“আমি আর চাই না “
বাক্যটা বলে, হাস্পাতালের বিশাল রুমে এক এক জন প্রসূতি মা চিৎকার করে কান্না করে যাচ্ছেন, সময় আনুমানিক রাত ৩/৪ টা বাজে।  যেন কলিজা ছিড়ে যাবে কান্নায়! কি ভয়ঙ্কর কান্না! মনে হচ্ছে গলা কেটে ফেলি তাও বাচ্চা জন্ম দেবার কষ্ট নিতে পারছিনা! তো আমাকে যথারিতি একটা বেড এ দিয়ে গেল, ততক্ষনে আমার পেইন চলে গিয়েছে, যার জন্য ওনাদের চিৎকার এ ভয় কিছুটা কম পেলেও মনে হচ্ছিলো জীবনের সব চেয়ে ভূল করে ফেলেছি! হাসি মুখ,অন্তরে ভয়  এদিক সেদিক দেখি আমি!!
যদিও ওনারাও প্রসব যন্ত্রণাতে এমন ই ভেবেছিল বুঝাচ্ছিল !! পাশে তাকিয়ে দেখছি আমার আম্মু ওনাদের কান্নাতে কান্না করছেন দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে! আমি বললাম তুমি ওনাদের কান্নাতেই কান্না করছো?!  পরে লজ্জামিশ্রিত হাসি দিলো আম্মু!

চলে আসি শুরু থেকে ইন শা আল্লাহ
২০২০
প্রেগ্ন্যাসির ৩৫ সপ্তাহ কেবল হাসপাতাল যথাক্রমে খোজা হচ্ছে এখনো, আসলে হাসবেন্ড এখনো ঠিক করতে পারেনি যে কোনটাতে যাবো লাস্ট টাইমে।

তো সেবার ওনার অফিসের কাজে যেতে হবে চট্রগ্রাম তাই আমাকে বাবার বাসায় দিয়ে যেতে চাচ্ছেন কিন্তু কেন জানি মন মানছিলনা, তাও জোর করে  দিয়ে আসলেন। আমি চেয়েছিলাম আরো পরে যাবো। করোনার সিজন চলছিলো তখন ও, এদিকে বাবার বাসায় সবার জ্বর হচ্ছে এক এক করে। বাবার বাসায় আসার এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই আমার পেট খারাপ হোল, সাথে জ্বর।

আমার ভাইয়া গাইনি ডাক্তার কে ফোন দিয়ে দিয়ে ঔষধ এনে দিচ্ছিলেন। জ্বর কমে গেলেও পেট খারাপ আর ভালো হচ্ছিলো না।

তো এত কিছুর মধ্যে আমি বাচ্চার নড়াচড়া কাউন্ট করার ব্যাপার  ভুলেই গিয়েছিলাম।  দুই তিন দিন এরকম চলার পরে হঠাত সেদিন বিকেলে  দেখলাম কোমর ব্যাথা করছে ভাবছি পেট খারাপের জন্য মনে হয় এমন হচ্ছে, পর্যায়ক্রমে ব্যাথা বেড়েই যাচ্ছিলো। ওয়াশরুমে গিয়ে চেক করে দেখি আঠালো লালচে স্রাব যাচ্ছে, আমি মাতৃত্ব সাইটে পড়েছিলাম যে এরকম টা লেবার পেইন হলে হয়।

এদিকে হাসপাতাল ঠিক করাও নেই কোন। কোথায় যাই! আমার রেগুলার  ডাক্তার কে ফোন দিলে তিনি বললেন যে যদি আমি মনে করি এটা লেবার পেইন তাহলে যেন চলে আসি! আমার খুব রাগ হোল ওনার উপর!  উনি ডাক্তার উনি বলবেন যে হ্যা এটা এই অবস্থা তোমার এখন চলে আসো তুমি, তা না!

