চার্লট ম্যাসন উনবিংশ শতকের শেষ দিকে একটা অসাধারণ বই এর সিরিজ লিখেছেন হোমস্কুলিং তথা গোটা শিক্ষার দর্শনের উপর। সিরিজের ছয়টা বই একত্রে বইটা ১৬৭০ পৃষ্ঠার। বইটার বেচা বিক্রি খুব একটা ভালো না।
এই বইগুলোর আলোকে তিনি মূলত কী বুঝিয়েছেন সেটা ব্যাখ্যা করে প্রায় দুই আড়াইশ’ পৃষ্ঠার ডজনখানেকের উপর বই লেখা হয়েছে। বইগুলো বেশ ভালোই চলে বাজারে।
এই ডজনখানেকের কোন একটা ব্যাখ্যা পড়ে কেউ একজন একটা আর্টিকেল লেখেন নেটে। গুগল সার্চ দিয়ে সেটা পড়ে প্রায় এক লাখ লোক।
ট্রাজেডি হলো, এই এক লাখ লোকই ভাবে, চার্লট ম্যাসনের ফিলোসফি তারা ‘জানে’। সারাজীবন আমরা গাইড আর নোট পড়ে পাশ করেছি, মূল পাঠ্যপুস্তক ধরিনি একথা সত্য। কিন্তু তাই বলে ১৬৭০ পৃষ্ঠার বইকে, যেখানে আপাতদৃষ্টিতে কোন বাহুল্য কথা নেই, যে কথাটা এক লাইনে বলা যায় তার জন্য বিশ লাইন খরচ করা হয়নি, একটা ছোট্ট আর্টিকেলে সামারাইজ করে ফেলা মানে হলো বায়ান্ন থেকে একাত্তরের ইতিহাসকে এক লাইনে সামারাইজ করে ফেলা।
এইটুকু পড়ে যদি কেউ দাবি করে যে সে ইতিহাস জেনে ফেলেছে, দাবিটা কি গ্রহণযোগ্য হবে? আমরা ঠিক তাই করছি হোমস্কুলিং এর বেলায়।
আরো বড় ট্রাজেডি, এই জানার ভিত্তিতে আমরা নিজেদের বাচ্চাদের ‘চার্লট ম্যাসন মেথডে’ হোমস্কুলিং করতে নেমে যাই।
আমরা মায়েরা বাচ্চাদের জন্য সাধ্যে যা কুলায় তার চেয়েও বেশি কষ্ট করি। নবজাতকের জন্য রাতের পর রাত জাগি, খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাই। কারণ এটা ছাড়া যে তার চলবে না। অথচ নিজেরা হোমস্কুলিং করানোর বেলায়, সন্তানের শিক্ষা তথা জীবন গঠনের গুরুদায়িত্ব নেয়ার বেলায় সবচেয়ে আরামের, সবচেয়ে সহজ, সবচেয়ে সস্তা কন্টেন্টের চেয়ে বেশি কিছু চেষ্টাই করি না।
আমরা বই পড়িনা, ইন্টারনেটে আর্টিকেল পড়ে পড়েই যেন আমরা সব জেনে ফেলার ভান করি। খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে হোমস্কুলিং করতে নেমে যাই। যে ব্যাপারটা আমরা মাথায় রাখি না, সাধারণ স্কুল বা মাদ্রাসার প্রতি বিরক্তি থেকে যদি আমাদের হোমস্কুলিং এর সূচনা হয়, স্কুল বা মাদ্রাসার কারিকুলাম প্রণয়ন যাঁরা করেছেন তাঁরা অন্তত শিক্ষার ব্যবস্থা সম্বন্ধে কিছু হলেও জানেন। অন্তত তাঁদের লেভেলেও নিজেদের জ্ঞানকে উঠাতে না পারলে তাঁদের কারিকুলামের চেয়ে নিম্নমানের কারিকুলামে, ভুল প্রক্রিয়ায় সন্তানকে গড়ে তুলবো আমরা। এটার জন্য ইন্টারনেট এর জ্ঞান কোন জ্ঞানই না। বই পড়তে হবে, বইই পড়তেই হবে।
কী ধরণের বই পড়তে হবে?
