“শাসন না করলে সন্তান মানুষ হয়না”- অতি সুপরিচিত একটি প্রবাদ হলেও এর যথার্থতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হয়। যেমন, ঠিক কতোটা শাসন করতে হবে, কীভাবে শাসন করতে হবে, শাসনের কোন ধরণে সন্তানের উপর কেমন প্রভাব পড়বে, শাসনের মাত্রা কতোটুকু হবে, কতোক্ষন ধরে শাসন চলবে- ইত্যাদি প্রশ্নের সমাধানটি স্পষ্ট না। সাঈদ আবুল হাসান আলি নদবির মা, খায়রুন্নেসা শাসনের ব্যাপারে বলেছেন, “খুব বেশি মারধর করবেনা কিংবা বকবে না। এতে সে বেহায়া হয়ে যাবে।”(১) এছাড়াও মনঃসমীক্ষা বলে যারা অনেক বেশি শাসনের মাঝে থেকে বড় হয়, তারা নিজেদের ব্যাক্তিত্ব সম্পর্কে অসচেতন থাকে এবং জীবন ও আবেগের সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠে। (২)

অ্যারিস্টটলের একটা বিখ্যাত বাণী হচ্ছে, “সবারই রাগ আছে কিন্তু সঠিক জায়গায় সঠিক মাত্রায় সবাই একে ব্যাবহার করতে পারে না।’’ (৩) রাগ বলতে এখানে সবরকমের আবেগ বুঝানো হয়েছে। রাগ যেমন আবেগ, তেমন করে হাসা, কান্না করা, ভালোবাসা ইত্যাদিও একেকটি আবেগ। উপরে বলা হয়েছে, এইসব আবেগ সম্পর্কে শিশুরা অস্পষ্ট ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠবে। যেমন, হয়তো কোন বাচ্চা উল্লাস প্রকাশ করতে গিয়ে বেশি চিৎকার করছে, সে চিৎকার করছে কারণ উল্লসিত হলে কী করতে হবে তার জানা নেই। তার মনের এই ভালো লাগাকে প্রকাশ করার মতো যথেষ্ট তথ্য ও মুখভঙ্গি তার জানা নাই। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় শিশুটির চিৎকারে অতিষ্ঠ হয়ে বাবা মা তাকে কয়েকটি উত্তম-মধ্যম দিয়ে বসেন। এই সময়ে বাচ্চাটি মনে করে হয়তো উল্লাস প্রকাশ করাটাই অনুচিত। পরে দেখা যায় শিশুটি কোন আনন্দঘন পরিবেশে (কোন পারিবারিক গ্যাদারিংয়ে ঠিক উল্লসিত হতে পারছেনা। কিন্তু অন্য সবার উল্লাস দেখে সে বিব্রত ও হতাশ হয়ে উঠবে; এই উল্লাস করার জন্যই তো সে মার খেয়েছিলো! তখন একদিকে সে চাইবে সবার উল্লাসে যোগ দিতে, অপরদিকে তাকে ঘিরে রাখবে অনিশ্চয়তা; এই হয়তো বাবা রাগ করে বকা দিয়ে দিবেন! বাবা তো এমনটা দেখলে বকা দিবেন!

এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে শার্লট ম্যাসন বলেন, ‘শিশুরা বাবা মায়ের অনুপস্থিতিতে তাদের উপদেশমূলক আওয়াজ শুনতে পায়। তাদের মস্তিষ্ক বাবা-মায়ের কথাকে পুনরাবৃত্তি করে।’ (৪) অর্থাৎ, যখন শিশুরা নির্জনে থাকে, একাকী থাকে, বাবা মায়ের থেকে দূরে থাকবে তখন বাবা-মায়ের অপছন্দের কোন কাজ করতে গেলে তাদের মস্তিষ্ক বাবা-মায়ের নিরাশ মুখ দেখতে পারে ও বকুনিকে শুনতে পারে। এই রিপিটেন্সটা বাবা মায়ের কোন পছন্দের কাজ করতে গেলেও ঘটে; তারা বাবা-মায়ের সুপ্রসন্ন মুখ দেখতে পারে, প্রশংসা শুনতে পারে।

যখন তাদের স্মৃতিতে বাবা মায়ের ভয়াল মূর্তি ও রাগী চেহারা থাকে, তাহলে উল্লাসে শামিল হওয়ার সময়ে তারা দিশেহারা হয়ে অতিরিক্ত চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। তখন বাবা মা নিয়ন্ত্রণের আর কোন পথ না পেয়ে অনেকটা ইজ্জত বাঁচানোর জন্য সন্তানকে আরো কয়েক দফা উত্তম মধ্যম দিতে থাকেন। এমন করতে করতে এসব বাচ্চারা বড় হতে হতে বেহায়া হয়ে যায়। তাদের মাঝে থাকা ভয়, লজ্জা, সংকোচ কেটে যায়।

