সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম ও সংসার গুছিয়ে রাখার দায়িত্ব সাধারণত মেয়েদের হাতে থাকে। আর যখন সে মা হয়, তখন তার এই দায়িত্ব দ্বিগুণ হয়। নবজাতক বা ছোট বাচ্চার দেখাশুনার পাশাপাশি ঘরকে গুছিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা একটা চ্যালেঞ্জের মতো।

মেয়েদের এই দায়িত্ব আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত, তবে দৈনন্দিন এসব কাজ সহজ করে নেয়ার জন্য বর্তমান প্রযুক্তি হিসেবে ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে অন্তত কাপড় ধোয়ার কাজটা সহজ হয়ে আসবে।

আপনি চাইলে বুয়া বা খাদেমা রাখতে পারেন। সেটা সম্পূর্ণ আপনার নিজস্ব সামর্থ্য ও ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তবে সম্ভব হলে ওয়াশিং মেশিন কিনে ফেলাটাই উত্তম। যেহেতু ওয়াশিং মেশিন এখনো খুব একটা সাধারণ হয়ে ওঠেনি, তাই অনেকেই এটা নিয়ে অস্বচ্ছ ধারণা রাখেন। নানান রকম প্রশ্ন রয়ে যায় ক্রেতাদের মনে। আমি চেষ্টা করেছি এই লেখাতে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিতে। আশা করা যায় মায়েদের উপকার হবে।

ওয়াশিং মেশিন কী?

ওয়াশিং মেশিন হলো বিদ্যুৎচালিত একটি যন্ত্র যা দিয়ে কাপড় ধোয়া যায়। এতে থাকা সুইচ অন করে সহজেই কাপড় ধুয়ে ফেলা সম্ভব। ফলে মায়েদের সময় ও শ্রম অনেকটাই বেঁচে যায়।

কেন ওয়াশিং মেশিন?

হাতে কাপড় ধোয়ার মতো শারীরিক শ্রমের কাজ এড়াতে এবং সময় বাঁচাতে ওয়াশিং মেশিন দারুণ কাজের। আধুনিক ওয়াশিং মেশিনে কাপড় কাঁচার পাশাপাশি প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত শুকিয়ে ফেলার ব্যবস্থাও থাকে।

কিছু মেশিনে কাপড় ভিজিয়ে রাখা যায় এবং টাইমার দিয়ে সুবিধামতো সময়ে তা ধুয়ে ফেলার ব্যবস্থা থাকে।

প্রকারভেদ

সুবিধা বা ফিচারের ভিত্তিতে ওয়াশিং মেশিন দুই রকমের হয়।

সেমি অটো মেশিন

সাধারণত এধরনের মেশিনে দুটো টাব থাকে। একটাতে ধোয়ার কাজ হয়, ধোয়া শেষে কাপড় তুলে অন্যটায় দিলে পানি ঝড়িয়ে প্রায় শুকনো করে দেয়। এসব মেশিনে পানির সংযোগ স্বয়ংক্রিয় না, বরং ওয়াশ শুরুর আগে পানির লাইন চালু করে নিতে হয় এবং শেষে বন্ধ করতে হয়।

এমন মেশিনের দাম ফুল অটো মেশিনের তুলনায় কম হয়।

ফুল অটো মেশিন

এমন মেশিনে একটাই টাব থাকে। সাধারণত প্রথমবার সেট করার সময় বিদ্যুত ও পানির সংযোগ দিয়ে দেয়া হয়। কাপড় কাঁচার সময় শুধু ডিটারজেন্ট বা লিংকুইড ক্লিনার দিয়ে মেশিনে থাকা নির্দেশনা বাটনগুলো চাপ দিলে মেশিন স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানির লাইন থেকে পানি নিয়ে কাপড় ধুয়ে ফেলবে। আর সব কাজ (কাপড় কাঁচা, ময়লা পানি পরিবর্তন করা, কাপড় থেকে পানি ঝরানো) শেষ হয়ে গেলে নিজেই সিগনাল দিয়ে অফ হয়ে যাবে।
এছাড়াও মেশিনে কাপড় দেয়ার ধরণ ও প্রযুক্তির পার্থক্যের ভিত্তিতে ওয়াশিং মেশিন দুই ধরণের হয়।

