গর্ভাবস্থায় অনেক হবু মায়েরই হাত ও আঙ্গুলে শিরশিরে, অবশ ভাব ও মাঝে মাঝে ব্যাথা হয়। এটি গর্ভাবস্থার খুব সাধারন একটি অসুখ, যার নাম কারপাল টানেল সিন্ড্রোম/ Carpal Tunnel Syndrome যা সংক্ষেপে CTS নামে পরিচিত।
কারপাল টানেল কী?
আমাদের হাতের কব্জিতে কারপাল টানেল অবস্থিত যা ছোট আকারের হাড় ও একগুচ্ছ মজবুত টিস্যুর বন্ধনী দিয়ে গঠিত। এই টানেলের মাঝে দিয়ে মধ্য স্নায়ু, বেশ কয়েকটি রক্তনালী এবং টেনডন রয়েছে। এগুলো সম্মিলিতভাবে হাতের অনুভূতি ও নড়াচড়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। যেহেতু অল্প জায়গায় সবগুলো অবস্থান করে, তাই বেশি কাজ করার সময় এখানের নরম স্নায়ুর উপর চাপ পরে এবং এটা থেকে কারপাল টানেল সিন্ড্রোম দেখা দেয়।
প্রেগ্নেন্সিতে কারপাল টানেল সিন্ড্রোম
শরীরের মেডিয়েন নার্ভ (median nerve) বাহু, কব্জি ও হাতে মটর ফাংশনের জন্য দায়ী। এছাড়া এই নার্ভ হাতের তালু থেকে মস্তিষ্কে বিভিন্ন রকমের অনুভূতির তথ্য পাঠায়, যেমন স্পর্শ, গরম ঠান্ডার বোধ ও ব্যথা ইত্যাদি।
গর্ভাবস্থায় শরীরে জমা হওয়া অতিরিক্ত তরলের কিছু অংশ হাতের টিস্যুতে জমা হলে হাত ফুলে যায়, যেটা Oedema নামে পরিচিত। এই তরলের কিছু অংশ যদি কারপাল টানেলে জমার মাধ্যমে মেডিয়েন নার্ভে চাপ তৈরি করে। চাপের ফলে নার্ভ সংকুচিত হয় ও হাত / আঙ্গুলে শিরশিরে, অবশ বা ব্যাথার অনুভূতি তৈরি হয়।
২০১৫ সালের একটি স্টাডি অনুসারে, সাধারন জনসংখ্যার মাত্র ৪ শতাংশের মাঝে কারপাল টানেল সিন্ড্রোম দেখা যায়, কিন্তু গর্ভবতী মায়েদের মাঝে ৩১- ৬২ শতাংশ নারীর এই সিন্ড্রোম হতে দেখা যায়।
লক্ষণ
নিচের লক্ষণগুলো দেখে কারপাল টানেল সিন্ড্রোম কি না যাচাই করতে পারেন
১। আঙ্গুল, হাত ও কব্জিতে অবশ ও শিরশিরে ভাব দেখা দেয়, হালকা থেকে তীব্র ব্যাথা হতে পারে
২। আঙ্গুল, কবজি বা হাতে ব্যথা হওয়া বা দপদপ করার অনুভূতি সৃষ্টি হয়।
৩। আঙ্গুলগুলো ফুলে যেতে পারে ও উত্তপ্ত মনে হতে পারে।
৪। হাতে ও আঙুলে সুই বা পিন ফোটানোর মতন অনুভূতি হতে পারে।
৫। কোন জিনিস শক্ত ভাবে ধরতে এবং আঙ্গুলের সাহায্যে করতে হয় যেসব কাজ সেসব করতে বেশ অসুবিধা হতে পারে।
