এক ছোট বোনের লেবার পেইন উঠেছে, কতদূর প্রোগ্রেস করলো দূর থেকে খোজ নিচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে জানালো- পেইন অনেক বেড়েছে। বাচ্চার মাথা নিচের দিকে আছে, মাথা নিচেও নেমে এসেছে। তাও ডাক্তার নর্মালে করাতে চাচ্ছেনা, সিজার লাগবে নাকি। পিভি এক্সামিন করে বাচ্চার চোখ আর কপাল হাতে পাচ্ছে। আমরা বাসায় চলে যাচ্ছি, সিজার করাবো না।
কিছুদিন আগে আরেক ছোট বোনের বাবু হবে, নর্মাল ডেলিভারির জন্য ভর্তিও হয়েছে, কিন্তু হঠাৎ ডাক্তার বলছেন, পানি কমে গেছে, নর্মালের জন্য অপেক্ষা করা যাবেনা। হন্তদন্ত হয়ে মেসেজ দিয়েছে- কী করবো এখন? আমরা তো কোনভাবেই সিজার চাচ্ছিলাম না। এতদিন তো সব ঠিক ছিলো!
এরকম অনেক কেইস আমাদের কাছে আসে। উপরে কেবল দুটো উদাহরণ দিলাম। প্রথম কেইসটা ফিটাল ম্যালপ্রেজেন্টেশানের উদাহরণ। বাচ্চার মাথা নিচের দিকে থাকলেও যেভাবে মুখ করে থাকার কথা, সেভাবে নেই- যেখানে থাকার কথা মাথার চুলের অংশ, সেখানে আছে মুখ ও কপাল। মাথা ঠিক অবস্থানে না আসলে এই অবস্থায় জোর করে নর্মাল ডেলিভারি করাতে গেলে বাচ্চার মুখে পানি আসা, মাথা বাকা হয়ে যাওয়া, বাচ্চার শ্বাসকষ্ট, স্পাইনাল কর্ড ইঞ্জুরি, ব্রেইন ড্যামেজ থেকে বাচ্চার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
দ্বিতীয় কেইসটা সিভিয়ার অলিগোহাইড্রামনিওজ এর উদাহরণ, যেখানে এমনিওটিক ফ্লুইড (AFI) কমে ৩ সেন্টিমিটারেরও নিচে এসে গিয়েছিলো। এই অবস্থায় অক্সিজেনের অভাবে বাচ্চার শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
আমরা যেন এটা মনে রাখি, নরমাল ডেলিভারির জন্য আমরা চেষ্টা করবো, দুয়াও করতে থাকবো, তবে আল্লাহর সিদ্ধান্তের উপর তাওয়াক্কুলও রাখতে হবে। আমার সব চেষ্টার পরও নরমালে না হতে পারে, সেক্ষেত্রে বাচ্চার মা ও বাচ্চার জীবনটা আগে, জীবনের বিনিময়েও নরমাল ডেলিভারি করাতে হবে, এমন ভুল যেন করে না বসি। এমন কথা ইসলামও বলেনি- শখ করে সিজারিয়ান ডেলিভারি করানো উচিৎ নয়, কিন্তু জরুরতে জায়েয তো বটেই, জীবন রক্ষার জন্য হলে সেটা জরুরি।
প্রচলিত ভুল ধারণা
আফসোসের বিষয়, এই জায়গাটাতে এসে অনেক শিক্ষিত, ইলমওয়ালা মানুষও বোকার মত যুক্তি দিয়ে বসেন- কুকুর বিড়ালের বাচ্চা হতে সিজার লাগেনা, মানুষের কেন লাগবে? আগের যুগের মায়েদের সিজার লাগতো না, এখন লাগবে কেন?
