কারিকুলামে ব্যাপক পরিবর্তন বা ঢেলে সাজানোর দরকারটা অনুভব করার পেছনে আমার নিজস্ব কিছু চিন্তা রয়েছে। কেননা, আমার ‘ধারণা’, কারিকুলামে পার্থক্য শিক্ষায় অনেক বড় পার্থক্য তৈরি করে।
আমরা অনেক সময় খবরের কাগজে বিস্ময়বালক বা বিস্ময়বালিকাদের গল্প পড়েছি। গল্পের বালক বা বালকা ছিল হয় পথশিশু, আর নাহয় কোন বাসার কাজের ছেলে বা মেয়ে। বয়স যখন দশ বা বারো, তখনই সপ্তাহখানেক সময়েই অক্ষর চিনে একেবারে খবরের কাগজ পড়াটা রপ্ত করে ফেলে। তার মাসখানেকের মধ্যে তাকে তার বয়সীদের সাথে স্কুলে উপরের ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম প্রথম একটু হোঁচট খেলেও সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে।
আসলে বেশিরভাগ বাচ্চাই এরকম বিস্ময়বালক বা বিস্ময় বালিকা হতে পারতো, যদি না আমরা ছোটবেলা থেকেই নিজেদের ও ওদের মেধার অপচয় করে ওদের শৈশবটা নষ্ট না করতাম। পথশিশুদের মধ্যে পড়াশোনার সুযোগ জীবদ্দশায় পায়ই খুব কম শিশু, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ আবার তীব্র অপুষ্টির শিকার। একারণে প্রতিদিন দশটা বিস্ময়শিশুর গল্প আমরা পড়িনা। কিন্তু আমাদের যাদের বাচ্চাদের আল্লাহ মানসিক ও শারিরীক পুষ্টির নিয়ামত দিয়েছেন, তাদের প্রায় প্রত্যেকের বাচ্চারই বিস্ময়শিশু হওয়ার সামর্থ আছে।
উদাহরণস্বরূপ কাছাকাছি মেধা ও সুযোগ সুবিধাপ্রাপ্ত দুইজন বাচ্চার মধ্যে তুলনা করা যাক।
দুজনেরই হোমস্কুলিং শুরু হয়েছে দুই বছর বয়সে। কারিকুলাম সম্পুর্ন আলাদা। এখানে আমি শুধু বোঝার সুবিধার্থে একটা সাবজেক্ট (যেমনঃ আরবী ভাষা) এর উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, একজনকে তার অভিভাবক অক্ষর শেখানো দিয়ে শুরু করেছেন। এক এক দিন এক একটা অক্ষর। আলিফ, বা, তা। অক্ষর শেখানোর জন্য ব্যবহার করছেন ঐ অক্ষরের ছড়া, বই, ফ্ল্যাশকার্ড, স্টিকার, পোস্টার, প্লে ডো দিয়ে অক্ষর বানানো, সুতা দিয়ে অক্ষর বানানো বা বড় একটা প্লেটে টমেটো সস দিয়ে অক্ষর আঁকার খেলা ইত্যাদি হরেক রকম এক্টিভিটি।
প্রতিদিন প্রায় ঘন্টা দুয়েক সময় যাচ্ছে প্রস্তুতিতে, আরো ঘন্টা দুয়েক যাচ্ছে পড়ানোতে। অথচ প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাস্তবতা হলো, বাচ্চাটা মাসখানেক পর একটা দুইটার বেশি অক্ষর মনে রাখতে পারবে না। ছয় মাস বা এক বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর তাকে মোটামুটি বিশ পঁচিশটা অক্ষর শিখিয়ে ফেলা যাবে। তাও বা, তা, সার মধ্যে প্যাঁচ লাগাবে, জিম, হা, খা গুলিয়ে ফেলবে প্রায়ই। এরপর যবর যের পেশ দিয়ে পড়ার সময় সে কিয়াসটা ধরতে ধরতে প্রায় মাসখানেক সময় নিয়ে নেবে। রিডিং চালু করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেও যদি তাকে যথেষ্ট সময় ও ছাড় দেওয়া না হয়, চোখের পানি নাকের পানি এক করার সম্ভবনা আছে। চাপ না দিয়ে তার সামর্থ অনুযায়ী আগাতে থাকলে সাবলীলভাবে পড়তে শিখবে সে সাড়ে চার বা পাঁচে। কেননা এর আগে তার লজিকের সেন্স তৈরির মত বয়সই হয়নি। উল্লেখ্য, ততদিনে সে শুধু রিডিং পড়া বাদে আর তেমন কিছু নিয়মতান্ত্রিক ভাবে শেখেনি, কেননা এই এক কাজেই তার অভিভাবকের প্রচুর সময় চলে গেছে।