হোমস্কুলিং জ্ঞানের কোন নির্দিষ্ট শাখা না যে এটার একটা মোটামুটি নির্দিষ্ট সিলেবাস বা পাঠ্যপুস্তক থাকবে। এডুকেশনের ফিলোসফি নিয়ে যাঁর পড়াশোনা আছে তিনি এক রকম ভালো হোমস্কুলার হবেন। চাইল্ড সাইকোলজি যিনি পড়েছেন তিনি আরেক দিক থেকে ভালো হোমস্কুলিং করবেন। প্যারেন্টিং নিয়ে আলাদাভাবে পড়েছেন বা জেনেছেন এরকম কেউ ভালো হোমস্কুলার হবেন। যিনি যেই বিষয়ে ভালো দখল রাখেন ঐ বিষয়ে তিনি ভালো ফিলোসফি ও কারিকুলাম নিয়ে আসতে পারবেন। সাধারণত একই সাথে এত কিছুর সমন্বয় করা খুব কম মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে। এজন্য হোমস্কুলিং কমিউনিটি তৈরি করা হয় যাতে সবাই সবাইকে সাহায্য ও আলোচনা করার মাধ্যমে সবার থেকে সবাই উপকৃত হতে পারে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের কারোরই সেরকম পড়াশোনার অভ্যাস নেই। যার ফলে অনেক সময় কমিউনিটি থাকলেও মতবিনিময়ের সময়ে অনেক মতামত উঠে আসলেও, দীর্ঘ আলোচনা হলেও আলোচনাগুলো হয় প্রায় অসার। কেননা, আলোচনাকারীরা প্রায় কেউই জ্ঞান থেকে উদ্ভুত মতামত নিয়ে আসেন না, তাঁরা বইটইও তেমন পড়েন না। মতামত তো সবারই থাকে, একটা বাচ্চাও মতামত দিতে পারে। কিন্তু তার মতামতের উপর কি নির্ভর করা যায়? যায় না কেননা সে জানে না। আমরা যদি নিয়মিত পড়ার ও জানার সংস্কৃতি গড়ে না তুলি, আমাদের মতামতের মান খুবই অপরিপক্ক ও অদূরদর্শী হবে। আমরা সেটা অনুধাবন করি বা না করি।
আমাদের বাস্তবতায় হোমস্কুলিং কমিউনিটিগুলোর একটা প্রধান কাজ হওয়া উচিত নিজেরা নিজেদের ভালো বই পড়তে মোটিভেট করা। এটা করার জন্য নিজেদের মধ্যে বই পড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট সময়ে একটা বই পড়া শেষ হলে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে বইটার উপর মতামত দিতে হবে। সেখানে নিজের সংযোজন, বিয়োজন, দ্বিমতের প্রতিফলন থাকতে পারে। কিন্তু সবাইকেই মতামত দিতে হবে কেননা কে আসলেই কতটুকু পড়ে আমরা বুঝতে পারছি বা প্র্যাক্টিকালি উপকৃত হচ্ছি, মতামতের মান দেখলে অনেকটা বোঝা যাবে।
প্রত্যেকে বাকিদের মতামত শুনবেন এবং সবচেয়ে ইনসাইটপূর্ণ মতামত সবাই মিলে বাছাই করবেন। এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে ভালো গঠনমূলক মতামতের এগিয়ে থাকার সম্ভবনা শতভাগ না, বরং বেশিরভাগ মানুষের চিন্তার সাথে মেলে এরকম মতামতই ফার্স্ট সেকেন্ড হবে, তারপরেও চেষ্টা ছাড়া যাবে না। আমাদের সার্বিক অবস্থার উন্নতি হবে ধীরে ধীরে। যেটা আমাদের বাচ্চাদের হোমস্কুলিং করানোর জন্য এক নম্বর জরুরী কাজ। এই ভিত্তি দুর্বল রেখে তার উপর কাঠামো নির্মাণ করলে তা নড়বড়ে হবেই।
