কারোর আত্মীয়দের মাঝে বাচ্চা জন্ম নিলে, সেই বাচ্চার খোঁজ খবর নিতে গিয়ে একটা খুব সাধারন জিজ্ঞাসা থাকে যে- বাচ্চার জন্ডিস আছে নাকি? বাচ্চার চোখে মুখে নজর বুলিয়ে চেক করা হয় বাচ্চার জন্ডিস আছে কি নেই। এই লেখায় থাকছে নিওনেটাল জন্ডিস নিয়ে বিস্তারিত।
- জন্ডিস কাকে বলে?
- জন্ডিসের প্রকারভেদ
- নবজাতকের জন্ডিস কেনো হয়?
- কখন বাচ্চার জন্ডিসের পরীক্ষা করতে হয়?
- কী কী উপায়ে জন্ডিস পরীক্ষা করা যায়?
- জন্ডিসের রিস্ক ফ্যাক্টর
- বাচ্চার জন্ডিসের চিকিৎসা কেনো জরুরী?
- কিভাবে জন্ডিসের চিকিৎসা করতে হয়?
- ফটোথেরাপি দিলে কোন কোন বিষয় খেয়াল রাখতে হবে?
- বাচ্চাকে রোদে ধরলেই জন্ডিস চলে যাবে?
- জন্ডিসে কী কী লক্ষণ বিপদজনক এবং ইমার্জেন্সি-
- জন্ডিসে যা কখনোই করণীয় নয়-
- তথ্যসূত্র
জন্ডিস কাকে বলে?
চোখ- মুখ হলুদ, বুক হলুদ অথবা চোখ থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে শরীরের নিচের দিকে হলুদ ভাব হওয়া, হলুদ দেখা এটাকেই সহজ বাংলায় জন্ডিস বলে।আর যখন এটা নবজাতক বাচ্চাদের বা নিওনেটদের হয় তখন সেটাকে নিওনেটাল জন্ডিস ( Neonatal Jaundice) বলে।
জন্ডিসের প্রকারভেদ
চিকিৎসাবিদ্যায় ২ প্রকারের নিওনেটাল জন্ডিস আছে। নীচে সেগুলোর বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।
১. ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস
প্রায় ৮০% বাচ্চাদের জন্মের পরে এই জন্ডিস হয়ে থাকে। যেসব বাচ্চা ৩৭ সপ্তাহ মায়ের গর্ভে কাটিয়ে জন্ম নিয়েছে, তাদের মাঝে ৫০-৬০% বাচ্চার এই জন্ডিস হতে পারে। এটাতে কোনো চিকিৎসা লাগেনা। এটি জন্মের ২-৩ দিন পরে শুরু হয়ে ১৪ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে।
এই জন্ডিস যেহেতু নিজ থেকেই ভালো হয়ে যায় তাই এটির জন্য কোন চিকিৎসা দরকার নেই। অনেকেই আছেন বাচ্চার শরীর/ চোখ হলুদ দেখলে বেশি বেশি রোদ লাগান বা ঘরোয়া চিকিৎসা করান যা বাচ্চার জন্য বিপদজনক হতে পারে।
২.প্যাথোলজিক্যাল জন্ডিস
এই জন্ডিস রোগের জন্যই হয়। শিশু জন্মের ২৪ ঘন্টার মধ্য এটি শুরু হয় এবং ১৪ দিন পরেও থাকে। যেহেতু এটি রোগ তাই এটির চিকিৎসা খুবই জরুরী, নাহলে বাচ্চার সমস্যা হতে পারে ( সমস্যাগুলোর বিস্তারিত নীচে আলোচনা থাকছে )।
নবজাতকের জন্ডিস কেনো হয়?
বাচ্চা যখন মায়ের পেটে থাকে তখন মায়ের লিভার(যকৃত)থেকে বিলিরুবিন ( Bilirubin) নামক একটি পদার্থ বাচ্চার রক্তের মাধ্যমে সহজে বাইরে বের হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাচ্চা যখন ভূমিষ্ট হয় তখন তার লিভারের কাজ হবে বিলিরুবিন বের করে দেয়া, যেটা এতোদিন তার মায়ের মাধ্যমে হতো। কিন্তু তার লিভার পরিপক্ক না হওয়াতে সেটা বাইরে বের করতে পারেনা। তখন বিলিরুবিন জমে শরীরের নানান অঙ্গে হলদেটে ভাব প্রকাশ হয়।
কখন বাচ্চার জন্ডিসের পরীক্ষা করতে হয়?