গন্ডোগোল লেগে গেল কোথায় যাবো সেটা নিয়ে। কিছুদিন আগে হাসবেন্ড এর এক বন্ধুর ওয়াইফ এর বাচ্চা হয়েছে  আদ্ব -দ্বীন মগবাজার হাসপাতালে, নরমাল ডেলিভারি তে৷

তো সবাই ঠিক করলাম যে ওখানেই যাবো। বের হতে হতে বাজলো রাত ১০ টা, এদিকে সেই বিকালেই ব্যাথার সাথে পানি ভেংগে গেল দেখলাম, তো কাগজ পত্র আবার ভুলে রেখে আসছিলাম শ্বশুর বাড়ি, তারপর ওই  রাতে  শ্বশুরি মা পাঠাও এ করে চলে আসেন কাগজপত্র নিয়ে। বলে  রাখি আমার শ্বশুর বাসা উত্তরা, উত্তর খান।আর আমি ছিলাম তখন ক্যান্টনমেন্ট, মাটিকাটা এরিয়াতে।

তো ব্যাথা নিয়ে ডাক্তার এর সাথে কথা বলতে বললাম পেট খারাপ আছে আমার আর জ্বর ছিলো কিন্তু এখন আর নেই। তারপরেও আমাকে করোনা টেস্ট দিলো, তো জ্বর মাপিয়ে জানালো যে ১০১ জ্বর গায়ে। অথচ আমার শরির ঠান্ডা!
 
কি জানি কি হচ্ছে ব্যাথা কমছে না সেই সাথে জরায়ুর মুখ ওপেন হয়না অনলি টু সেন্টিমিটার!  আমাকে কি কি ইনজেকশন এর নাম বললো যে দেয়া হয়েছে কিনা বললাম  যে না হয়নি তারপর কোমরে দুইটা ইনজেকশন দিয়ে দিলো বললো যে পেট খারাপের রুগি এইসিইউ তে রাখতে হবে,আর করোনা টেস্ট ও করতে হবে।পেট খারাপের জন্য এডাল্ট ডায়পার, ক্যাথেটার পরানো হোল।

সারারাত ব্যাথা  হোল,সে রাতে কোন ঘুম হোল না আর। এর মাঝে ই ৩/৪ বার বাচ্চার হার্টবিট চেক করেছে, পেটের উপরে শক্ত বেল্ট দিয়ে বাচ্চাকে বেধে, হাত দিয়ে জরায়ুর মুখ খুলছে কিনা চেক করেছে……

যেহেতু রাত ১০ টায় গিয়েছিলাম, তাই ভর্তি করা থেকে শুরু করে  কয়েকবার হাত দিয়ে চেক করা, পেটে বেল্ট বেধে বাচ্চার হার্টবিট চেক(কয়েকবার) ,ইনজেকশন দেয়া(দুইটা দিয়েছে সম্ভব কোমরে) এসব করে  রাত কয়টা বেজে গিয়েছিল জানা নেই তবে আই সি ইউ তে নিয়ে গিয়ে  এডাল্ট ডায়পার পরালো আর কিছুক্ষন পরে পরে হাত দিয়ে চেক করে যাচ্ছিলো ।  তখনো  ব্যাথা  চলছিলো, পাশের বেড এ এক আপু ছিলো পাঁচ মাস প্রেগ্ন্যান্সি নিয়ে,আমি কথা বলছিলাম ওনার সাথে আর ব্যাথা উঠলেই কষ্টমিশ্রিত কান্না করছিলাম!  ওনার কাছে সরি বলছিলাম বার বার যে আমার কান্নায় তার কষ্ট হচ্ছে কিনা!

সে রাতে আর ঘুমাতে পারলাম না ডায়পার এর জন্য, প্রস্রাবে পেট ফুলে গিয়েছে কিন্তু বিছানায় শুয়ে আর হচ্ছিলো না, ভীতর থেকেই আসছিলো না, পরে ফজর এর আজান এর সময় প্রস্রাব হয়।

সকাল হলে আমার ছোট খালা আসেন পানি নিয়ে মুখ ধোয়েবেন, মুখ ধুইয়ে, খিচুড়ি খাইয়ে চলে গেলেন উনি।কতক্ষন পরে মনে নেই তবে হাসবেন্ড সারা রাত বাইক চালিয়ে আসছিলেন চিটাগং থেকে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে। একটু দেখা করতে এসে কান্না আসছিলো নাকি তার, আমার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে।

সেখান থেকে করোনা চেস্ট শেষে নিয়ে গেল আরেক বেড এ বিশাল রুমে অনেক গুলা আলাদা আলাদা বেড, একেক জন চিতকার করছে প্রসব ব্যাথায়, আমি আর চাইনা বলে একজন চিতকার করে যাচ্ছিলো, বিশাল অন্যায় করে যেন এখানে সবাই হাজির হয়েছি, বাচ্চা পেটে ধারণ করেছি এখন বের তো করতেই হবে, কিন্তু এত যন্ত্রণা সয়ে বের করতে চাইনা, যন্ত্রনা থেকেও মুক্তি চাই!!

