হিমে ভেজা জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় আমার সেমিষ্টার ফাইনাল শেষ হয়েছিলো। মনে পড়ে ভার্সিটি বাসে করে শাহবাগ যেতে যেতে মনে হচ্ছিলো শরীরকে খুব হেফাজতে রাখতে হবে,যেন শিক্ষার্থীদের ধাক্কাধাক্কির মাঝে হুমড়ি খেয়ে না পড়ি। কেন এমন মনে হচ্ছিলো তখনো বুঝিনি। তারপর যেদিন জানতে পারলাম নতুন মেহমান আসছে,তারপরেরদিনই আমাদের নতুন বাসায় উঠার ডেইট ছিলো। আল্লাহর পরিকল্পনা হিসেবেই মেনে নিলাম, আলহামদুলিল্লাহ।
প্রেগন্যান্সির প্রথম কয়েক মাসে তেমন কিছুই খেতে পারতাম না। প্রচুর বমি হতো। ওজন কমে গেছিলো কয়েক কেজি। শেষের দুই থেকে আড়াই মাসে শারীরিক কষ্ট হয়েছে বেশি।রাউন্ড লিগামেন্ট পেইন ছয় মাস থেকেই খুব বেশি ছিলো। শুলে পাশ ফিরতে মারাত্মক কষ্ট হতো। ৩৯ সপ্তাহ শুরু হতেই মনে মনে অপেক্ষার প্রহর গোনা শুরু হয়ে গেলো। ডাক্টারের কাছে চেক আপে যাওয়ার আগে একটা আল্ট্রা করালাম,কারণ অনেক সময় অ্যামিওনেটিক ফ্লুইড শেষের দিকে কমে যায়। আল্লাহর রহমতে রিপোর্ট ভালো আসায় ব্যাথা উঠার অপেক্ষা করছিলাম,৪০ সপ্তাহের মাঝামাঝি সময়ে ডাক্তারের সিরিয়াল দিয়ে রাখা হলো। কাছের মানুষদের ভরসা মাখা আশ্বাস মনের জোর বাড়াতে হেল্প করতো।
নেগেটিভিটি ও মনে অশান্তি সৃষ্টি করে এমন জিনিসগুলো থেকে,এবং এমন মানুষদের থেকে সচেতনভাবে দূরে থাকার চেষ্টা করতাম। শরীরে যতোটুকু কুলায় এমন এক্সারসাইজ করতাম কোন কোন দিন।
আমার ইডিডি ছিলো অক্টোবরের ৮ তারিখ। ৫ তারিখ সকাল থেকে কোমরে হালকা ব্যাথা করছিলো। লেবার পেইন ভেবে এক্সাইটেড হয়ে গেলাম আমি। অনেকক্ষন পরপর একটা মাঝারি থেকে তীব্র ব্যাথা অল্প সময়ের জন্য হচ্ছিলো। দুপুরে খেয়ে ঘুমাতে গেলাম। শোয়ার পর প্রথমে মনে হচ্ছিলো ব্যাথা বেড়ে গেছে। শরীর খুব ক্লান্ত ছিল আমার। আল্লাহর কাছে দুয়া করলাম যেন ব্যাথাটা একটু কমে আর আমি ভালোমতোন ঘুমাতে পারি । বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখি ব্যাথা একেবারেই নেই। তখন আবার মন খারাপ হয়ে গেলো। সেদিন সন্ধ্যায় আমার ইচ্ছাতেই রিকশা দিয়ে বাসা থেকে খানিকটা দূরে ঘুরে আসলাম। যাওয়ার সময় পাড়ার ভেতরের রাস্তা দিয়ে যাওয়ায় বেশ ঝাকি লাগলো,আসার সময় পাড়ার রাস্তা এভোয়েড করে করে মেইন রোড দিয়ে আসলাম।
