ভূমিকা
হরমোন শব্দের বাংলা হচ্ছে “প্রাণরস”। নাম শুনেই বুঝা যাচ্ছে আমাদের শরীরে এর ভূমিকা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানব সন্তানের জন্মপ্রক্রিয়া শুরু হয় শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলিত হবার মধ্য দিয়ে। সেই থেকে শুরু করে মায়ের গর্ভে একটি পরিপূর্ণ ফিটাস হিসেবে বেড়ে উঠা, প্রসবের মাধ্যমে পৃথিবীতে আগমন, জীবনের নানান আবেগে অনুভুতির সাথে পরিচিত হওয়া- এই সবকিছুর পেছনেই রয়েছে নানান রকমের হরমোনের প্রভাব।
একজন নারী যখন প্রাকৃতিক প্রসবের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিতে প্রস্তুত হন, তখন তার শরীরে নানান রকম হরমোন কাজ করে। কিছু হরমোন প্রাকৃতিক প্রসবকে তরান্বিত করে , কিছু আবার প্রসবকে জটিল করে তোলে।
প্রাকৃতিক প্রসবের সাথে হরমোনের সম্পর্ক নিয়েই থাকছে আজকের লিখা।
হরমোন কী?
আমাদের শরীরে বিভিন্ন রকমের গ্রন্থি থাকে, যেগুলোকে অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি বলে। এগুলো থেকে নানান রকমের রস নির্গত হয়, যাদের নাম ‘হরমোন”। এই হরমোনগুলো শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকমের কাজ করে। মানব সন্তান প্রসবের প্রক্রিয়ায় কিছু হরমোন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রাকৃতিক প্রসবে কী কী হরমোন কাজ করে?
একজন গর্ভবতীর প্রসব ব্যাথা উঠা, ব্যাথা বৃদ্ধি পাওয়া, জরায়ু মুখ খুলে পুশ করতে থাকা, বাচ্চা প্রসব হওয়া, মায়ের বুকে দুধ আসা, এমনকি মা ও সন্তানের মাঝে ভালোবাসা সৃষ্টি- এই সবকিছুর সাথে বিশেষ কিছু হরমোনের সম্পর্ক খুবই গভীর।
কিছু হরমোন আছে যা প্রসবকে সহজ করে তোলে আবার কিছু হরমোন প্রসব প্রক্রিয়ায় বাঁধা সৃষ্টি করে। একজন মা যদি সঠিকভাবে জানতে পারেন কোন কাজে কিভাবে কোন হরমোন কাজ করে, তবে আশা করা যায় তিনি প্রসবের সময় সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী ভূমিকায় থাকতে পারবেন, এতে করে উপকারী হরমোনের উপস্থিতি নিশ্চিত করে ক্ষতিকর হরমোনকে বাঁধা দেয়া সহজ হবে।
প্রাকৃতিক প্রসবের সাথে জড়িত এমন ৪ টি হরমোন রয়েছে। যথা-
অক্সিটোসিন (Oxytocin)
“লাভ হরমোন ( Love Hormone)” বা “ভালোবাসার হরমোন” নামে পরিচিত এই হরমোনটি পুরো প্রেগ্নেসিতেই একটি একটু করে নিঃসৃত হতে থাকে এবং লেবারে এসে আরও বেড়ে যায়। প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়ের বুকে দুধ উৎপাদনেও এর ভূমিকা রয়েছে।
অক্সিটোসিন হরমোনটি আমাদেরকে ভালো অনুভব করতে সাহায্য করে, আনন্দের অনুভূতি জাগায়। আরামদায়ক ও আদরের পরিবেশে এই হরমোন নিঃসৃত হয়।
প্রসবের সময় সারভিক্স (cervics) খুলতে, প্রসব ব্যাথার সাথে ভারসাম্য রাখতে, বার্থ ক্যানেল দিয়ে বাচ্চা জরায়ুর বাইরে বের করতে এবং প্লাসেন্ট্রা বাইরে বের করতেও অক্সিটোসিন হরমোন কাজ করে।
পরবর্তীতে ব্রেস্টফিডিং করানোর সময়ও এই হরমোন সক্রিয় থাকে।
এন্ডরফিন্স (Endorphins)
এন্ডরফিন হচ্ছে প্রাকৃতিক মরফিন বা ব্যাথানাশক। আমরা যখন ভয় পাই বা চাপ অনুভব করি, তখন আমাদেরকে শান্ত ও ব্যথামুক্ত রাখার জন্য এন্ডরফিন নামে হরমোন নিঃসৃত হয়। প্রসবের সময় একজন নারী প্রচণ্ড ব্যাথার অনুভুতির মাঝে থাকেন। এসময় এন্ডরফিন হরমোনের নিঃসরণ এই মা-কে শান্ত থাকতে তে সাহায্য করে।