ততক্ষণে আমার ব্যাথা শেষ নাহলে আমি হার্ট ফেইল ই করতাম হয়তো চিতকার শুনে… মুখে হাসি আর অন্তরে ভয় নিয়ে এদিক সেদিক চাকাচ্ছি শুধু! আমার আম্মু অন্যান্য মায়েদের কান্নায় কান্না করছেন শুধু, আহাজারি শুনে!

দুপুরের দিকে ডাক্তার আসলো জিজ্ঞেস করলো কি অবস্থা, বললাম ব্যাথা তো নাই, বললো তাহলে এখানে কি করেন বাসায় যান।
এক রাতেই খবর শুনে সেই বরিশাল থেকে ঢাকায় আসা আব্বু আর কাকিসহ, ঢাকার যারা ছিলাম সবাই মিলে চললাম বাসার দিকে। খালি হাতে বাসায় এলাম তবে পেট খারাপ টা তো কমাতে পারছি তাতে শান্তি লাগছিলো !!

…বিকেল গড়িয়ে রাত হোল আনুমানিক রাত ৩ টা হঠাত কোমরে ব্যাথা, কাকি ঘুমাচ্ছিলো আমার রুমের ই ফ্লোরে, ডাকতেই কোমরে ম্যাসাজ করে দিচ্ছিলো ঘুম রেখে। রাত থেকে সকাল হয় সবাই উঠে এক এক করে আর আমি ব্যথা নিয়ে দাড়িয়ে চিতকার করি,কান্না করি ! কারণ শুতে বা বসতে পারতাম না তাহলে ব্যাথা বাড়তো। যেই ব্যাথা বাড়তো কেউ না কেউ এসে কোমর ডলে দিতো সকাল থেকে দুপুর হোল সবার খাওয়া দাওয়া সামলালেন আম্মু, গোসল করে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে যোহর পরলাম! আছর ও পরেছি দাড়িয়ে । সবাই চাচ্ছিলো যাতে ব্যাথা আরো বাড়লে যাবো কারণ নরমালে যেন হয়। এছাড়াও একবার গিয়ে ফিরে আসছি। এটাও যদি ফলস পেইন হয় আবার সেজন্যে !

বিকেল থেকে সন্ধ্যা সবাই রেডি হাস্পাতালের উদ্দেশ্যে, ঠিক যাওয়ার সময় লাগলো ক্ষুধা, ভাবলাম যাই, ওখানে গিয়ে খাবো। ব্যাথার সময় যে খেজুর খেতে হয় তা একদম ই ভুলে গিয়েছিলাম আমি!

হাসপাতালে যাওয়ার পর চেক করলো  বাচ্চার  হার্টবিট চেক করলো কিন্তু আমি যে শুতে পারিনা, আহা ওই শোয়া সময় টুকু দুনিয়ার সব চেয়ে কষ্টকর মুহূর্ত ছিলো যেন। তারমধ্যে আবার খেয়াল করা যে বাচ্চা কতবার নড়ছে, মাথা হাত দিয়ে উঠিয়ে চেয়ে থাকতাম পেটের দিকে,আর ভিতর থেকেও অনুভব করার চেষ্টা করতাম।

নার্স জিজ্ঞেস করলো আল্ট্রাসাউন্ড করা হয়েছে কিনা, বললাম সেই ৫ মাসের সময় এনোমেলি করেছি আর করা হয়নি, পাঠালো আল্ট্রা করাতে সেই বসিয়ে নিয়ে গেল হুইল চেয়ারে তারপর প্রায় ২০ মিনিট বসিয়ে রাখলো, আহা যেই আমি  হাসপাতালে আসার আগে অর্ধেক দিন শুধু দাড়িয়েই ছিলাম  বসতেও পারিনা দেখে, সেই আমাকে বসিয়ে রাখলো আর বসে বসে বাইরে দূরে বাবা, হাসবেন্ড সবাইকে দেখছিলাম আর কান্না করে যাচ্ছিলাম, পরে আমার সময় আসলে শোয়ার সময় আবার ব্যাথা শুরু হোল ওনাদের বললাম একটু পরে শুচ্ছি প্লিজ! ওখানের দায়িত্বের মহিলারা সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন আহারে মা!! আরেকটু কষ্ট করো!