ঐদিন রাতে ঘুমের মাঝেই মনে হলো ব্যাথাটা আবার হালকা শুরু হয়েছে। বারবার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। ফজরের ওয়াক্তে ব্লাডি শো দেখলাম। সারাদিন ধরে ব্যাথা হচ্ছিলো। সকালে কন্ট্রাকশন কাউন্ট করলাম দেখলাম নির্দিষ্ট সময় পরপরই ব্যাথা আসছে। সন্ধ্যায় চেক আপের সিরিয়াল দেয়াই ছিলো৷ হসপিটাল ব্যাগ গুছিয়েই গেলাম, যদি ডাক্তার ভর্তি হতে বলেন। যাইহোক,ডাক্তার চেক করে বললেন জরায়ুমুখ ২ সেমি খুলে আছে। উনি বাসায় চলে যেতে বললেন। বললেন ব্যাথা বাড়লে যেন হাসপাতাল ভর্তি হই। ব্যাথা না বাড়লে ৯ তারিখ সকালে ইন্ডিওসড লেবারের জন্য ভর্তি হয়ে যেতে বললেন। বাসায় ফিরে সারারাত আমার ব্যাথা একটু একটু বাড়ছিলো। ঘুমাতে পারলাম না। ক্রমাগত পায়চারি করছিলাম,ব্যাথা আসলে কিছু খামছে ধরে ব্যাথা সামলানোর চেষ্টা করছিলাম। শিফার নিয়তে জমজমের পানি ও কয়েকটা খেজুর খেলাম। হাজবেন্ড মাঝরাতে উঠে দেখলেন আমি ব্যাথায় অস্থির হয়ে আছি,কান্না করছি। উনি বললেন ফজরের পরেই হাসপাতাল চলে যাব। আমি নামাজ পড়ে কোরআন পড়লাম। ফজরের পরপরই সবাই রেডি হয়ে বের হয়ে গেল। চারদিক সুনশান নীরব। গাড়িতে ব্যাথা উঠলে আমি ছটফট করছিলাম আর এর মাঝেও ছোটবোন আমার সাথে এটাসেটা নিয়ে দুষ্টমি করছিলো।
যাইহোক,হাসপাতাল ভর্তির পর লেবার রুমের ডিউটি ডাক্তার আমার পিভি করে বললেন জরায়ু মুখ ৪ সেমি খুলেছে। আমার ডাক্তারকে কল করে সব জানালেন। উনাদের দেখানো নিয়মে হাঁটাহাটি,ব্যাথা আসলে স্কোয়াট, হিপ রোটেশন এই তিনটাই চালিয়ে গেলাম। এই ফাঁকে নাস্তা করেছি,টুকটাক খাবার খেয়েছি। অনেক ব্যাথায় শরীর ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলো খুব। তাই বেডের বাহিরে দাঁড়িয়ে বিছানায় উবু হয়ে রেষ্ট নিচ্ছিলাম আমি।
সকাল ১১ টার দিকে আবার চেক করে বললেন ৬ সেমি ওপেন হয়েছে। এবার খুব ব্যাথা পেলাম কেন জানি। এতো তীব্র পেইন নিতে না পেরে আমার কান্না চলে আসলো। এইজন্য লজ্জাও লাগছিলো আমার। লেবার রুমে আমি ছাড়া আর কেউ না থাকায় আমার হাসবেন্ড আর আমার মাকে ডেকে আনা হলো। উনাদের কে দেখে মারাত্নক ব্যাথার মাঝেও হাসি আসলো আমার। আম্মুও সাহস দিলো,সান্ত্বনা দিলো।
কিছুক্ষন পর আমার ব্যাথা বেড়ে একমিনিট পর পরই যেন ব্যাথা হচ্ছিলো। ব্যাথা আসলেই স্কোয়াট করছিলাম। ১ টার পর থেকে আমার কিছুটা টয়লেটের প্রেশার হচ্ছিলো, শরীর খুব ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য আমি বেডে উঠে শুয়ে পড়ি,ঘনঘন ব্যাথা আসলে শুয়ে থেকেই বেডের দু সাইডের পা রাখার জায়গায় পা রেখে টয়লেটের প্রেশার দিচ্ছিলাম। মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়া শুরু করে দিলাম। এক পর্যায়ে হুট করেই শব্দ করে পানি ভেঙ্গে গেলো। পানি ভাঙ্গার পর ব্যাথা যেন কয়েকগুন বেড়ে গেলো। মিনিটের মাথায় বাচ্চার মাথা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ঐ সময়ে একজন নার্স ব্যতীত অন্য ডাক্তার নার্স সবাই বাহিরে। দ্রুত ডিউটি ডাক্তার,আমার ডাক্তারকে ফোন দেওয়া হলো। মিনিটের মধ্যেই সবাই এসে হাজির।
