বিয়ে হলো ৬মাস। বিয়ের আগে থেকেই মাসিক অনিয়মিত ছিল। কখনো এক মাস পর কখনো ২ মাস পর এমন হতো। আবার প্রচন্ড ব্যাথাও হতো। পরীক্ষা নীরিক্ষা শুরু করেছিলাম। নিজে ডাক্তার হওয়ার সুবাদে বুঝলাম,পলিসিস্টিক ওভারি আছে কিন্তু তেমন গুরুতর অবস্থায় না। শুধু পিরিয়ড নিয়মিত করে নেওয়ার জন্যে চিকিৎসা শুরু করলাম বিয়ের পর পরই। ৩মাস ওষুধ খাওয়ার পর আবারও আলট্রাসাউন্ড করে ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডিউটি আর এটা সেটা কাজের মধ্যে একটু দেরি হলো।

মাসটা নভেম্বর, আমার পিরিয়ড মিস ২মাস। বাসায় প্রেগন্যান্সি টেস্ট করলাম। নেগেটিভ আসলো। এরপর সেই আল্ট্রাসাউন্ডটা করলাম যা পলিসিস্টিক ওভারি ফলো-আপে করার কথা। তাতেও কিছু আসলোনা। নভেম্বর ২৬তারিখ থেকে স্পটিং বা ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত গেল প্রতিদিন প্রায় ৪/৫দিনের মতন। ভাবলাম(সাথে ডাক্তারও বললেন) এইবারের পিরিয়ডটা এভাবেই হলো বুঝি। তারপর থেকেই তলপেটে হালকা ব্যাথা,প্রস্রাবের ইনফেকশন ধরে নিয়ে ওষুধ খেলাম। পানি বেশি করে খাওয়া শুরু করলাম। ডিউটি প্রেশার এত্ত বেশি ছিল সেই সময়টাতে, নিজের দিকে ভালভাবে খেয়াল করার কোন সুযোগই ছিলনা।  


ডিসেম্বর ৭,ইভনিং ডিউটি! রাত ১০টায় শেষ হবে এই ডিউটি। সন্ধ্যা ৭টায় তীব্র ব্যাথা শুরু হলো। এদিকে হুহু করে রোগী আসছে। আমি,আমার সহকর্মী,আমাদের সিনিয়র রোগী রিসিভ করে শেষ করতে পারছিনা। ওয়ার্ডেও রোগী খারাপ। এইসময়টাতে পেট ব্যাথা বলে রেস্টে যাওয়াটাতে খুব বিবেকে বাধছিলো।ব্যাথা ছিল,বামপাশে। পেইনকিলার ইনজেকশন নিলাম। কিছুক্ষণ সময় দিলাম,বুঝলাম, ব্যাথা ভোতা হয়ে এসেছে। আমার সিনিয়র বার বারই জিজ্ঞেস করছিলেন, “তোমার কি কোন সমস্যা আছে কিনা দেখ!”


আমি ভুলেও ভাবিনি Ectopic pregnancy এর কথা। ভোতা হয়ে যাওয়া ব্যাথাটা নিয়ে পুরো ডিউটি শেষ করে বাসায় আসলাম। আমার হাজব্যান্ড তখনো ডিউটিতে,না পেরে তাকে আসতে বললাম। সে এসে বুঝলো, ডায়াগনোসিস যা-ই হোক,এটা ইমার্জেন্সি।  


