মেয়েটা এসেছে বাচ্চা কোলে, ষোলো মাস বয়স বাচ্চার। কোলে বাচ্চা এসে যাওয়ায় পড়াশুনায় গ্যাপ হয়েছে। এখন ফিরতে চাচ্ছে আবার। সাহস করে এবার রেজিস্ট্রেশন করেছে কিন্তু বাচ্চা ‘ভয়ানক দুষ্টু’ হওয়ায় কারুর কাছে রেখে ক্লাস করা অসম্ভব। আসার দেড় মিনিটের মাথায় পিচ্চি মানুষটা আমার টেবিলের কেচি ধরলো, কাঁচের জারে হাত ডুবালো, টেবিল ঘড়িটা দুই হাতে ধরে কোলের কাছে নিয়ে হাঁটলো। মেয়েটা, বাচ্চার মা, বারবারই লজ্জিত হচ্ছে, হাত থেকে জিনিসগুলা নিয়ে জায়গামতো রেখে বিব্রতমুখে আমার দিকে তাকাচ্ছে৷ শেষে আর না পেরে দুই হাতে জাপটে ধরে বসলো। আমার সাথে সেরে একই রুমে অন্য ডেস্কে গেলো অন্য একজন স্যারের সাথে পরামর্শের জন্য।

অন্য স্যারের সাথে কথা শেষে আমি আবার ডাকলাম। বললাম, বসো কথা বলি। দুইটা প্লাস্টিকের গ্লাসের মধ্যে একটা বিস্কুট রেখে স্ট্যাপলার দিয়ে দুইটাকে মুখোমুখি জোড়া দিয়ে বাচ্চার হাতে দিলাম।
‘আচ্ছা তোমাকে যদি এমন হাতপা নড়াতে না দিয়ে এক জায়গায় আটকায় রাখি, কি করবা? অথবা বলি যে, এখন কিচ্ছু করবা না। চুপচাপ বসে থাকো। পারবা?’ না, পারবে না। মাথা নাড়লো। ‘তাহলে ও কেন থাকবে? ও কিভাবে পারবে? যেটাকে আমরা দুষ্টুমি বলি, সেটা ত ওর নরমাল নড়াচড়া। এটা না করলে ওকে ডাক্তারে নিতে হইত, কারণ ওইটা এবনরমাল। না?’
জি।
‘এখন আসো, ও বড় হচ্ছে, ওর অনেক কিছু দরকার। ওর নিরাপত্তাবোধ দরকার। ও যদি দেখে, আম্মু ওকে রেখেরেখে খালি চলে যায়, ও তোমাকে একবার পেলে আর ছাড়বে না, কোল থেকে নামবে না। বাথরুমে গেলেও অস্বাভাবিক কান্না করবে হয়ত।’
‘আর কী দরকার? ওর এখন মোটর স্কিল তৈরি হওয়া দরকার। হাত পা নাড়ানো, ঘোরানো, মুঠ করে ধরা, খামচি দিয়ে ধরা ইত্যাদি। মনে আছে আমরা এই বয়সে গ্রিল বেয়ে উঠতাম? বিছানা থেকে নামতাম, উঠতাম। আমাদের আম্মুরা শুধু দেখতেন ব্যথা পাচ্ছি কি না, কিন্তু কাজটা করতে দিতেন। আমরা দিই না। ভয় পাই, জাপটে ধরে রাখি। লেট হিম গ্রো। ময়দা, তেল, লবণ, পোস্টার কালার দিয়ে গোল্লা বানায় দিবা, খেলা শেষে ঘুমায় গেলে ওগুলো পলিথিনে করে ফ্রিজে রেখে দিবা। ওগুলা মাখবে, ধরবে, হাত শক্ত হবে। মার্কার দিয়ে ঘরে গোল গোল দাগ দিয়ে লাফ দিয়ে দেখাবা, ও দিবে। পা শক্ত হবে, আত্মবিশ্বাস বাড়বে, এবং ক্লান্ত হয়ে ঘুমাবে। নইলে সব শক্তি খরচ না হয়ে জমে হয়ে থাকবে, ঘুম পাড়াতে গেলে ঘুমাবে না।’ প্রবল মাথা নেড়ে বললো, আসলেই ত ঘুমায় না একদম।
‘আর দরকার হল, রিপ্লেসমেন্ট। তুমি ক্লাসে আসবা, পড়তে বসবা আর ওর হাত মাথা খালি। তখন পড়া বাদ দিয়ে ধরেনা, যায়না, মারেনা, খায়না এরকম দারোগাগিরি করা লাগবে। ওকে খেলনা দাও’। দিই ম্যাম, অনেক দিই। খেলে না। ‘কিনে দিবা না। একটা খেলনা একটু ঘুরলে, নড়লে, জানা হয়ে গেলে আগ্রহ শেষ। তুমি এই সামনের দোকান থেকে বড় আর্ট বুক নিয়ে যাও৷ আর কালার পেন্সিল। ওকে শুদ্ধা বইয়ে বসাবা, এক সেট পেন্সিল ওই বইয়ে ভাঙ্গুক। আবার অন্য একদিন প্লাস্টিকের বোতলে চটপটির ডাবলি আর ছোলা দিয়ে মুখ আটকে দিবা, নাড়বে আর শব্দ হবে। এইই খেলনা। হাতে বিকল্প এবং ইন্টারেস্টিং কিছু না দিয়ে যদি চাও কেনা খেলনাগুলাতেই অনেকদিন ওর আগ্রহ থাকবে, তাহলে তুমি ওকে বুড়ামানুষ ভেবে বসে আছ। আমিই ত পারবো না এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে।’
মজার কথা হল, এরপর যতক্ষণ কথা বললাম, বাচ্চাটা ওই প্লাস্টিকের গ্লাসের খেলনা দিয়েই খেললো। মা’টাকে তো না ই, আমার টেবিলের হাজারটা টুকিটাকি জিনিসকেও আর জ্বালায়নি। মা বেচারি এবার বাচ্চাটাকে আদর করে দিয়েছে। বললো, এভাবে ভাবি নাই ম্যাম। থ্যাংক ইউ’।
‘ওর হক আছে। ওর শেখারও আছে ঠিক এই বয়সেই। শুধু আটকে রেখে দিও না। তাতে তোমার কষ্ট, পড়াশোনার সময় পাবা না। ওরও ভবিষ্যৎ আছে। ওকে ওর জন্য দরকারী মজার মজার কাজ দাও, তুমিও টুকটাক সময় পাবা পড়ার বা কাজের। আমিও পেয়েছি।’
মাতৃত্ব একটা যাত্রা। এর নানা ঝামেলা আছে। শারিরীক, সামাজিক। কিন্তু যেটুকু করণীয়, সেটুকু করা যেমন জরুরি। যেটুকু উপভোগের সেটুকু বুঝে নেওয়াও দরকার। একজন ভেটেরান মা হিসেবে আরেকজন নতুন মা’কে এইটুকু জানানোই যায়।
এটাকে ইআরপির ভাষায় বলে কাউন্সেলিং। অবশ্য, এত কথা হয়ত না বললেও চলতো। পদের নাম লেকচারার, আমার্কিদোষ?
You must be logged in to post a comment.