একজন গর্ভবতী নারী তার গর্ভকাল জুড়ে নানান রকমের শারীরিক পরিবর্তন ও অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দাঁতের সমস্যা। বিভিন্ন হরমনাল ও যত্নজনিত কারণে গর্ভবতী মায়েদের এই সমস্যা হয় যা প্রেগ্ন্যান্সি জিনজিভাইটিস (Pregnancy Gingivitis) নামে পরিচিত। মা ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষায় এই ব্যাপারে যত্নবান হওয়া দরকার।

প্রেগ্ন্যান্সি জিনজিভাইটিস (Pregnancy Gingivitis) কী?

জিনজিভাইটিস হচ্ছে মাড়ির প্রদাহজনিত একটি রোগ যার ফলে মাড়ি ফুলে যাওয়া, রক্ত পড়া ও ব্যাথা হয়। নিয়মিত দাঁত ব্রাশ না করলে আমাদের দাঁতের উপরিভাগে প্লাক (Plaque ) নামে পরিচিত একধরণের রঙহীন আঠালো পর্দা(Biofilm ) তৈরি হয়। এই প্লাক দাঁত ও মাড়ির সংযোগস্থলে জমে জমে পাথরের মতন তৈরি করে, প্লাকের ব্যাকটেরিয়া মাড়িতে আক্রমণ করে। ফলাফল স্বরূপ ডেন্টাল ক্যালকুলাস বা দাঁতের পাথর তৈরি হয়ে মাড়িতে ব্যাথা ও রক্তপাত সৃষ্টি করে। এটিকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে জিনজিভাইটিস বলা হয় যা আমাদের অনেকের মাঝেই দেখা যায়।

এই জিনজিভাইটিস গর্ভবতী নারীদের মাঝে গর্ভকালের দ্বিতীয় থেকে ৮ম মাসের মাঝে বেশি দেখা যায়। গর্ভবতী নারীদের মাড়ির প্রদাহের এই অসুখকে বলা হয় প্রেগ্ন্যান্সি জিনজিভাইটিস (Pregnancy Gingivitis)।

প্রেগ্ন্যান্সি জিনজিভাইটিসের কারণ

  • প্রেগ্ন্যান্সিতে একজন নারীর শরীরে ইস্ট্রোজেন, প্রজেস্টেরন সহ বিভিন্ন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। এসকল পরিবর্তনের ফলে অনেক নারী দাঁত ও মাড়ির প্রদাহের স্বীকার হন
  • মর্নিং সিকনেস বা সকালে বমি বমি ভাব হওয়া প্রেগ্ন্যান্সির একটি সাধারন উপসর্গ। এর ফলে অনেক গর্ভবতী সকালে ব্রাশ করতে চান না। এই সুযোগে দাঁতে প্লাক জমতে থাকে ও প্রেগ্ন্যান্সি জিনজিভাইটিস দেখা দেয়।
  • মর্নিং সিকনেস ছাড়াও অনেকেরই পেস্টের গন্ধে বমি লাগে বলে দিনের অন্য সময়েও ব্রাশ করতে চাননা, কেউ ক্লান্তি ও অবহেলায় দাঁতের যত্ন নেন না। এসবের ফলেও জিনজিভাইটিস দেখা দিতে পারে।
  • হরমোনাল পরিবর্তনের ফলে দাঁতের প্লাকের বিরুদ্ধে গর্ভবতীর শরীর  শক্ত প্রতিরক্ষা তৈরি করতে পারেনা, ফলে প্লাক জমে সহজেই।
  • দাঁতের মাড়িতে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পাওয়াও এক্ষেত্রে একটি কারণ হতে পারে।
  • যেসব নারী ডায়বেটিস, ক্যান্সার ইত্যাদি দুর্বল ইমিউনিটিজনিত রোগে ভোগেন এবং এন্টি- এপিলেপ্টিক ড্রাগ, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করেন, তাদের মাঝে এই সমস্যা আরও প্রকট আকারে দেখা দেয়।  

সর্বোপরি, কিছু শারীরিক পরিবর্তন ও কিছু নিজের আচরনের প্রভাবে এই রোগ দেখা দেয়।

প্রেগ্ন্যান্সি জিনজিভাইটিসের লক্ষণসমুহ

প্রেগ্ন্যান্সি জিনজিভাইটিসের কিছু লক্ষণ রয়েছে যেগুলো দেখে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। লক্ষণ গুলো হচ্ছে-

১। মাড়ির রঙ লাল হয়ে যাওয়া

২। মাড়িতে ব্যাথা

৩। নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ হওয়া

৪। দাঁতে শিরশির ভাব

৫।দুই দাঁতের মাঝের মাড়ি ফুলে যাওয়া

৬।দাঁত নড়ে যাওয়া ইত্যাদি।

প্রেগ্ন্যান্সি জিনজিভাইটিসের চিকিৎসা

প্রতিকার

যদি গর্ভবতী মায়ের জিনজিভাইটিস দেখা দেয়ই, তবে সেটির চিকিৎসা করাতে হবে। এক্ষেত্রে চিকিৎসা পদ্ধতি কী হবে সেটি নিশ্চিত করবেন চিকিৎসক। ঘরোয়া ভুল চিকিৎসা বা হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা না করাই উত্তম।