এমনকি সন্তান প্রসবের পড়ে মা ও শিশুর নিজেদের মাঝে সম্পর্ক স্নেহপূর্ণ করতেও এই হরমোন ভূমিকা রাখে। তাই , সন্তান প্রসবের পর এন্ডরফিনের কম নিঃসরণের ফলে বেবি ব্লু ( Baby Blues) বা পোস্ট পারটাম ডিপ্রেশনের সম্ভাবনা থাকে।
লেবারের সময় যদি কম মাত্রায় এন্ডরফিন নিঃসরণ হয় তবে মায়ের কাছে তার প্রসব ব্যাথা অত্যন্ত অসহনীয় লাগতে পারে।
তাই প্রাকৃতিক প্রসবের সময় এন্ডরফিনের অবাধ প্রবাহ খুবই প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। তবে, লেবারে বাইরে থেকে ব্যাথানাশক ওষুধ প্রয়োগ করা ঠিক নয় কেননা এর ফলে এন্ডরফিনের নিঃসরণ কমে যায়।
এড্রেনালিন (Adrenaline)
এড্রেনালিন হরমোনকে বলা হয় “সারভাইভাল হরমোন” যেখানে দুইটা নির্দেশনা থাকে- “লড়াই করো বা পালিয়ে যাও ( Fight or Flight”)। কোন মানুষ বা প্রাণী যদি এমন কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় যেখানে সে আতঙ্কিত বোধ করছে বা তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে, তবে সেই প্রাণীর ব্রেইন থেকে প্রচুর পরিমাণ এড্রেনালিন নিঃসৃত হয় এবং তাকে তাড়া দিতে থাকে এই আতঙ্ক/ হুমকি থেকে “দূরে সরে যেতে” অথবা “লড়াই করতে”।
প্রাকৃতিক প্রসবের ক্ষেত্রে এড্রেনালিনের মিশ্র ভূমিকা রয়েছে। যেহেতু প্রসবের সময় একজন মা ভীত ও আতঙ্কিত থাকেন, তাই তখন প্রচুর পরিমাণ এড্রেনালিন নিঃসরণ ঘটে যা তার প্রসবে বাঁধা দেয় , কন্ট্রাকশণের প্যাটার্ন বদলে দিতে পারে ও মায়ের লেবার দীর্ঘায়িত করে। এছাড়া গর্ভের বাচ্চার ক্ষতি করতে পারে।
কিন্তু প্রসবের একদম শেষের দিকে এই হরমোন প্রচন্ড বেগে প্রবাহিত হয় এবং মা ও বাচ্চাকে জেগে উঠার ম্যাসেজ পাঠায়।
মা যদি সঠিক প্রি-নাটাল জ্ঞান অর্জন করেন ও হরমোনের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত থাকেন তবে তিনি আতঙ্কিত না হয়ে ভয় থেকে পালিয়ে না গিয়ে লড়াই করতে পারেন যা তার প্রাকৃতিক প্রসবে সাহায্য করবে।
প্রল্যাক্টিন (Prolactin)
একজন প্রসূতি মায়ের বুকে দুধ উৎপাদনের কাজ করে প্রল্যাক্টিন হরমোন। গর্ভাবস্থায় একটু একটু করে এই হরমোন নিঃসরণ ঘটে এবং প্রসবের সময় এটির নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়। মায়ের শরীরকে শিশুর দুধপানের জন্য উপযোগী করে তোলার কাজটি করে প্রলেক্টিন।
হরমোন ঠিকভাবে নিঃসৃত না হলে যেসব সমস্যা দেখা দেয়
প্রাকৃতিক প্রসবের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোনগুলো ঠিকভাবে নিঃসৃত না হলে বা কম মাত্রায় নিঃসৃত হলে প্রসবের সময় নানান জটিলতা দেখা দেয়। যেমন-
১। লেবার দীর্ঘায়িত হতে পারে যা মায়ের জন্য কষ্টকর ও ক্ষতিকর।
২। প্রসবের পর প্লাসেন্ট্রার চারপাশে ব্লিডিং হওয়া।
৩। জন্মের আগেই সন্তানের ক্ষতি ।
৪। মায়ের জন্য প্রসব প্রক্রিয়া খুব জটিল ও আতংকের বলে মনে হয়।
সর্বোপরি, প্রয়োজনীয় হরমোন প্রবাহে বাঁধা তৈরি ও ক্ষতিকর হরমোনের নিঃসরণ হলে সম্পূর্ণ প্রসব প্রক্রিয়া মায়ের জন্য স্মরণীয় না হয়ে একটি কষ্টদায়ক অধ্যায়ে পরিণত হতে পারে , যা তার মাতৃত্বের অনুভুতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তাই লেবারের সময় করণীয় সম্পর্কে জেনে নেয়া উচিত যেন উপকারী হরমোনের অবাধ নিঃসরণ নিশ্চিত করা যায়।
উপকারী হরমোনগুলোর অবাধ নিঃসরণে করণীয়