- জ্বি না, কুকুর বিড়াল কিংবা পশুদের বাচ্চাও ডেলিভারি হতে গিয়ে আটকে গিয়ে অনেকসময় বাচ্চা ও মা মারা যায়। ইউটিউব সার্চ দিয়ে দেখুন।
- আগের যুগে সিজার ছিলোনা, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হারও অনেই বেশি ছিলো। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সাথে এই হার অনেক কমেছে, আলহামদুলিল্লাহ। পরিসংখ্যান দেখে আসুন।
আর হ্যা, চিকিৎসার এই জ্ঞান মানুষ নিজ শক্তিতে পায়নি, এই জ্ঞানও আল্লাহরই দেয়া। আল্লাহর দেয়া বুদ্ধি ও জ্ঞানকে মানুষের উপকারে লাগানো, এটাতো আল্লাহই চান।
চিকিৎসাবিদ্যার চর্চা নতুন কিছু না, রাসূল সা. এর যুগেও ছিলো, আয়িশা রা. নিজেও চিকিৎসকদের দেখে দেখে চিকিৎসাশাস্ত্রের অনেক জ্ঞান লাভ করেছিলেন। তাই চিকিৎসা শাস্ত্রের যে উন্নয়ন মানুষের উপকার করছে, সেটাকে গ্রহণ না করে নিজের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলা কোন তাওয়াক্কুলের পরিচয় বহন করেনা, বরং চিকিৎসা গ্রহণ করাই সুন্নাত। আর বাচ্চা ও মায়ের জীবন বাচাতে প্রয়োজনে সিজারিয়ান ডেলিভারির সুযোগ গ্রহণ করা সেই সুন্নাতেরই অংশ।
কখন সিজারিয়ান ডেলিভারি জরুরিঃ
যাক সে কথা, চলুন তবে দেখে আসি, কোন কোন ক্ষেত্রে সিজারিয়ান ডেলিভারি জরুরি হয়ে পড়ে-
যেসব ক্ষেত্রে সিজার ব্যতীত আর কোনো উপায় নেই (absolute indication):
১. বাচ্চা প্রসবের রাস্তা বাচ্চার মাথার আকৃতির সাথে আনুপাতিকভাবে ছোট। (Cephalo-pelvic disproportion)
২. প্রেগ্ন্যাসিজনিত হাইপারটেনশন অনেক বেশি হওয়া, সিস্টোলিক ব্লাড প্রেশার ১৬০ বা তার বেশি, ডায়াস্টোলিক ব্লাড প্রেশার ১১০ বা তার বেশি (Severe PIH)
৩. সিভিয়ার প্রি-একলাম্পশিয়া ও একলাম্পশিয়া (উচ্চ রক্তচাপজনিত খিচুনি)
৪. পেটের ভিতর বাচ্চার শ্বাসকষ্ট হওয়া (Fetal distress)
৫. ডেলিভারির সময় সবার আগে বাচ্চার নাড়ী দেখা যাওয়া (Cord prolapse)
৬. গর্ভফুল জরায়ুর মুখে থাকা(Placenta Previa, grade- 3,4)
৭. বাচ্চা ডেলিভারীর পূর্বেই গর্ভফুল জরায়ুর গা থেকে ছুটে রক্তক্ষরণ শুরু হওয়া (Abruptio Placentae)
৮. বাচ্চা জরায়ুতে আড়াআড়িভাবে (transverse lie) বা উল্টে থাকা (Breech)।
৯. ম্যালপ্রেজেন্টেশান: প্রসবমুখে বাচ্চার মুখ (Face presentation), বাচ্চার কপাল (Brow presentation) বা কাধ থাকা এবং তা ঘুরে গিয়ে স্বাভাবিক অবস্থানে না আসা।
১০. ডেলিভারির সময় জরায়ু ফেটে যাওয়া (Uterine Rupture)।
১১. বাচ্চা প্রসবের রাস্তায় বড় কোন টিউমার থাকা।
১২. আগে VVF (vesico-vaginal fistula) এর অপারেশন হওয়া।
১৩. জরায়ুর পানি খুব বেশি কমে যাওয়া (Severe Oligohydramnios)
১৪. দীর্ঘ সময়েও বাচ্চা ডেলিভারি না হওয়া (Prolonged labor) বা বাচ্চা আটকে যাওয়া (Obstruted labor)।
১৫. ডেলিভারির সময় বাচ্চার কাধ পিউবিক বোনে আটকে যাওয়া। (Shoulder dystocia)
কখন সিজারিয়ান ডেলিভারি প্রয়োজন হতে পারেঃ
যেসব ক্ষেত্রে সিজার করা লাগতে পারে (Relative indication):
১. জরায়ুতে একসাথে একাধিক বাচ্চা থেকে সৃষ্ট জটিলতা (Complicated or multiple pregnancy)
২. বাচ্চার মাথা বড় হওয়া (Macrosomia)
৩. আগের দুই বা ততোধিক বাচ্চা সিজারে হওয়া।
৪. ডেলিভারির ব্যথা শুরু হওয়ার আগে যে কোন পরিমাণ রক্তক্ষরণ শুরু হওয়া (Antepartum Haemorrhage)
৫. সময় পার হয়ে যাওয়ার পর ইন্ডাকশন দিয়েও লেবার পেইন না উঠলে।
৬. ডেলিভারীর সম্ভাব্য তারিখ থেকে বেশি দেরি করে আসা (post dated pregnancy)
তবে হ্যা, উপরের কেইসগুলোতে সবসময় যে সিজার করতেই হবে এমন না। ডেলিভারির সময় অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চার পজিশান বদলে ঠিক হয়েও যায়। তবে যা-ই করবেন, শুধু অনুমানের উপর নির্ভর করে বসে না থেকে বিশ্বস্ত গাইনী ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে করবেন। প্রয়োজনে অনলাইন কোন ক্লিনিক বা পরিচিত ডাক্তার থেকেও পরামর্শ নিতে পারেন।
সর্বোপরি সহজতার দুয়া করবেন, ইস্তিখারা করবেন, আল্লাহর সিদ্ধান্তের উপর সন্তুষ্ট থাকার মানসিকতা রাখবেন। শুধুই নিজের চিন্তাভাবনার উপর অটল থেকে বাচ্চা ও বাচ্চার মায়ের জীবন ঝুকির মুখে ফেলবেন না। প্রতিটি জীবন মূল্যবান। একটি জীবন রক্ষা করা সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করার সমান।
লেখিকাঃ ডাক্তার নিশাত তামমিম, ইয়াদাহ ক্লিনিক