টপ লোডিং

এধরণের মেশিনে টাবটি উলম্বভাবে সেট করা থাকে। আর ঢাকনাটি উপরের দিকে থাকে, এবং কাপড় দেয়া-নেয়ার কাজটি দাড়িয়ে করতে হয়।

ফ্রন্টলোডিং

এ ধরণের মেশিনে টাবটি আনুভূমিক ভাবে থাকে এবং ঢাকনাটি সামনের দিকে মাঝখানে থাকে। অনেকটা গোল চাকতির মতো দেখায়।
সাধারণত ফ্রন্টলোডিং মেশিন প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত এবং বেশি দামী হয়। তবে, আমাদের দেশে টপলোডিং মেশিন বেশি জনপ্রিয়।

কোনটা ভালো হবে?

সুযোগ সুবিধার কথা বিবেচনা করলে ফুল আটো ওয়াশিং মেশিনগুলো বেশি সুবিধাসম্পন্ন। সুবিধা যেমন বেশি তার দামটাও বেশি। যদি ক্রেতা হিসেবে আপনার বাজেট ২৫-৩০ হাজারের মধ্যে থাকে তাহলে ফুল অটো মেশিন কিনার পরামর্শ দিবো। আর যদি ১৫-২০ হাজার হয় তাহলে সেমি অটো মেশিনগুলো কিনতে পারবেন।

আবার ফ্রন্ট লোডিং ওয়াশিং মেশিনের দাম টপ লোডিং ওয়াশিং মেশিনের তুলনায় বেশি; মানের দিক থেকেও ভালো। তবে, টপ লোডিং ওয়াশিং মেশিনের একটি সুবিধা হলো এতে মেশিন চলাকালীন সময়েও কাপড় দেয়া যায়। যাদের কোমরে সমস্যা আছে তারাও টপ লোডিং মেশিনেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

ওয়াশিং মেশিন নিয়ে সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন

দাম কেমন হয়

ফুল অটো ওয়াশিং মেশিনের দাম হয় মেশিনের ধারণক্ষমতার উপর; যত কেজি কাপড় ধুতে সক্ষম। বর্তমান বাজার মূল্যে ন্যূনতম প্রায় ২৫ হাজার টাকা থেকে দাম শুরু হয়। আমাদের দেশে ৬-১৫ কেজি ধারণক্ষমতার মেশিন আছে। এছাড়া কোম্পানি/ব্রান্ড ভেদেও দাম আলাদা হয়।

সেমি অটো মেশিনের দাম তুলনামূলকভাবে বেশ কম। একটা ১০ কেজি ধারণক্ষমতার মেশিনের দাম ১৫ হাজার এর মধ্যে।

কোন ব্রান্ড ভালো

ব্রান্ড যেটাই হোক যন্ত্র মোটামুটি সবই ভালো। দেশিয় ব্রান্ডের সাথে টপ ব্রান্ডগুলোর একটা পার্থক্য অবশ্যই আছে তবে তা খুব বেশি না, সামান্যই। আমাদের দেশে বেশিরভাগ সিঙ্গার, ওয়ালটন, হিটাচি, স্যামসাং, শার্প, এলজি ইত্যাদি ব্রান্ডবেশি ব্যবহৃত হয়। ক্রেতা হিসেবে আপনি নিজের সামর্থ্যের মাঝে পছন্দের ডিজাইনের মেশিনটি বেছে নিবেন।

কতো কেজির নিলে ভালো

সেটা নির্ভর করে আপনার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ও কাপড় ধোয়ার অভ্যাসের উপর। ৫ জনের একটা পরিবারে ৬-৮ কেজির মেশিন যথেষ্ট। তবে, চাইলে মেশিনে কয়েকবার কাপড় দিয়ে ধোয়া যায়। ৬ কেজির একটা মেশিন যদি দুইবার চালানো হয় তাহলে ৮-১০ কেজি কাপড় ধোয়া যাবে। আপনি চাইলে পাতলা কম্বল বা কাঁথাও এতে ধুতে পারবেন। তাই কতো কেজির মেশিন নেয়া দরকার তা নিজের দৈনন্দিন ব্যাবহারের হিসাব করে নির্ধারণ করতে হবে।