গেলাম হাসপাতাল। ভর্তি হলাম। শুক্রবার। কোথাও কিছুই এভেইলেবল নেই। শারীরিক পরীক্ষায় ডায়াগনোসিস হলো এপেন্ডিসাইটিস। যে ব্যাথাটা উঠেছিলো বামপাশে, পরে সেটা ডানপাশে অনুভূত হচ্ছিলো। সেইরাতে ১২টার দিকে এত ব্যাথা উঠেছিলো,আমি আমার হাজব্যান্ডকে কান্না করে বলেছিলাম, “আল্লাহ-কে বলোনা আমার ব্যাথা কমায় দিতে!” ঐ মুহুর্তটাই ছিল,টিউব ফেটে যাওয়ার ব্যাথা। আমার হাজব্যান্ডের কাছে আমি খুব সহ্যশীল মেয়ে হিসেবে পরিচিত। সে ঐ কথাতেই আমার ব্যাথার তীব্রতা বুঝতে পারে। প্রেসার কমে যাচ্ছিলো,স্যালাইন,ব্যাথার ওষুধ চলছে।

সে রাতে আমার বেঁচে থাকার কথা ছিলোনা,পেটের ভেতরে টিউব ফেটে গেলে মানুষ মুহুর্তেই মারা যায় অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয়ে। আল্লাহ বাঁচিয়েছেন,তাই বেঁচে আছি।

পরদিন সকালে ইমার্জেন্সি আল্ট্রাসাউন্ড করে ডাক্তার বললেন,Rupture ectopic pregnancy। মানে টিউবে বাচ্চা এসেছিলো,টিউব বাচ্চা বড় হওয়ার জন্যে উপযোগী নয়,তাই টিউব ফেটে গিয়ে পেটে রক্তক্ষরণ হয়েছে। তার কিছুক্ষণ পরই আমার অপারেশন হয়। ফেটে যাওয়া টিউবটা কেটে ফেলা হয়। ব্লাড দেওয়া হয় ২ব্যাগ। যেহেতু আমার ব্লাড গ্রুপ নেগেটিভ আর আমার স্বামীর পজিটিভ,সেক্ষেত্রে একটি এন্টি ডি ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়।

২ দিন পর বাড়ি ফিরে আসি। আমার ডাক্তার বলেন,২মাস পর আবার বাচ্চার জন্যে চেষ্টা করতে। ভেতরের সিস্টেমটাকে একটু সময় দিতে সবটা সামলে নিতে। ২মাস পর থেকে চেষ্টা করলাম। এবার আমার পিরিয়ড নিয়মিতই ছিল।


৮মাস পর আমার পিরিয়ডের তারিখ আসার ২দিন আগেই অন্যরকম একটা ব্যাথা হওয়া শুরু হলো। এবার ছিলাম গাইনী ডিউটিতে। ২দিন আগেই দেখলাম, প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজিটিভ। এখানে কিছু কথা আছে, প্রেগন্যান্সি টেস্ট সাধারণত মাসিকের তারিখের ৭-১৪দিন পর পজিটিভ আসে। যে হরমোনের কারণে পজিটিভ আসে তা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায় Ectopic pregnancy তে। তাই আমার তারিখের আগেই পজিটিভ আসাকে আমাদের কোন ম্যাডামই ভাল চোখে দেখলেন না। টেস্ট দিলেন,  
serum beta hcg, 2 / 2urine for pt, tvs।


TVS করে জানলাম,আবারও ectopic pregnancy কিন্তু, এখনো ফেটে যায়নি। তারমানে আমার টিউব রক্ষা করার আশা আছে। ২দিনের ব্যবধানে আবারও beta hcg করলাম। বুঝলাম, ভ্রুণের আকার বাড়ছে। কিন্তু ব্যাথা আর অন্যান্য উপসর্গ ছিলনা। কিন্তু আমার পালস অনেক বেশি ছিল,তা বিপদজনক। এক্ষেত্রে অনেকধরণের ট্রিটমেন্ট অপশন থাকে। সিদ্ধান্ত হলো, সার্জারী হবে, যদি টিউব ফেটে থাকে,তবে কেটে ফেলা হবে। আর যদি অক্ষত থাকে তবে, কনজার্ভেটিভ সার্জারী করা হবে।