আবার সেই আগের জায়গায় আনা হোল, রিপোর্ট আসলো বললো বাচ্চার মাথা নিচে চলে আসছে আল্ট্রা তে মাথা আসেনি, বাচ্চার হার্টবিট কম,পানি কম সিজার করাতে হবে!ব্যাথার কান্না আর কি সিজারের কথা শুনেই বুক ভেংগে কান্না আসতে লাগলো, আহা এত কষ্টের পরেও সেই সিজার করতে হবে! শুধু মাত্র এক্সারসাইজ হবে বলে হাই কমোড ও ইউস করিনি, ছাদে ঢুলুমুলু শরির নিয়ে বিকেলে হেটেছি, বাসার মধ্যে হেটেছি! পানি খেয়েছি!,! কষ্ট সব বৃথা হয়ে গেল এভাবে!! 

সব কারিকুলাম হতে প্রায় ২ ঘন্টা লেগেছিলো, আম্মু খাবার নিয়ে গিয়েছিল,আম্মুকে বললাম আমার অনেক ক্ষুধা লাগছে, আম্মু ভাত মাখতে লাগলো নার্স বললো এই এই কি করেন আপনার রাত ১০ টায় অপারেশন, কিছু খাওয়া যাবে না। কিন্তু আমি না খেলে যেন নির্ঘাত মারা যাবো এত্ত ক্ষুধা ছিলো পেটে! আর মনে মনে চিন্তা করলাম রাত ১০ টা অনেক দেরি কতক্ষনে আমি চেষ্টা করবো যাতে নরমাল ডেলিভারি হয়! 

এর আগে বা পরে কোন সময় জানিনা নার্স বেশি বেশি করে হাটতে বললো,  তাহলে নাকি নরমাল ডেলিভারি হবে,ওদিকে খবর পাঠানো হলো আব্বু,হাসবেন্ড, ভাইয়া, যারা হাসপাতালে ছিলো তাদের কাছে যে বাচ্চার হার্টবিট কম প্লাস পানি ও কম, আর আল্ট্রাতে বাচ্চার মাথা উঠেনি তাই সি-সেক এই যেতে হবে!  কেউ কেউ রাজি কেউ একেবারে ই রাজিনা, আল্লাহর ই ইচ্ছা ছিলো হয়তো ফোনে দুলাভাই কে জানালে উনি বললো মারা গেলেও আমরা সিজার করাবো না, কঠোর সিদ্ধান্ত জানালেন উনি,আম্মু ও চুপ মত দিচ্ছিলেন না, হয়তো ওনার বলাটা ভুল ছিলো((আল্লাহ ই হয়তো ওনার জবানে কঠোরতা দিয়েছিলেন তখন!))

কিন্তু আমার মেজর কোন প্রবলেম দেখা দেয়নি যেখানে, আবার প্রচুর পেইন সেখানে ওনারা সিজারের জন্য অপেক্ষা করতে বলছে রাত ১০ টায় মানে জান বের হয়ে যাচ্ছে আর অপারেশন হবে ৩ কি সারে ৩ ঘন্টা পরে! ইন্না-লিল্লাহ!!