তাই বলে হোমস্কুলিং, শিক্ষা, প্যারেন্টিং, দর্শন, সাইকোলজির উপর লেখা সব বই এক এক করে পড়ে ফেলতে হবে না। এটা নিছক সময় নষ্ট। একটা ভালো মানের ক্লাসিক ‘পড়ার মত পড়া’ অনেক সময় ঐ টপিকে যথেষ্ট ধারণা নিয়ে ফেলার সামিল। ক্লাসিক বই পাশ কাটিয়ে বছরের পর বছর ইন্টারনেট আর সস্তা মানের বই পুস্তক ঘাটলে ফায়দা কমই হবে আমাদের।
আমাদের লক্ষ্য হতে হবে বড়। গতকাল হোমস্কুলিং এর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, পড়ায় তেমন তুখোড় না এরকম একজন মা প্রাথমিক কিছু ধারণা ইন্টারনেট থেকে নিতেই পারেন। কিন্তু ইন্টারনেটের আর্টিকেলের উপর নির্ভর করে তিনি বেশিদিন পড়ে থাকবেন না। দ্রুতই তাঁকে যে ফিল্ডগুলোর কথা বললাম, এগুলোর মধ্যে পর্যায়ক্রমে নিয়মতান্ত্রিক পড়াশোনা শুরু করতে হবে। পড়তে গিয়ে পদে পদে নিজেই গাইডলাইন পেতে থাকবেন আর কী কী পড়তে হবে তার উপর। চমৎকার একটা সূচনা হতে পারে সরাসরি হোমস্কুলিং বা শিক্ষা সংক্রান্ত টপিক দিয়ে।
বাচ্চা এখনও না জন্মালে বা একদম ছোট থাকলে হাতে যদি সময় থাকে প্যারেন্টিং বা চাইল্ড সাইকোলজি দিয়েও হয়তো শুরু করা যায়। হোমস্কুলিং এর ক্ষেত্রে ইন্টারনেটলব্ধ জ্ঞান হোমস্কুলিং এর ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি ও সেগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেবে। সেটার ভিত্তিতে আমাদের প্রথম কাজ হতে পারে, প্রত্যেকটা পদ্ধতির উপর সবচেয়ে ভালো একটা বা দুটো বই পড়া। যেমন, ক্লাসিকাল এপ্রোচের উপর লেখা সবচেয়ে ভালো বই হিসেবে ধরা হয় The well trained mind কে। মন্টেসরি নিয়ে জানার জন্য ফিরে যাওয়া ভালো মন্টেসরির জননী মারিয়া মন্টেসরির নিজ হাতে লেখা বইগুলোর দিকে। চার্লট ম্যাসন মেথডের জন্য চার্লট ম্যাসনের নিজের লেখা বইগুলোই পড়তে হবে।
এভাবে প্রায় ছয় সাতটা মূল বই অন্তত পড়তে হবে। এরপর এর মধ্যে যে বিষয় নিয়ে আরো জানা প্রয়োজন সেখানে আরো বিভিন্ন বই পুস্তক পড়া লাগতে পারে। ব্যাক্তিভেদে সেগুলো হয়তো ভিন্ন ভিন্ন হবে। খেয়াল করতে হবে, নেটের প্রাথমিক জ্ঞানে কোন একটা এপ্রোচ খুব আকর্ষণীয়, কোন একটা আবার একেবারেই আমাদের সাথে যায় না এরকম মনে হতে পারে। কিন্তু সবগুলোর উপরই অন্তত একটা বই পড়া দরকার। কেননা, নেটের আর্টিকেল দিয়ে কিছুই বোঝা যায় না।