সাধারণত প্রেগ্ন্যান্সি জিনজিভাইটিসের ক্ষেত্রে প্রধান চিকিৎসা হচ্ছে দাঁতের প্লাক পরিষ্কার করা যেহেতু প্লাক জমেই জিনজিভাইটিস অসুখ হয়। সেই সাথে চিকিৎসক প্রয়োজনীয় এন্টিবায়োটিক ও ওন্যান্য ওষুধ দিতে পারেন। পাশাপাশি দাঁতের সুরক্ষায় দাঁত ব্রাশ, ফ্লসিং, গরম পানির কুলকুচা ইত্যাদি প্রতিরোধমূলক ব্যাবস্থার পরামর্শ দিতে পারেন।

গর্ভের বাচ্চার যেন ক্ষতি না হয় সেই বিষয়টি নিশ্চিত করেই  প্রয়োজন মনে করলে ডাক্তার এক্স-রে পরীক্ষা দিতে পারেন।

চিকিৎসা কী হবে সেটি ডাক্তার রোগীর লক্ষণ বুঝেই নির্ধারণ করবেন। রোগীর কাজ হচ্ছে সময়মত ডাক্তারের কাছে যাওয়া ও ডাক্তারের পরামর্শ অনুসরণ করা কেননা প্রায়ই দেখা যায় গর্ভবতী মা ক্লান্তি বা অবহেলা এবং ভুল ধারনার বশবর্তী হয়ে দাঁতের ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। অথচ গর্ভাবস্থায় অন্যান্য চিকিৎসার মতন দাঁতের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও জরুরী।

প্রতিরোধ

এই অসুখের জন্য প্রথমেই দরকার প্রতিরোধ। মানে দাঁতের জিনজিভাইটিস যেন না হতে পারে আগে থেকেই সে বিষয়ে গর্ভবতী মা-কে সচেতন হতে হবে ও সেই অনুযায়ী ব্যাবস্থা নিতে হবে। যেমন

  • সাধারন সময়ে ও প্রেগ্নন্যান্সির শুরু থেকে নিয়মিত দুইবেলা দাঁত ব্রাশ করতে হবে ও একবার ফ্লস করতে হবে।
  • নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে যেন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক থাকে।
  • মিষ্টি ও চিনি জাতীয় খাবার কম খেতে হবে বা পরিহার করতে হবে।
  • তামাক ও এলকোহল সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • প্রেগ্ন্যান্সির প্রস্তুতির শুরুতেই মুখের চেক আপ করিয়ে নিলে আগে থেকেই কিছুটা নিরাপদ থাকা যায়। কিংবা প্রেগ্ন্যান্সির শুরুতেই অন্যান্য চেকআপের মতন একজন ডেন্টিস্টের পরামর্শ নিলে ভালো হয়।
  • মাউথওয়াশ ব্যাবহার করতে হবে যেন মুখের জীবাণু মারা যায়।

এই কাজগুলো করলে গর্ভবতীর দাঁতের সমস্যা কম হবার সম্ভাবনা থাকবে।

পরিশেষে বলা যায়, গর্ভবতী নারীদের মাঝে ৫০-৭০% মায়েরই প্রেগ্ন্যান্সি জিনজিভাইটিস দেখা দেয় এবং আশার কথা হচ্ছে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এটি সন্তান প্রসবের পর আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়। মায়ের যদিও সাময়িক অসুবিধা হয় তবে সাধারণত  এই অসুখের প্রভাব গর্ভের বাচ্চার উপর পড়ে না। তাই ভয় বা দুশ্চিন্তা না করে প্রেগ্ন্যান্সিতে দাঁতের যত্ন নিন। গর্ভবতী মায়ের সামগ্রিক সুস্থতার প্রভাব তার বাচ্চার উপরে দেখা যায়। তাই দাঁতের যত্নে হেলাফেলা না হোক।

অনেকেই ভাবেন গর্ভাবস্থায় দাঁতের চিকিৎসা করা যায়না যেটি অত্যন্ত ভুল। সঠিক চিকিৎসায় সহজেই এই অসুখ সেরে যায়। আর অবহেলা করলে সাধারন জিনজিভাইটিস থেকে বড় রকমের অসুখ হয়ে দাঁত ফেলে দেবার মতন ঘটনাও ঘটে যেতে পারে, যার নাম Periodontitis , এমনকি প্রি-ম্যাচিউর ডেলিভারির ঘটনাও ঘটতে পারে। তাই হেলা না করে দাঁতের ডাক্তার দেখান , যত্ন নিন ও সুস্থ থাকুন।

তথ্যসূত্র

১।What is Pregnancy Gingivitis? How to prevenT it?
২।Pregnancy Gingivitis

সাবিকুন্নাহার ননী এই লেখার পরিবর্ধনে অবদান রেখেছেন।