যদি প্রথম দিনেই বাচ্চাকে দেখে ডাক্তারের মনে হয় জন্ডিস হতে পারে,তখন প্রথম দিনেই বাচ্চার পরীক্ষা করতে হয়। এরপর চিকিৎসা শুরু করা হয় প্রয়োজন অনুযায়ী।
আর যদি প্রথম দিন ভালো থাকে তাহলে সাধারণত দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে অথবা মা-কে হাস্পাতাল থেকে ছুটি দেয়ার আগে একবার পরীক্ষা করা হয়। তবে আমাদের দেশে কোনো লক্ষণ না থাকলে অনেক হাসপাতালই পরীক্ষা করেনা।
কী কী উপায়ে জন্ডিস পরীক্ষা করা যায়?
নবজাতকের জন্ডিস পরীক্ষা করার কয়েকটি পদ্ধতি আছে, যথা-
১. Clinical Test বা চোখে দেখে- ডাক্তার যদি মনে করেন যে বাচ্চাকে দেখে হলুদ লাগছে, তখন চোখ, মুখ, বুকের উপর হালকা চাপ দিয়ে, হাত, পায়ের তলা দেখে পরীক্ষা করতে পারেন। এই পদ্ধতিতে ডাক্তারের অব্জারভেশনের উপর নির্ভর করা হয়।
২. Transcutaneous bilirubin Meter- বাচ্চার কপালে এবং কানের কাছে এই মেশিনটা ধরলে সেটা bilirubin এর মাত্রা বলে দেয় যা দেখে বোঝা যায় বাচ্চার জন্ডিস আছে কিনা। কিন্তু আমাদের দেশে এই পদ্ধতির প্রচলন খুবই কম/ নেই বললেই চলে।
৩.Blood test বা রক্ত পরীক্ষা – বাচ্চার শরীর থেকে অল্প কিছু রক্ত নিয়ে ল্যাব এ পরীক্ষা করা হয় ও রেজাল্ট দেখে জানা যায় বাচ্চার জন্ডিস হয়েছে কিনা।
৪। Serum bilirubin – (direct & indirect)- জন্ডিস পরীক্ষায় এটিই প্রধান পদ্ধতি। এর সাথে প্রয়োজন মনে করলে ডাক্তার অন্য পরীক্ষাও দিতে পারেন।
জন্ডিসের রিস্ক ফ্যাক্টর
কোন নবজাতকের যদি জন্ডিস ধরা পড়ে, তবে কিছু কিছু বিষয়ে বেশি সচেতন থাকতে হবে। যেমন-
১। যদি বাচ্চা পর্যাপ্ত পরিমাণে মায়ের বুকের দুধ না পায়। অনেক মায়ের ডেলিভারির পরে দুধ কম আসে।
২। আগের বাচ্চার যদি জন্ডিসের জন্য ফটোথেরাপি দেওয়ার হিস্ট্রি থাকে।
৩. মায়ের যদি ইন্সট্রুমেন্টাল ডেলিভারি হয়।( ফরসেপ্স/ভ্যাকুউম ডেলিভারি) তাহলে বাচ্চার আঘাত পেয়ে শরীরে ছোপ ছোপ রক্ত জমে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে।
৪.মায়ের রক্তের গ্রুপ যদি O+ হয় এবং বাচ্চার রক্তের গ্রুপ যদি A+/B+ হয় অথবা,মায়ের রক্ত যদি (Rh -) হয় মানে নেগেটিভ যেকোনো গ্রুপের এবং বাচ্চা যদি (Rh+) বা পজিটিভ যেকোনো গ্রুপের হয়।
৫.এনজাইমের ঘাটতি (G6PD)- এটি খুবই রেয়ার বা হয়না বললেই চলে। তবে যদি কোন বাচ্চার হয় তবে উপযুক্ত ব্যাবস্থা নিতে হবে।
জন্ডিসে আক্রান্ত বাচ্চার মাঝে এই বিষয়গুলো থাকলে সেগুলোকে রিস্ক ফ্যাক্টর ধরা হয়, এক্ষেত্রে বাচ্চার জন্য লক্ষণ অনুযায়ী বাড়তি যত্ন দরকার।
বাচ্চার জন্ডিসের চিকিৎসা কেনো জরুরী?
Bilirubin একটা নির্দিষ্ট লেভেলের উপরে চলে গেলে তখন সেটা বাচ্চার ব্রেইনে চলে যেয়ে বাচ্চার ব্রেনের বিভিন্ন রোগ তৈরি করতে পারে এবং সেগুলো বাচ্চার জন্য খুব ক্ষতিকর। তাই জন্ডিসের ধরণ নির্ণয় করে উপযুক্ত চিকিৎসা নিতে হবে।
কিভাবে জন্ডিসের চিকিৎসা করতে হয়?