.. যে কথা সেই কাজ কান্না করছি তবে চিতকার করছিনা, ব্যাথায় শুধু হেটেই  চলছি এ মাথা থেকে আরেক মাথা!  সাথে এক মাঝে মাঝে দুই বডি গার্ড ছিলো, পারমানেন্ট ভাবে আম্মু+ কাকি♥

ওনাদের একজিনকে না হলে আরেকজনকে ধরে হাটতাম আর ব্যাথা আসলেই কোমরে মাসাজ করে দিত!  প্রচুর বকছি দুই ও জনকে  হাটতে পারে না ক্যান,গায়ে শক্তি নাই ক্যান?
আরো জোরে মাসাজ করে না কেন, ব্যাথা কমে যেত তাহলে!!  সেজন্য!! বেচারি একজন সেই রাত তিনটা অনুমানিক আমার সাথে সাথেই ছিলো কোমরে মাসাজ করে যাচ্ছিলো আর আরেকজন ছিলো অসুস্থ!  দুইজন ই প্রচুর ক্লান্ত ও ছিলো তো কত আর হাটতে পারে মানুষ!  আমি তো ব্যাথায় পাগলের মত হাটছি,যদিও তখন কোন এক জনের কথা বার বার মনে আসছিল,যিনি থাকলে ওনাদের উপর বিরক্ত হতাম না এত আর নিজেও হয়তো শান্তি পেতাম!  যাগ গে ওসব বাদ দেই,চোখের সামনে যেন সব ভেশে আসছে এই দের বছর পরেও!!

.. ওহ বলা হয়নি আম্মু লুকিয়ে ভাত খাইয়ে দিলো কি যে শান্তি পেয়েছিলাম ভাত খেয়ে যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না! এরপর ই তো হাটাহাটি…. ?
তো আমার বেড থেকে পিছনে একটা খালি বেড ওটা পর্যন্ত যাচ্ছিলাম, তো একবার যখন গিয়ে দাড়ালাম কেন জানি আম্মু কাকি একজন ও ছিলো না সাথে এত চাপ আসছে যে পানি বের হয়ে গেল গল গল করে!  এই চাপ প্রায় ১ ঘন্টা ধরেই এসে যাচ্ছিলো, আমি তো জানিনা, এদিকে ডাক্তার রা কি কথা বলেছিলেন লাস্ট এ, যখন সিজারে রাজি না আমার বাসার লোকজন।   তখন ডাক্তার বললো আরেকবার চেক করবেন বাচ্চার হার্টবিট! বালিশে শুয়ে মাথা আবার হাত দিয়ে উচু করে দেখতাম বাচ্চা কয়বার নড়ে আর নিজেও ফিল নিতাম, যাতে মিস না হয় কাউন্ট তাই এরকম দেখতাম! কিন্তু শোয়া কি যায় এভাবে! শুয়ে থাকা যেন মরন যন্ত্রণা মনে হতো আমার! যেই আমি রাত ৩ টা থেকে দাড়ানো!! বসতেও পারিনা সেই আমি শুয়ে আছি!  তো যা বলছিলাম এরপর ওনারা বলছিলো নাকি যে ১০ টা পযর্ন্ত দেখবে এর মধ্যে বাচ্চা হলে তো হলো নাহয় সিজার!

তো ওরকম পানি গল গল করে বের হয়ে যাওয়ায় লজ্জা পেয়ে গেলাম কারণ অনেক বেড তো  প্রেগু নন প্রেগু মহিলারা ছিলো!  ভাবলাম প্রস্রাব করে দিলাম নাকি! হায় হায়

তাড়াতাড়ি একা একা হেটে আসলাম বেড এ এদিকে দুই রাত ঘুমাই না দিনেও না,, ঘুমে চোখ খোলাও রাখতে পারছিলাম, ঘুমিয়ে যাই ব্যাথা বাড়ে কেদে উঠি!! আম্মুকে বললাম তোমরা নাকি আমার সিজার করো তাইলে করো না ক্যান! আমি তো মইরা গেলাম!আমারে এত কষ্ট দেও ক্যান!!  একদম শেষ মুহূর্তে এটা!!  নার্সদের অনুরোধ করছিলাম আমি ডেকে ডেকে একটু আসেন না প্লিজ! আর তো পারিনা ব্যাথা তো আরো বাড়ছে নাস বললো বার বার চেক করা আবে না সমস্যা হবে! আম্মু নিশ্চুপ!  উদাস নয়নে এদিক সেদিকে তাকায়!  তো চাপ আছিলো বলছিলাম ওটা প্রায় ঘন্টা খানেক ধরেই আসছিলো আমি ভাবছিলাম পেট খারাপ সেজন্য হয়তো আর চাপ আসলে আরো আটকে দিচ্ছিলাম আমি হায় হায় বাথরুম হয়ে যায় কিনা…. তো লাস্ট বেড থেকে নিজের বেডে বসলাম আর আবার ও প্রচুর বাথরুম এর চাপে পানি বের হয়ে গেল, স্টিল আমি প্রস্রাবই ভেবে যাচ্ছিলাম! কেন জানি হাতে একটু লাগিয়ে নাকে ধরলাম নাহ কোন গন্ধ তো নেই,বুঝলাম আরেহ পানি ভাংছে তো এটা….