আমার নিজের ক্ষেত্রে, নেটের তথ্য পড়ে মনে হয়েছিল আন্সকুলিং মেথডের চেয়ে অকাজের আর কোন কিছুই হতে পারে না। কিন্তু প্রাক্টিকালি আন্সকুলিং এর উপর বই পড়তে গিয়ে বুঝলাম, আমি আসলে আমার সন্তানকে আমার অধীনে পড়াশোনা করার পুরো সময়টাতে ধীরে ধীরে আন্সকুলিং এর দিকেই নিতে চাই, এর সাথে ক্লাসিকাল এপ্রোচের সংমিশ্রণ, একদম মেপে মেপে, মন্টেসরি আর চার্লট ম্যাসন শিক্ষার কন্সেপ্টের উপরে অনেক অনেক পার্সপেক্টিভ দিয়েছে, বিশেষত চার্লট ম্যাসন। অথচ এর আগে মন্টেসরি আমাকে কিছুটা টানলেও নেটের তথ্যে চার্লট ম্যাসনে আমি কোন আগ্রহই পাইনি। কাজেই বিভিন্ন ওয়েবসাইটের উপস্থাপিত তথ্য চূড়ান্ত জ্ঞানের উৎস হলে ভুল করার সম্ভবনা খুব বেশি।
চাইল্ড সাইকোলজির উপর আমার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান শুণ্যের কোঠায়। তবে ইন শা আল্লাহ এ বিষয়ে ভবিষ্যতে যদি পড়াশোনা করি, নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একজন মানুষকে সাইকোলজিস্ট হওয়ার জন্য যেভাবে আগাতে হয়, সেভাবেই পড়বো। এর পেছনে পাঁচ বছর ইনভেস্ট করা অনেক অনেক ভালো, পাঁচ বছরে আটটা ‘মেইড ইজি’ ধরণের বই পড়ার চেয়ে। সর্বসাধারণের জন্য ডিজাইন করা যেকোন বই বা কোর্স ইমার্রজেন্সির সময়ে সংক্ষিপ্ত সূচনা হতে পারে, যেহেতু সন্তান বড় হয়ে যাচ্ছে আর হাতে অফুরন্ত সময়ও নেই, কিন্তু লং রানে এটাই নিজের সন্তানের হোমস্কুলিং এর সম্পুর্ণ দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পড়ার সিলেবাস ও পদ্ধতি নিজ হাতে ডিজাইন করতে চান এরকম মায়েদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে পারে না।
সবার পড়ার ক্যাপাসিটি এক না। যে ভাষায় বা মাধ্যমে পড়ছি সেটার উপর দখল ও সাবলীলতাও সবার সমান না। মেডিকেল কলেজে ভর্তির পর প্রথম প্রথম ভীষণ কষ্ট হতো এনাটমি বইয়ের এক পৃষ্ঠা বুঝে পড়তে, অনেক সময় ডিকশনারি দেখে দেখেও কিছুই মেলাতে পারতাম না। আমাদের সবারই এই অবস্থা ছিল। পাশ করার তাগিদে শিখতে হয়েছে, কেউ এসে শিখিয়ে দেয়নি, শিক্ষকদের কাছে ধরণা দিতাম ‘মেইড ইজি’ পড়ে প্রথম টার্মটা অন্তত পাশ করতে পারার জন্য। উনারা বলতেন, ফেইল করো, তাও গাইড পড়া দরকার নেই।
আল্লাহর রহমতে মাস তিনেকের মধ্যেই সবাই এমন অবস্থায় উন্নীত হয়েছিলাম যে বই পড়ে বুঝি না, দ্রুত পড়তে পারি না এমন কেউই ছিলাম না। তার জন্য কাঠখড় কিছুটা পোহাতে হয়েছে। প্রথম এক মাস রাত জেগে পড়ার কারণে সকালে ক্লাসে ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসতো। ক্লাস শেষ করে হোস্টেলে ফিরেই কেউ কেউ বসে যেত বই নিয়ে। অগ্রগতি-প্রতি পাঁচ ঘন্টায় এক পৃষ্ঠা। তাও চেষ্টা থামায়নি কেউ।