১. মায়ের বুকের দুধ- সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং ১ নম্বর চিকিৎসা হচ্ছে বাচ্চাকে ঘনঘন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।কারণ জন্ডিস হলে বাচ্চার শরীরে পানি / ফ্লুইড কমে ডিহাইড্রেশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যদি বুকের দুধ একদমই কম আসে সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শে অল্প পরিমান ফর্মুলা মিল্ক দেয়া যেতে পারে।
২. রোদ লাগানো- প্রতিদিন সকালে (৭-৮) টার ভেতরে রোদে বাচ্চাকে ৩০ মিনিট রাখতে হবে। বাচ্চার চোখ মুখ ও লজ্জাস্থান আড়াল করে বাকি শরীর যত বেশি উন্মুক্ত রাখা যায়।
৩.ফটোথেরাপি- নীল আলোর নিচে বাচ্চাকে রাখা হয়, চোখ আর লজ্জাস্থান ঢেকে রেখে। নীল আলোতে রাখলে সেটা বাচ্চার বিলিরুবিনকে ভেংগে ফেলতে পারবে এবং সেটি বাচ্চার পায়খানার সাথে বের হয়ে যাবে। ফলস্বরূপ জন্ডিস সেরে যাবে।
ফটোথেরাপি দিলে কোন কোন বিষয় খেয়াল রাখতে হবে?
জন্ডিসে আক্রান্ত বাচ্চাকে ফটো থেরাপি দিতে চাইলে কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, যেমন-
১. বাচ্চার ঘনঘন পায়খানা হবে বা পায়খানার পরিমাণ বেড়ে যাবে যেহেতু বিলিরুবিনটা পায়খানার সাথে বের হয়ে যাবে।
২.সারা গায়ে অল্প কিছু ফুসকুড়ি বা র্যাশের মতো হতে পারে।
৩. বাচ্চার ডিহাইড্রেশন হতে পারে।, তাই বাচ্চাকে বেশি করে মায়ের বুকের দুধ দিতে হবে।
বাচ্চাকে রোদে ধরলেই জন্ডিস চলে যাবে?
খুব অল্প পরিমান সূর্যের আলো বাচ্চার শরীরের জন্য উপকারী হতে পারে। কিন্তু বেশিক্ষণ রাখলে বা প্রখর রোদে রাখলে বাচ্চার সানবার্ন বা রোদে পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য এখন অনেক দেশে এবং অনেক ডাক্তাররা বাচ্চাকে রোদে দেওয়াকে নিরুৎসাহিত করেন। তবে সূর্যের আলো ভিটামিন-ডি এর ভালো উৎস, তাই কিছু সময় নরম রোদে লাগানো যায়।
জন্ডিসে কী কী লক্ষণ বিপদজনক এবং ইমার্জেন্সি-
জন্ডিসে কিছু কিছু লক্ষণ বিপদজনক যেগুলো সবসময় খেয়াল রাখতে হবে। যেমন-
১. এক মাসের বেশি সময় ধরে বাচ্চার চোখ, মুখ, বুক হলুদ থাকা ।
২. চোখ, মুখ, বুক হলুদের সাথে যদি হাতের তালু, পায়ের তালুও হলুদ হয়ে যায়।
৩. উপরের লক্ষণগুলোর সাথে বাচ্চার প্রস্রাব কম হওয়া, বাচ্চা ঝিমায়ে যাওয়া।
উপরের যেকোনো লক্ষণ মিলে গেলেই যত শীঘ্র পারা যায় ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
জন্ডিসে যা কখনোই করণীয় নয়-
***আমাদের দেশে গ্রামে ও শহরে জন্ডিসের চিকিৎসায় নানান রকম ঘরোয়া/ কবিরাজি চিকিৎসা যেমন বাচ্চাকে ছাল বাকলের রস খাওয়ানো, ঝাড়-ফুঁক, গোসল, মায়ের জন্য বিভিন্ন নিয়ম কানুন প্রচলিত আছে যা ভালোর চেয়ে মন্দই করে বেশি।
তাই বাচ্চার জন্ডিসের চিকিৎসায় এসব ভুল পদ্ধতি প্রয়োগ না করে ডাক্তারের পরামর্শ মতো চিকিৎসা নিতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, নবজাতকের জন্ডিস কোন ভয়ের বিষয় নয়। যদি সাধারন জন্ডিস হয় তবে সেখানে কোন চিকিৎসা লাগবে না , আর যদি অসুখ হিসেবে জন্ডিস হয় তবে ভীত বা আতঙ্কিত না হয়ে ডাক্তারের পরামর্শ মতো চিকিৎসা নিতে হবে। সঠিক চিকিৎসায় জন্ডিস সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা ও পরিবর্ধন: সাবিকুন্নাহার ননী