.. এতক্ষন কাউকে কিছু বলিনি শুধু ব্যাথাই বাড়ছে এটাই ওনারা দেখছে!  আসলে ব্যাথার মধ্যেও যে আরেক ব্যাথা আরো কিছু যোগ হবে তা তো জানাই ছিল না আমার অথচ আমি অনেক প্রেগন্যান্সির লেখা গুলো পড়েছিলাম!আর ওটাও পড়ে থাকলে হয়তো মাথায় আসেনি তখন! তাই দুইজন অভিজ্ঞ মানুষ থাকা স্বত্বেও না বলায় ওনারাও কিছু করতে পারেনি! তো পানি পাটিতে পরলে আর এরকম চাপ আসতেই থাকলে কি করবো বুঝতে পারছিলাম না ভাবছি সবাই এত স্বার্থপর কেন হয়ে গেল! মরে যাচ্ছি আমি কেউ কিছু করছেনা কেন! তারপর আম্মু অথবা কাকি বললো তুই শুয়ে পর তো…

.. তখন ওনার যে দুনিয়াতে  আসার পালা আর কত অপেক্ষা করবেন উনি,অবুজ মা তো বুঝেই না নিজেও কষ্ট পেল আর তাকেও কষ্ট দিলো!!
তো শোয়ার সাথে সাথে ভিতর থেকে চাপে মনে হোল  চামড়া ছিড়ে  গিয়ে জ্বলছে কাকিকে বললাম দেখেন তো এমন কেন  হোল,কাকি বলে আরেহ বাচ্চার মাথা চলে আসছে সাথে সাথে নার্স চলে আসলো, ওনাদের সব রেডি করাই ছিলো, আর আমি একাই তখন অই অবস্থায় ছিলাম তাই সবার আকর্ষনের কেন্দ্রেবিন্ধু ছিলাম  আমি! সাথে সাথে ই নার্স এসে এপিসিওটমি করে দিলো আর বাবুকে বের করে রাখলো পেটের উপর আবার নিচে পরে গেল আবার রাখলো!!  আর অবশেষে আমার ১০ মাসের জার্নি শেষ হোল আর সাথে সাথে ব্যাথা গায়েব!!
প্লাসেন্টা ও সাথে সাথে বের করলো

….. কাপড় চেইঞ্জ করে  ভিতরে অনেক গজ ঢুকিয়ে প্যাড পরিয়ে দিলো ও নার্স!  হুইল চেয়ারে বসালো আরেক জায়গায় নিয়ে গিয়ে সেলাই দিতে! প্রচুর  পরিমান এ জ্বলতেছিলো তখন!

… বাইরে খবর গেল তুলির ছেলে হইছে সবাই শুনে আবেগে, খুশিতে আত্নহারা! ছেলের নানা কানে আজান দিলো!  বাচ্চা নিয়ে হুইল চেয়ারে গেলাম আরেক জায়গায়…. এখন শুরু হতে যাচ্ছে আরেক যন্ত্রনাদায়ক অধ্যায়!!

.. শেষ মুহুর্তে আল্ট্রাসাউন্ড করার সময় যেমন বসিয়ে রেখেছিলো ওভাবে তাজা কাটাসহ বসিয়ে রাখলো অনেক্ষন!  একে জিজ্ঞেস কিরি ওকে জিজ্ঞেস করি কেউ কেউ কিছু বলেই না কখন সেলাই হবে কেউ বলে যে আরো লোক আছে তাই দেরি হচ্ছে! আমি তো জ্বলে পুরে মরছি বসে বসে! তো অবশে এ আমার পালা আসলো নিয়ে গিয়ে বেড এ শোয়ালো কিন্তু সেই অপছন্দনীয় দেখতে অবস্থায় শোয়ায়ে আবারো খবর নাই!  কেউ আসেনা যে!!