এক হাত বা দুই হাতেই দেখা যেতে পারে। রাতে এবং সকালে ঘুম থেকে উঠার পরে লক্ষণগুলো সবচে খারাপ রুপ নেয়। প্রেগ্নেন্সির সময়কালের সাথে সাথে এই লক্ষণগুলো বাড়তে পারে।
প্রতিকার
কী কী উপায়ে লক্ষণগুলো উপশম/ কমিয়ে আনা যেতে পারে-
- বিশ্রাম নেয়া-অতিরিক্ত কাজ করা থেকে এসময় বিরত থাকতে হবে, বিশেষত যেসব কাজে হাতের ব্যাবহার বেশি হয়।
- স্প্লিন্ট বাঁধা- হাতে স্প্লিন্ট বাঁধা যেতে পারে যেন হাতের কবজি নড়াচড়া না করে। বিশেষ করে রাতে ঘুমের সময় স্প্লিনট বেঁধে ঘুমালে সুবিধা হয়।
- ঠাণ্ডা ও গরম সেঁক দেয়া- হাতের কব্জিতে ঠাণ্ডা ও গরম সেঁক নিলে বেশ আরাম হয়। চাইলে একসাথেই দুইরকম সেঁক নেয়া যায়। একবার ঠাণ্ডা ও একবার গরম- এভাবেও নেয়া যায়।
- মাসাজ করা- হাতের কব্জিতে মাসাজ করলে এক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যাবে।
- থেরাপি নেয়া- প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শে ফিজিক্যাল থেরাপি নিতে হতে পারে।
- ব্যাথানাশক গ্রহণ করা- খুব বেশি ব্যাথা বা অসুবিধায় ব্যাথানাশক গ্রহণ করা প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
সহায়ক ব্যয়াম
এই সিন্ড্রোম উপশমের জন্য ব্যায়াম খুব উপকারী বলে বিবেচিত। উপরে বর্ণিত কাজগুলোর পাশাপাশি কিছু ব্যায়াম করলে এক্ষেত্রে বেশ আরাম পাওয়া যায়। তবে খেয়াল রাখতে হবে, ব্য্যায়াম করলে যদি ব্যাথা বা অসুবিধা বেড়ে যায়, তবে ব্যায়াম করা বাদ দিতে হবে।
ব্যায়ামের ধাপগুলো এরকম
১। হাতের কবজি সামনে পেছনে বাঁকানো। এটা ১০ মিনিট ধরে করা যেতে পারে।
২। হাতের আঙুলগুলো যতদূর সম্ভব প্রসারিত করতে হবে, সেই অবস্থাতেই কয়েক সেকেন্ড থাকতে হবে। এরপর স্বাভাবিক অবস্থায় যেতে হবে। এভাবে কিছুক্ষণ করা যেতে পারে।
৩। হাত মুঠ করে আবার আঙ্গুল সোজা করা- এই পদ্ধতিতে ১০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে।
৪। হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে প্রতিটা আঙ্গুল স্পর্শ করতে হবে।
৫। ঘড়ির কাঁটার দিকে এবং এর বিপরীত দিকে হাতের কবজি উপর থেকে নীচে বৃত্তাকারে ঘোরানো বেশ ভালো একটি ব্যায়াম।
এই ব্যায়ামগুল আরও ভালোভাবে দেখতে নীচের লিঙ্কের ভিডিওটি দেখুন-
কারা বেশি আক্রান্ত হন?