কাপড় কেমন পরিষ্কার হয়

কাপড়ে থাকা সাধারণ দাগ, ময়লা, ধুলো সবই পরিষ্কার হয়ে যায়। তবে একেবারে বসে যাওয়া দাগ উঠেনা। ভালো পষ্কিারের জন্য বেশিক্ষণ কাপড় ভিজিয়ে রাখলেই হবে। মেশিনে গরম পানির ফিচার থাকলে সেটাও ব্যবহার করতে পারেন।

এছাড়াও কলারের ময়লার মতো বসে যাওয়া ময়লার ক্ষেত্রে কাপড় আগে ভিজিয়ে রেখে হাতে ঘষে পরিষ্কার করে ওয়াশে দেয়া যেতে পারে।

সব কাপড় ধোয়া যায় নাকি

সাধারনভাবে সব কাপড় ধোয়া যায় তবে কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে। খুব পুঁথিওয়ালা কাপড়, কাপড়ে ধাতব বা শক্ত কিছু থাকলে সেগুলো মেশিনের গায়ে লেগে মেশিন অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। খুব পাতলা বা নেটের কাপড় ধোয়া যাবে না। মেশিন যখন পানি নিংড়ানোর সময় খুব জোরে ঘোরানোর সময় টান পরে নরম কাপড় ছিঁড়ে যেতে পারে।

এছাড়া প্রায় সব কাপড় ধোয়া যায়। অনেকে পাপস, পর্দাও ধুয়ে নেন। কম্বলের মতো জিনিস ধোয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে সেটা পানি শুষে নিয়ে কতটা ওজনে দাড়াচ্ছে। মেশিনের সামর্থের বেশি দিলে সেটা মটরের ক্ষতির কারণ হতে পারে।

কাপড় নষ্ট হয়ে যায় কি না

না, কাপড় ছিঁড়ে যায় না। একদম নরম কাপড় হলে তো ছিড়তে পারে,, হাতে কাঁচলেও ছিড়বে। তবে কেউ কেউ মনে করেন কিছুটা ক্ষতি হয় কাপড়ের। সেটা অবশ্য এমনিতে কাপড় ব্যাবহার করতে করতেও হয়।

কাপড়ের মান ঠিক রাখতে লিকুইড ক্লিনার ব্যবহারের পরামর্শ অনেকে দেন, যদিও এধরনের ক্লিনারের খরচ সাধারণ ডিটারজেন্টের চেয়ে বেশি।

পাক নাপাক ইস্যু

একজন মুসলমান হিসেবে বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর স্বস্তির বিষয় হলো, ওয়াশিং মেশিনে কাপড় পাক হয়। বালতিতে হাতে কাপড় ধুলে যেভাবে ধোয়া লাগে, সেভাবে মেশিনেও অপশন দেওয়া যায়। তিন বার ধোয়ার- তাতে তিনবার পানি নেয়, তিনবার কাঁচে ও তিনবার পানি ফেলে নিংড়ে নেয়। আর তিনবার ধোয়ার পর নাপাকি চলেই যায়।

মেশিন পরিষ্কার রাখার নিয়ম

যে মেশিন কাপড় পরিষ্কার করে তাকেও পরিষ্কার রাখতে হয়। ফুল অটো মেশিনগুলোতে ঝামেলা কম। মেশিনের ভেতরে একটা ফিল্টার থাকে। পারলে প্রতিদিন নাহয় দু-চার দিন পর পর ব্রাশ দিয়ে এটি পরিষ্কার করে নিতে হয়। আর মেশিনের নিজস্ব ক্লিন অপশন থাকে, সেটা প্রেস করলে মেশিন নিজেই পষ্কিার করে নেয়।

