড়াই বছর।
দৌড়াতে শিখেছে,কথা বলতে শিখেছে।
মাঝেমধ্যেই মেয়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবি সত্যিই মেয়েটা আমার পেট থেকে হয়েছে তো!
ভাবি, নিশ্চয়ই জীবনে কোন ভালো কাজ করেছিলাম যার জন্য তাকে পেয়েছি।
রবের কাছে এই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে কখনও শেষ করতে পারি না।

সন্তান…..
রবের পক্ষ থেকে অনেক বড় একটা নিয়ামত।
খুব সহজে পেয়ে গেলে এই নিয়ামতের গুরুত্ব আমরা অতটা বুঝতে পারি না যতটা একজন ভুক্তভোগী বুঝেন।

নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি না সন্তান আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি না তার সৃষ্টির পিছনে আমার কোন হাত আছে।

আল্লাহ বলেন,
আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আধারে (জরায়ুতে) স্থাপন করেছি। এরপর শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে গোশতপিণ্ডে পরিণত করেছি, এরপর গোশতপিণ্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে গোশত দ্বারা আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে নতুনরূপে সৃষ্টি করেছি।’
সূরা মুমিনুন, আয়াত ১২-১৪

সুবহানআল্লাহ।
মহান,পবিত্র সেই সত্তা।
শুকরিয়া তার নিকট সবকিছুর জন্য।