আরেকজন বাচ্চাকে তার অভিভাবক অক্ষরের সাথে আদৌ পরিচয় করাননি, তেমন সময়ও দেননি তাকে আলাদাভাবে। তার সাথে দুই বছর বয়স থেকে নিয়মিত বাসায় সারাক্ষণ আরবী ভাষায় কথা বলা শুরু করেছেন, সব কথা। কোনরকমে আটকে আটকে বাক্য সাজিয়ে বলা না, সাবলীলভাবে বলা। বাচ্চা প্রথম কিছুদিন হা করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছে যে হচ্ছেটা কী আসলে, ভাব আদানপ্রদানের জন্য ইশারার উপরই নির্ভর করেছে বেশি, যেহেতু সে আরবী একেবারেই জানে না। কিন্তু খুব দ্রুতই নিজের প্রয়োজনেই সে সবচেয়ে দরকারী শব্দগুলো রপ্ত করে ফেলে, এবং কয়েক মাসের মধ্যেই সাবলীলভাবে আরবী বলা শুরু করে। কেননা, এই বয়সটাই ভাষা শেখার সবচেয়ে উপযুক্ত বয়স। এমনকি বয়স সাড়ে তিনের মধ্যে তার আর তার অভিভাবকের আরবী বলার লেভেলের মাঝে আদৌ পার্থক্য করা কঠিন হয়।
তিন বছর বয়স থেকেই তার অভিভাবক নিয়মতান্ত্রিক ভাবে তার পড়াশোনা শুরু করতে পারেন আরবী সাহিত্য দিয়ে। প্রথমে বাচ্চাদের উপযোগি ছোট ছোট নবী রাসূলের(আঃ) গল্প, কুরয়ানের গল্প, সীরাহ ইত্যাদি পড়ে শোনানো দিয়ে শুরু করে ধাপে ধাপে কঠিনে যেতে থাকা। বাচ্চা যেহেতু ভাষাটা বোঝে, সাহিত্যে তার আগ্রহ পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কোন বাচ্চা গল্প বা ছড়া পছন্দ করে না? দিনে ঘন্টা খানেক বা ঘন্টা দুয়েক সময় দিয়ে বয়স সাড়ে চার বা পাঁচ হতে হতে সে মূলধারার সহজ আরবী সাহিত্য ‘শুনে বোঝার’ জন্য তৈরি হয়ে যেতে পারে। উল্লেখ্য, সে কিন্তু নিজে পড়তে পারে না। তবে বিভিন্ন সময়ে খুব ভালোলাগার ছড়াগুলো, বা সাহিত্যের কোন কোন লাইন, কোন কোন কথা সে নিজের ভালোলাগা থেকেই মুখস্থ করে ফেলে(আমরা অনেকে যেমন সিনেমার অনেক বিখ্যাত ডায়লগ একবার শুনেই মুখস্থ করে ফেলতাম কেননা সেগুলো আমাদের ছুঁয়ে যেত)। এই মুখস্থ করার প্রতি সামান্য জোর আরোপ করে তার মুখস্থ শক্তি খবরের কাগজের সেই বিস্ময়শিশুদের মত করে ফেলা যায়। আলাদা সময় দেওয়াও লাগে না। শুধু কোন কিছু পড়ে শোনানোর সময় আলাদাভাবে সুন্দর অংশগুলোতে গুরুত্ব আরোপই অনেকটা কাজ করতে পারে।
পাঁচ হওয়ার পর যখন সে ছোটখাটো পর্যায়ের মূলধারার সাহিত্য বোঝে এবং পছন্দ করে, তখন তার পরিপক্ব মস্তিষ্ককে অক্ষর চেনানো শুরু করলে মাস ছয়েকের মধ্যেই সে সাবলীলভাবে রিডিং পড়া শুরু করতে পারবে, বিস্ময়শিশুদের মতো। বয়স যখন সাড়ে পাঁচ, তখন অনেকগুলো কারণে সে রিডিং পড়ার এবং ভাষা বোঝার, উভয় দিক দিয়ে প্রথম বাচ্চাটার চেয়ে এগিয়ে থাকবে। ভাষা সাহিত্য বোঝায় এগিয়ে থাকা নাহয় বোঝা গেল। কিন্তু রিডিং কিভাবে? যেখানে প্রথম বাচ্চাকে পুরো সময় ধরে শুধু রিডিং পড়াই শেখানো হয়েছে? রিডিং এ এগিয়ে যাওয়ার কারণ হলো, প্রথম বাচ্চাটা আরবী একেবারেই জানে না, শুধু পড়ার তরীকা জানে। আর দ্বিতীয় বাচ্চাটার কাছে আরবী একটা পরিচিত ভাষা, সব শব্দই তার পরিচিত শব্দ। প্রথম বাচ্চাটা আর কিছুদিন পর হয়তো মাদীনা এরাবিক শুরু করবে, যেখানে দ্বিতীয় বাচ্চাটার আদৌ বেসিক আরবী শেখার কোর্স প্রয়োজন হবে না। সে সরাসরি নাহু পড়বে সময়মতো, প্রথম বাচ্চার চেয়ে কম বয়সে, প্রথম বাচ্চার প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ সময়ে এবং আরো