প্রাকৃতিক প্রসব মানেই একজন নারীর শরীরে আল্লাহ্ প্রদত্ত ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে প্রসব সম্পন্ন করা। এর জন্য নারীর শরীরে প্রাকৃতিক প্রসবে ভূমিকা রাখা উপকারী হরমোন বৃদ্ধি করার পরিবেশ তৈরি করা দরকার।
উপকারী হরমোনের নিঃসরণে যা করা যেতে পারে তা হচ্ছে-
১। প্রসব উপযোগী পরিবেশ
প্রাকৃতিক প্রসবে সবচে বেশী ভূমিকা পালনকারী হরমোন যেমন অক্সিটোসিন ও এন্ডরফিন্স – এদেরকে বলা হয় “লাজুক হরমোন (Shy Hormones)। এগুলো খুব নিরাপদ ও প্রাইভেট পরিবেশে নিঃসরণ হয়, যেমনটা দেখা যায় শারীরিক সম্পর্ক তৈরির সময়।
তাই প্রসবের পরিবেশ খুব নিরাপদ, আরামদায়ক ও প্রাইভেট হওয়া দরকার। অনেক হাসপাতালেই দেখা যায় লেবার রুমের পরিবেশ সুন্দর নয়, গোপনীয়তার সুযোগ নেই, প্রচুর কোলাহল থাকে, খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে না ইত্যাদি।
অনেকের ক্ষেত্রে নিজের বাসা বা বাড়িতেও প্রসবের জন্য আলাদা রুম থাকে না।
এরকম বৈরি পরিবেশে হরমোন ঠিকভাবে নিঃসৃত হতে পারেনা ও প্রসব বিঘ্নিত হয়। তাই প্রসব অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
এর জন্য গর্ভাবস্থায়ই কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ভালো। যেমন, বাড়িতে নিজেদের সাধ্যের মাঝেই একটা রুম গুছিয়ে রাখা যায় বা হাসপাতালে প্রসবের ইচ্ছা থাকলে হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে যাচাই করে নেয়া যায় সেখানকার পরিবেশ কেমন ইত্যাদি।
২। উপযুক্ত সাপোর্ট পারসনের উপস্থিতি
প্রসবের সময় মায়ের কাছে নির্ভরশীল, সাহসী ও প্রি- নাটাল জ্ঞান আছে এমন সাপোর্ট পারসনের উপস্থিতি মা-কে নির্ভার থাকতে সাহায্য করে। মায়ের কাছে যদি আনাড়ি ও অদক্ষ দাই থাকে তাহলে মা এমনিতেই হতোদ্যম হয়ে পরবেন। তাই এসময় মায়ের কাছে তার আপনজন ও প্রসব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কারোর উপস্থিতি বাঞ্ছনীয়।
৩। মায়ের মানসিক দৃঢ়তা ও প্রসব প্রস্তুতি
প্রাকৃতিক প্রসবের জন্য সবচে প্রয়োজন মায়ের নিজের উপর আত্মবিশ্বাস ও প্রসব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। একজন নারী যদি জানেন আল্লাহ্ তায়ালা তার শরীরে কী বিস্ময়কর ও সুচারুরূপে সন্তান জন্মদানের সকল প্রক্রিয়া তৈরি করে রেখেছেন, এবং এখানে মায়ের ভূমিকা কেমন হবে সেসব জানলে গর্ভবতী মা প্রসবের মতন কঠিন সময়েও শক্তিশালী থাকবেন। পাশাপাশি, প্রসব ব্যথার কষ্টের বিনিময়ে তায়ালা যে পুরষ্কার ঘোষণা করেছেন তা মনে রাখলে সহজেই প্রাকৃতিক প্রসবকে একটি নিয়ামাত বলে মনে হবে।
প্রাকৃতিক প্রসব মানে হরমোন ও মায়ের ভারসাম্যপূর্ণ অংশগ্রহণ। মেডিক্যাল বা সাপোর্ট পারসনরা এখানে দ্বিতীয় পর্যায়ের কুশলী, মা নিজেই এখানে “হিরো”। তাই প্রাকৃতিক প্রসবের সাথে জড়িত হরমোন ও অন্যান্য শারীরিক পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা উচিত যেন প্রসবকে হুমকি হিসেবে না নিয়ে সাহসের সাথে মোকাবেলার মাধ্যমে একে উপভোগ্য করা যায়।
তথ্যসূত্র
১। The role of hormones in childbirth
২। How to encourage high hormone levels during labour
৩। হরমোনের কাজ কী?
লেখাটি রিভিউ করেছেন –
ডাঃ সাবরিনা আফরোজ
MBBS, MPH
লেকচারার, ঢাকা কমিউনিটি মেডিসিন কলেজ