গর্ভবতী নারীদের মাঝে-
- প্রেগন্যান্ট হবার আগেই যাদের অতিরিক্ত ওজন রয়েছে
- প্রেগ্নেন্সিতে যাদের জেস্টেশনাল ডায়বেটিস ও জেস্টেশনাল হাইপারটেন্সন আছে,
তাদের কারপাল টানেল সিন্ড্রোম হবার ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। তাই এই ব্যাপারগুলোতে সচেতন থাকা উচিত।
কারপাল টানেল সিনড্রোম আক্রান্ত মায়ের জন্য ব্রেস্টফীডিং টিপস
বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় বাচ্চাকে ধরে রাখার জন্য হাতের কব্জি ব্যবহার করতে হয়, যেটা আক্রান্ত মায়ের জন্য কষ্টকর হতে পারে। তাই মা নিজেই খুঁজে বের করবেন কিভাবে বাচ্চাকে ধরলে তার কষ্ট কম হচ্ছে।
- বাচ্চাকে পেচিয়ে ধরতে হাতের কব্জি ব্যবহার করছেন? বিকল্প কোন কিছু ব্যবহার করুন, যেমন সাপোর্ট পিলো বা ব্রেস্টফীডিং বালিশ
- চাইলে শুয়ে থেকেও আরাম করে দুধ খাওয়ানো যেতে পারে, তবে হাতের কব্জিতে চাপ পরে কি না সচেতন থাকুন
- ফুটবল ধরার ভঙ্গিতে (Football hold) খাওয়াতে পারেন, এই পজিশনে বাচ্চার মাথা আপনার হাতে থাকে এবং এর নিচে বালিশ বা কম্বল দিয়ে সাপোর্ট দিন। এছাড়া আপনি আারামদায়ক ভাবে হেলান দিয়ে বসুন।
আপনি পাশ ফিরে শোয়া অবস্থায় বাচ্চা আপনার দিকে মুখ ফেরান ভঙ্গীতে থাকা আপনার জন্য ভালো কাজ করতে পারে। “ফুটবল ধরা” ভঙ্গী আপনার কব্জির জন্য সহজ হবে কারণ এই ভঙ্গীতে আপনি সোজা হয়ে বসেন এবং আপনার বাচ্চাকে বাহুর এক পাশে রেখে তার মাথা আপনার কবন্ধের কাছে রাখেন।
বাচ্চা হওয়ার পর কতদিন এই সমস্যা থাকতে পারে?
সাধারণত, বাচ্চা হবার কয়েকদিন পর থেকেই এটি উপশম হতে শুরু করে। তবে বাচ্চা হবার পরেও আরও কিছুদিন এটা চলতে পারে, ক্ষেত্রবিশেষে এক থেকে দুই মাসও লাগতে পারে। ব্যক্তি বিশেষে এই সিন্ড্রোমের উপশমে সময় লাগে।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত
প্রেগ্নেন্সির যে পর্যায়ে আপনার হাতে এই সমস্যা দেখা দেবে, তখুনি চেক আপের সময় ডাক্তারের সাথে আলাপ করে নেয়া ভালো। তবে শুরুর দিকে যদি খুব বেশি সমস্যা না হয়, তবে এটি নিয়ে অতো চিন্তার কিছু নেই।
কিন্তু যদি ব্যাথা বা লক্ষণগুলো খুব তীব্র আকার ধারণ করে এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার অনেক দিন পরেও এটি পুরোপুরি ঠিক না হয়, তবে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।
কারপাল টানেল সিন্ড্রোমে মেডিক্যাল চিকিৎসা কি বাধ্যতামূলক?
প্রাথমিকভাবে যদি অল্প ব্যাথা বা কম লক্ষণ থাকে, তবে উপরে উল্লেখিত নিয়ম পালন করলেই উপকার পাওয়া যাবে আশা করি। সেক্ষেত্রে মেডিক্যাল সহায়তার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু যদি লক্ষণগুলো খুব যন্ত্রনাদায়ক হয়, তবে অবশ্যই ঔষধ/ থেরাপি দরকার হতে পারে।
যদি এই সিন্ড্রোম দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে তবে অপারেশনের কথা বিবেচনা করা হয়।
শেষ কথা
কারপাল টনেল সিন্ড্রোম প্রেগ্নেসিতে খুব সাধারন সমস্যা । তাই এটি নিয়ে ভয় পাবার কিছু নেই। বরং উল্লেখিত নিয়ম মানা ও ডাক্তারের পরামর্শমতো কাজ করাটাই এই সিন্ড্রোমের উপশমে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
তথ্যসূত্র
- Pregnancy- Carpal Tunnel Syndrome
- What Causes Carpal Tunnel Syndrome During Pregnancy and How’s it Treated?
- Open Carpal Tunnel Surgery
- Healthwise
সম্পাদনা: মো: নেজাম উদ্দীন