আমার ডাক্তার এসেই একটু কেটে দিলেন। আমি প্রচন্ড ব্যাথায় অস্থির হয়ে ক্রমাগত পুশ করেই যাচ্ছিলাম৷ পুশ করার সিষ্টেম বুঝতে পারছিলাম না। ডিউটি ডাক্তার আমাকে শান্ত হইতে বললেন। ব্যাথা আসলে এবার সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে কয়েকবার পুশ করতেই আল্লাহর দেয়া নেয়ামত, আমাদের সন্তান দুনিয়ায় চলে এলো। ডাক্তার বললেন তোমার ছেলে বাবু হয়েছে। আমি ডাক্তারকে বললাম বাচ্চাকে আমার কোলে দিতে। আমি জোরে জোরে আল্লাহর শোকর আদায় করতে লাগলাম। আলহামদুলিল্লাহ।
ডেলিভারীর পরে এপিশিওটমির সেলাই দেয়ার সময় আবারও খুব কষ্ট হলো। প্রতিটা সেলাই বুঝতে পারছিলাম। আমার মনে হচ্ছিলো সময় যেন স্থির হয়ে আছে। বারবার জিজ্ঞেস করছিলাম আর কতক্ষন লাগবে। সেলাই চলাকালীন ডাক্তার একটা সাইটোমিস ঔষধ দিলেন জিহবার নিচে। এই ঔষধের কারণে নাকি কাঁপুনি উঠে। এই কাঁপুনিও আমার ক্লান্ত শরীরে খুবই অসহনীয় লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো এভাবে কাঁপতে কাঁপতে মরে যাচ্ছি। আমি পুরো সময় অতিরিক্ত ক্লান্তিতে নীরব হয়ে ছিলাম,শব্দ করতে পারিনি। এসব কিছু কারণে ডাক্তার আমার প্রশংসা করলেন।
যাইহোক, প্রায় ঘন্টাখানেকের মাথায় একটু ঘুম আসলো, এক ফাঁকে উঠে দেখি কাঁপুনি চলে গেছে। আর আমার মানিক বাবাইটা আমার পাশে শুয়ে চুকচুক করে দুধ খাচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের কিছু অসুস্ততা থাকায় দুদিন হাসপাতালে কষ্টকর সময় পার করে বাসায় আসতে হয়।
আল্লাহ অভাবনীয় সব উপায়ে আমাদের সাহায্য করেছেন আলহামদুলিল্লাহ। পুরো গর্ভাবস্থায় বেশিরভাগ সময় আমার একা থাকতে হয়েছে। বয়স কম হওয়ায় এবং অভিজ্ঞতা না থাকায় নিজের যত্নের অনেক কিছুই পরিপূর্ণ ভাবে করা হয়নি,অবহেলা করেছি। যার ফলাফল পরে ভোগ করেছি। আল্লাহ মাফ করুন। তবে আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে গেছি ক্রমাগত। আল্লাহ আমাদেরকে ফেরাননি বরং অনেক বেশি কিছু দিয়েছেন, ফালিল্লাহিল হামদ।
সবর এবং তাওয়াক্কুলের উপর কোন ঔষধ নেই। এটাই আমার প্রসবের মতোন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষন থেকে পাওয়া সবচেয়ে বড় শিক্ষা। আল্লাহ আমাদেরকে, আমাদের সন্তানকে এবং সবাইকে ভালো রাখুন। সবরের পথে অটল রাখুন। আমিন।
এছাড়া মাতৃত্বের ফেইসবুক গ্রুপেও আপুদের কাছ থেকে অনেক অনেক সাহায্য পেয়েছি৷ আল্লাহ সবাইকে উত্তম প্রতিদান দিক। আমিন।
~উম্মু আহমাদ