আহ এই প্যারাটুকু না লিখলে কতই না ভালো হোত! কিন্তু লিখতে তো হবেই! নার্স আসলো অবশেষে, মাস্ক পরতে বললো, পরলাম,  শুরু হোল সেলাই প্রত্যেকটা সেলাইয়ের আংটা যে চামড়ায় ঢুকাচ্ছে আবার সুতা টান দিচ্ছে তারপর গিট দিচ্ছে তা টের পাচ্ছিলাম আর গলা কাটা মুরগির মত মনে হচ্ছিলো নিজেকে!  নড়াচড়া করলেই বকা দিচ্ছিলেন উনি আরেহ এত নড়লে সেলাই করবো কিভাবে আসলেই তো কিভাবে করবে সেলাই কিন্তু আমি কি করবো+ তাজা শরিরে সুই দিয়ে সেলাই করলে কি কেউ চুপ থাকতে পারে!উনি  বলে  আরেহ মাস্ক খুলেন ক্যান মুখে রাখেন! মনে মনে বলছিলাম আপনার হাত আমার শরিরে আর তিন হাত দূরে মুখে মাস্ক দিয়ে কি এমন প্রটেক্ট হবে শুনি!! প্রায় ৫/৭ টা সেলাই দিলো মনে হোল! যখন ই সেলাই দিচ্ছিলো কোমর অটোমেটিক উপরে উঠে যাচ্ছিলো! উনি খুব বিরক্ত হচ্ছিলেন! বলছিলেন আরেহ এরকম করলে সেলাই দিবো কিভাবে আপনাকে!আমি কান্না ভাংগা কন্ঠে জবাব দিলাম ; সরি আসলে ব্যাথায় আমি অমন করে ফেলেছি!  উনি বললো আপনাকে না অবশ করলাম! কি বলেন উনি কিসের অবস্থ করলো যে প্রত্যেকটা সুইয়ের ফোর অনুভব করে যাচ্ছি!  পরে হয়তো একটা ইনিজেকশন দিয়েছে কিনা জানিনা নাকি সেলাই দিতে দিতে ব্যাথাটা শয়ে গিয়ে কম মনে হয়েছিল কিছুটা আল্লাহু আলাম!!

.. সেলাই শেষ!! আয়া খালা এসে কাপড় চেইঞ্জ করে দিলো, আর দেখালো যে দেখেন কত রক্ত, পেট কে গোল গোল চাপ দিয়েছিলো জোরে জোরে ব্লাড সম্পূর্ণ বের করার জন্য প্রায় দুই কেজির মত দেখালো উনি!  যাক অবশেষে আধমরা অবস্থায় হুইল চেয়ারে বসে আসলাম বেড এ। ও সেলাইয়ের আগেই মেবি বাবুর তাহনিক করেছিলেন আম্মু!  একটু খেজুর হাত দিতে ডলে মুখে দিতেই উনি চক চক করে খেয়ে নিচ্ছিলেন! আল্লাহর শোকর জন্মের পর ওর সাত দিনে আকিকা বাদে আর কোন সুন্নাহ বাদ যায়নি!  তো বেড এ আসার পর থেকে একটা সমিস্যা ফিল করছিলাম আর তা হোল বুকের ব্যাথা, পেট ও ব্যাথা করতো তবে বুকে এত ব্যাথা করতো যার কারণে কথা বলতে কষ্ট হোত!ডাক্তার বলেছে গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা নাকি! অবশেষ এ ১৯ অক্টোবর ২০২০ এ বাবু নিয়ে আব্বুর বাসায় চলে আসি! আলহামদুলিল্লাহ!  সুম্মা আলহামদুলিল্লাহ!! এরপর আবার নতুন করে মা হয়ে ওঠা শুরু হয়েছিল! প্রতিটি দিন প্রতিটি মুহূর্ত!  আম্মু, কাকি অনেক কষ্ট করেছিলেন আল্লাহর কাছে সব প্রতিদান জমা রাখলাম!

.. কিছু কথা- সেলাইয়ের প্রায় এক মাস ঠিকমতো বসতে পারতাম না! কষ্ট হোত তারপর আল্লাহ পাক আস্তে আস্তে সারিয়ে দিয়েছেন!