পাকাপোক্তভাবে সে নাহুর নিয়মগুলো আয়ত্ব করবে। শুধু নাহু না, আরবী অবচেতনভাবে শেখার কারণে এবং সাহিত্যের অঙ্গণে বিচরণের কারণে আরবীর বাকি উলুমগুলোও সে খুব দ্রুত আয়ত্ব করবে। সে আরবী ভাষার দক্ষতায় পনেরো বছর বয়সে যেখানে পৌঁছাবে, প্রথম বাচ্চাটার সেখানে পৌঁছাতে লাগবে কমপেক্ষে বিশ থেকে পঁচিশ বছর, যদি সে খুব তুখোড় মেধাবী ও আগ্রহী ছাত্র হয়। কুরয়ান বোঝা ও মুখস্থের ক্ষেত্রেও যে কোন বয়সেই দ্বিতীয় বাচ্চা এগিয়ে থাকবে।
আমি উদাহরণটা দিয়ে এটা বোঝাতে চাচ্ছি না যে আরবী ভাষা শেখা জরুরী বা শেখাতে হবে।
এটা আমি শুধু একটা সাবজেক্ট দিয়ে উদাহরণ দিলাম। সমস্ত সাবজেক্টেই শুধুমাত্র কারিকুলামের পার্থক্য ফলাফলে আকাশ পাতাল পার্থক্য তৈরি করতে পারে বলে আমার মনে হয়। আমি দ্বিতীয় বাচ্চাটার কারিকুলাম নিজের মত সাজালেও আমি সত্যিই জানিনা দ্বিতীয় বাচ্চার আরবী কারিকুলামে কোন ত্রুটি আছে কিনা, হতে পারে অনেক পয়েন্ট মিস করে গেছি, অনেক কিছু বিবেচনায় আনিনি। এজন্যই চিন্তাভাবনা অব্যহত রাখার কোন বিকল্প নেই। বিকল্প নেই মায়েদের লিংগুইস্টিক্স, সাইকোলজিসহ সহ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন ও পারষ্পরিক আলোচনার।
সত্যিকারার্থে উদাহরণটিতে দ্বিতীয় বাচ্চার আরবী কারিকুলাম আদৌ কাজ করবে কি করবে না, সেটা তার বয়স অন্তত দশ বা পনেরো হওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। ততদিনে যুগ থেমে থাকবে না। প্রথম বাচ্চার বয়সও থেমে থাকবে না।
কাজেই সব মায়েদেরই বিভিন্ন বিষয়ে আলাদাভাবে ও সার্বিকভাবে সব বিষয়ে কারিকুলামসহ পড়াশোনার সার্বিক পদ্ধতি নিয়ে এখনই কাজ করা, চিন্তা করা জরুরী। সময় হাতে নেই।
দ্বিতীয় বাচ্চার অভিভাবকের মত কারিকুলাম বানানোর চেয়ে কঠিন কাজ হলো ঐ কারিকুলাম ফলো করা। ঐ পর্যায়ে আগে নিজেদের আরবী বা অন্য কোন ভাষাকে নিয়ে যেতে তো হবে, যাতে তা মাতৃভাষার মত না হলেও কাছাকাছি অন্তত সাবলীল হয়। মা বাবা যদি নিজেরা ভাষা ও সাহিত্যের অঙ্গণে বিচরণ করে পারদর্শী না হন, বাচ্চার না হবে বাংলার শক্ত ভিত্তি, না হবে সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজের। সেটা যদি আরবী হয়ে থাকে, আরবীতে কথা বলা মানে কোন রকমে সহজ সহজ বাক্য তৈরি করতে পারা না। নিজের আবেগ অনুভুতি থেকে শুরু করে সমস্ত পরিস্থিতি, সমস্ত কথা শুদ্ধভাবে আরবদের মত বলতে পারতে হবে, যেটা আরব দেশে জন্মেও খুব খুব কম মানুষ পারেন। পুরোপুরি হওয়া প্রায় অসম্ভব, তবুও এর যত কাছাকাছি যাওয়া যাবে, তত ভালো ফল পাওয়া যাবে।
কাজেই, ভালো কারিকুলামের পেছনে সঠিক চিন্তা ও পরিকল্পনা যেমন জরুরী, তেমন জরুরী বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের স্কিল তৈরি করতে উঠে পড়ে লাগা। একথা যেকোন ভাষা ও ভাষাবিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি সত্য যুক্তিবিদ্যা, গণিত, বিজ্ঞান, শিল্পকলা ইত্যাদি সকল বিষয়ের ক্ষেত্রে। এই সকল বিষয়েই একজন মায়ের একই সাথে অভিজ্ঞ হতে পারার সম্ভবনা যেহেতু কম, কাজেই সার্বিকভাবে একটা সফল কারিকুলাম তৈরিতে বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী এবং বিচক্ষণ মায়েদের এগিয়ে আসা ও পরষ্পরকে সাহায্য করা জরুরী।