তাই বলে খুব চুপচাপ শিশুরা যে ভালো এমনটা না। ঠিক এই পরিবেশেই বেড়ে উঠা শিশুদের মধ্যেই অন্য একটি ধরণ হলো শিশুরা অতিরিক্ত ঘরকুনো হয়ে যায়। তারা বেশি চুপচাপ ও মৌন থাকতে শুরু করে। এভাবে চুপ থাকাটা একটা বাড়ন্ত বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর, এমন স্বভাব সুস্পষ্টভাবেই শিশুদের জন্য মারাত্মক, এমনকি বড় মানুষেরা যেখানে ট্রমাটিক হয়ে গেলে কথা বলতে ভুলে যান, সেখানে সদ্য ভাষা শেখার বয়সে চুপ হওয়াটা শিশুদের জন্য সরাসরি হুমকি! আমরা চুপচাপ ও ‘লাজুক’ শিশুদের খুব প্রশংসা করে থাকি, তবে তাদের চুপ হয়ে যাওয়ার পিছনে যে ভয়াবহ কারণ নিহিত তা ভেবে দেখিনা।

এই দুই স্বভাবের মধ্যে পার্থক্য হওয়ার কারণ হলো, এদের একজন অনেক বেশি আদরের পাশাপাশি অনেক বেশি মার খেয়েছে, অর্থাৎ, তার সাথে কখনোই কোন আচরণের ভারসাম্য রাখা হয়নি। আর আপরজন আদরটা অনুভব করেছে কম কিন্তু শাসনটাকে অনুভব করেছে বেশি।

বাবা-মায়ের শাসনকে শিশুরা কীভাবে নিবে সেটা নির্ভর করে তারা আদর ও শাসনের ব্যাপারে কতোটা বুঝবে তার উপর। অতিরিক্ত আদর কিংবা অতিরিক্ত শাসন শিশুদের উপর জুলুমের পর্যায়ে চলে যায়; সেটা অবশ্যই পরিত্যায্য। তবে, বিরক্তি, উদ্বেগ, হতাশা, ভয়- আবেগের এই ধাপগুলোর ব্যাপারে শিশুদেরকে বুঝাতে হবে, তাদেরকে জানাতে হবে কোন আবেগটি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। তারা কতোটা জানে ও বুঝে তার উপর নির্ভর করে তাদেরকে এইসব বিষয়ের সাথে পরিচিত করাতে হবে। তাদেরকে বুঝাতে হবে কোন আবেগটাকে কীভাবে প্রকাশ করতে হবে।

শিশুদের শাসনের সবথেকে সুন্দর উপায়টি হয় তাদের প্রিয় কোন জিনিস থেকে বিরত রাখা; আজ রাতে ঘুমানোর সময় গল্প পড়ে শুনাবো না, এই সপ্তাহে ঘুরতে যাওয়া নিষিদ্ধ- ইত্যাদি। শিশুদেরকে শাসনের ব্যাপারে আল্লামা তাকি উসমানি বলেন, “শিশুদের শাসন করার সবথেকে উত্তম উপায়টি হচ্ছে তাদের ছুটি মওকুফ করে দেয়া”।(৫)

আমাদের একটা বড় ভুল হলো আমরা শিশুদের ভুলগুলোকে আমাদের বড়দের নীতিতে মাপতে যাই। অথচ, শিশুরা কখনোই এতো সচেতনভাবে কোন আচরণ প্রকাশ করেনা। তারা ভালোটার বিকাশ ঘটাতে চায়, কিন্তু খারাপটা দেখলে পার্থক্য বুঝতে পারেনা। ফলে, তাদের কাছে উভয়টিই অণুকরণীয় হয়ে উঠে। ৪ বছর বয়স থেকে তারা আবেগের ব্যাখ্যা বুঝতে শুরু করবে। এই বয়স থেকেই তাদের মাঝে খারাপ গুণাবলীর বিকাশ ঘটে; পরিবার, পরিবেশ, বন্ধুবান্ধবের প্রভাবে। তাই, তাদেরকে খুব যত্নের সাথে বুঝাতে হবে কী করে আবেগকে গুছিয়ে উপস্থাপন করতে হয় এবং কেন কোন আচরণ ভালো না। ৭ বছরের আগে তারা যুক্তি বুঝবে না, তবে ভাষা চিনতে পারবে। এই আলোচনার ফল দেখা যাবে ৭ বছর বয়সে, যখন তারা আবেগের প্রয়োগ করতে শুরু করবে- সচেতনভাবে। মূলকথা, আমাদের মনে রাখতে হবে, শিশুরা মাত্র শিখছে, তাদের কোন আচরণ বা প্রতিক্রিয়াই চূড়ান্ত নয়। এতে বাবা-মায়ের ধৈর্য্য রাখার জন্য আলাদা কোন মেডিটেশন ক্লাস করার দরকার হবেনা, কেননা শিশুরা একেবারে উচ্ছন্নে চলে যাবেনা যে নিজেদেরকে এতোটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বাবা মায়েরা হিমশিম খাবেন। ছোটবেলা থেকে‌ই যদি এমন বোঝাপড়া করে অভ্যস্ত হয়ে উঠে তবে বড় হয়ে এরকম সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের কদর করা খুব অসম্ভব কিছু হয়না। বরং, তারা খুব সহজেই বাবা-মায়ের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

তথ্যসূত্রঃ

১) সন্তান আল্লাহর ওলী হয় যেভাবে- রাহনুমা প্রকাশনী

২) শিশুর মনঃসমীক্ষণ- রাহাত আহমেদ অনূদিত

৩) Emotional Inteligence- Daniel Goleman

৪) Home Education- volumn 1

৫) মাসিক আলকাউসার- ২০০৯ এর মার্চ মাসের সংখ্যা