এছাড়া মেশিনের হার্ড পার্ট গুলা একটু ন্যাকড়া দিয়ে মুছে নিলে সুন্দর লাগে। সেমি অটো মেশিনগুলোতে নিজের হাতে ভেতর বাহির ধুতে হয়। চাইলে টিউটোরিয়াল দেখে নিতে পারেন ইউটিউবে। অথবা মেশিনের সাথে থাকা ম্যানুয়াল পড়ে নিন।

বিদ্যুৎ বিল কেমন আসে

বিদ্যুৎ বিল খুব কম আসে। প্রতিদিন ৩০-৪০ মিনিট করে চালালেও বিল খুব কম আসে; ৪০-৫০ টাকা মাসে। খুব বেশি হলে ৮০-১০০ টাকা। আর যারা প্রতিদিন ব্যবহার করেনা তাদের বিল আরও কম আসবে।

মেশিনে বাচ্চাদের কাঁথা ধোয়া

ওয়াশিং মেশিনে হিসু, পটি, রক্ত , সব নাপাক কাপড়ই নিয়ম মত ধুলে পাক-সাফ হয়ে যায়। নিচে এই নিয়মগুলো উল্লেখ করা হলোঃ

  • হিসুর কাঁথা বা কাপড় সরাসরি মেশিনে দিয়ে দিলেই পরিষ্কার হয়ে যায়।
  • যেসব শিশুরা শুধু বুকের দুধ খায়, তাদের পটির কাপড় সরাসরি মেশিনে দেওয়া যায়।
  • যারা মোটামুটি বুকের দুধ ছাড়া কৌটার দুধ বা খিচুড়ি খাওয়া শুরু করেছে তাদের ক্ষেত্রে পটিটা সরিয়ে নিতে হয়। তবে, সবক্ষেত্রেই ময়লাটা ফেলে দেয়া ভালো। যেমন, কাঁথা থেকে পেপার বা টিস্যু দিয়ে ময়লাটি সরিয়ে ফেলে ভেজা কাপড় বা ভেজা টিস্যু দিয়ে একটু মুছে নিয়ে কাপড়টা মেশিনে দিয়ে দিয়ে দিন।
  • ওয়াশেবল ডায়পার ব্যাবহার করলে যদি কাপড় বা প্যাডে পটি লাগে তাহলে কখনো পটি সরিয়ে বা কখনো প্যাড বেসিনে একটু হাল্কা ধুয়ে মেশিনে দিয়ে দিলেই হবে। এভাবে ধোয়ার পরে গন্ধ বা দাগ কিছুই থাকে না।
  • অনেকে বলেন, বাচ্চার কাপড় আগে বাথরুমে ধুয়ে পরে মেশিনে দেন। বাথরুমে নিজের হাতেই যদি ধুতে হয় তাহলে আর মেশিন কেন? নিজের উপর বাড়তি বোঝা চাপানোর দরকার নেই।
  • কাপড় বেশি থাকলে হিসু পটির কাপড়গুলো আগে এক ধোয়া দিয়ে পানি ফেলে তারপর বাকি কাপড় একসাথে দিয়ে ধুয়ে নিতে পারেন।
  • কোন একদিন সময় করে একসাথে ভালো কাপড়গুলো যেমন গামছা, হিজাব, বোরখা, জায়নামায, ইত্যাদি ধুয়ে ফেললে ভালো হবে।
  • কাপড় ধোয়ার সময় বা শেষের দিকে একটু পারফিউম দিয়ে দিলে সুন্দর গন্ধ আসে। কাপড়ের জন্য আলাদা পারফিউম পাওয়া যায়।

আশা করি লেখাটা পড়ে অনেক দ্বিধা দূর হবে পাঠকের। আরও জানার জন্য মেশিনের সাথে দেয়া ম্যানুয়াল পড়ে দেখুন। ইউটিউব বা গুগলে সার্চও করতে পারেন এবং মন্তব্যের ঘরে লিখতে পারেন।

সম্পাদনাঃ সামিহা নাবিলা, মোহাম্মাদ নেজাম উদ্দীন