অপারেশন থিয়েটারে ঢুকার আগে ২রাকাত সালাত পড়েছিলাম, আল্লাহকে বলেছিলাম,”আপনি যদি টিউব কেটে ফেলা  এবং সন্তান নিয়ে এই পরীক্ষা আমার জন্যে উত্তম মনে করেন আমি তাই মেনে নিলাম,আর যদি বাচ্চা থাকা উত্তম মনে করেন তাও মেনে নিলাম। আপনি যা দিয়েছেন, দিবেন তার জন্যে আলহামদুলিল্লাহ। শুধু আমাকে সহ্য করার শক্তি দিয়েন আল্লাহ!”


আমরা যখন কোন বিশেষ কাজে যাই, আমরা আমাদের খুব প্রিয়জনের সাথে দেখা করে যেতে পারলে ভাল লাগে,সেদিন আমার মনে হয়েছিলো, আল্লাহর সাথে একটু কথা বলে গেলেই আমার বুকের বোঝা হালকা হবে।


আগেরবারের অপারেশনে আমি পুরোপুরি অচেতন ছিলাম,এবার স্পাইনাল দিয়ে হলো। সার্জারীর সময়ই জানলাম,টিউব ফাটেনি। সব ঠিক আছে। এমনকি কোন ভ্রুণ/ভ্রুণথলিও নেই টিউবে। বাইরে কিছু কালেকশন জমে ছিল, সেগুলো ডাক্তার পরিস্কার করে সার্জারী শেষ করলেন। ectopic pregnancy তে, টিউব থেকে অনেকসময় নিজেই এবোরশন হয়ে যায়। ডাক্তার বললেন তাই হয়েছে। এবারও মানসিকভাবে শক্ত ছিলাম। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করলাম। ২দিন পর ডিসচার্জের আগে করে একটা TVS করা হলো,জরায়ুতে কোন কালেকশন আছে কিনা দেখার জন্যে। দেখা গেলো,জরায়ু খালি আছে। ডাক্তার, আমার স্বামী(যিনি নিজেও ডাক্তার) সবাই বললেন ২/৩বছর পর বাচ্চার জন্যে চেষ্টা করতে। এভাবে বার বার ectopic pregnancy হবে, সেকথা কাজের কিছু না।
আমি মেনে নিলাম।


তারপর ওষুধের প্রভাবে খেতে পারতাম না। এক বছরের মধ্যে দুইবার ectopic pregnancy, surgery সব মিলিয়ে খুব দুর্বল হয়ে গেলাম। ট্রিটম্যান্ট প্রটোকলের অংশ হিসেবেই ১৪দিন পর আবার একটা TVS করলাম, রিপোর্ট আসলো,


7 weeks of normal pregnancy! আলহামদুলিল্লাহ!  
ডাক্তারী ভাষায়,এর ব্যাখ্যা একটাই। Heterotropic pregnancy, যেখানে যমজ ভ্রুণের একটি জরায়ুতে এবং আরেকটি অন্যত্র হয়। সাধারণত একটি নষ্ট হয়ে গেলে অন্যটি বেঁচে থাকে খুব কম সংখ্যক।  
আমার কাছে একটাই ব্যাখ্যা ছিল, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার অসীম দয়া ছাড়া কিছুই না। গর্ভকালীন গল্পটা অন্য একদিন বলবো। আমার মেয়ের বয়স এখন ১৮মাস।


গল্পটা শুধু আমার ectopic pregnancy এর সচেতনতার জন্যে না,বরং যত মেয়ে বাচ্চা হওয়া নিয়ে ভয়ে আছেন, দুশ্চিন্তায় আছেন,হতাশায় আছেন, তাদের তাওয়াক্কুল করতে পারার সাহস দেওয়ার জন্যে বলা। আল্লাহ নিশ্চয়ই সাথে আছেন।

(লিখেছেন: ডাঃ এন)

ছবি কৃতজ্ঞতা: Pinterest

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা