গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের শরীরে নানা ধরনের অসুস্থতা দেখা দেয়। এরমধ্যে বমিভাব, পা ব্যথা , পা ঝিনঝিন করা , গ্যাসের সমস্যা, নাক ডাকা অন্যতম। আর মায়ের যদি আগে থেকেই ঘুমের সমস্যা থেকে থাকে তবে গর্ভাবস্থায় তা আরো বেশি বেড়ে যায়।

এখানে বেশ কিছু করণীয় নিয়ে আমরা আলোচনা করবো, যা গর্ভাবস্থায় এবং তার পরবর্তী সময়ে আরামদায়ক ঘুমের জন্য সাহায্য করবে।

কী খাচ্ছেন আর কখন খাচ্ছেন খেয়াল রাখুন

১. ক্যাফেইন জাতীয় খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকা-

এই সময় ক্যাফেইন জাতীয় খাবার, যেমন: চা-কফি, সোডা এবং চকলেট ইত্যাদি খাবার একেবারে বাদ দেওয়া উচিত। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর একেবারে খাওয়া উচিত নয়।

২. সন্ধ্যা ও তারপর পানীয় খাওয়া

সকালের দিকে বেশি পরিমাণে পানি জাতীয় খাবার খাওয়া ভালো। সন্ধ্যার পর থেকে তরল জাতীয় তুলনামূলক কম খাওয়া যেতে পারে। এতে করে মাঝরাতে বারবার ঘুম ভেঙে বাথরুমে যাবার মতো পরিস্থিতি এড়ানো যায়।

৩. ঘুমানোর আগে ভারী ও মসলাজাতীয় খাবার না খাওয়া-

মসলা , ঝাল জাতীয় খাবার খেলে গলা জ্বলা, গ্যাসের সমস্যা ইত্যাদি বেড়ে যেতে পারে। অনুরূপভাবে একদম ঘুমানোর আগে ভারী খাবার গ্রহণ করলেও একই সমস্যা হতে পারে।

যদি বুকজ্বলা সমস্যা থাকে, তবে হালকা খাবার ঘুমের বেশ আগে খাওয়া উচিত। ঘুমের দু-তিন ঘণ্টা আগে খাবার খেলে সেগুলো হজম হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়।

৪. মর্নিং সিকনেস এড়াতে চাইলে ঘুমের আগে হালকা খাদ্য গ্রহণ করা যায়-

অনেকের সকালে ঘুম থেকে উঠলে বমি হয় , শরীর দুর্বল থাকে, মাথা ঘোরায়। কেননা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওই সময় পেট খালি থাকে। তাই ঘুমানোর আগে হালকা দুধ বিস্কুট জাতীয় খাবার খেয়ে নেওয়া যেতে পারে।

কিভাবে প্রশান্তচিত্তে থাকা যায়

১. অল্প অল্প ঘুম

দিনে যদি ৩০ থেকে ৬০ মিনিটের একটি ছোটখাটো ঘুম (ইংরেজিতে পাওয়ার ন্যাপ নামে পরিচিত) গর্ভবতী মাকে সতেজ রাখে, দুর্বলতা কমিয়ে দেয় এবং স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। দিনের বেলা ঘুমের পরিমাণ সামান্য হওয়াই ভালো। নতুবা এটি রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবে।

২. দেরিতে ব্যায়াম না করা

সাধারণত দিনের বেলাতে ব্যায়াম করা ভালো, যা শরীরে আরামদায় শৈথিল্য আনতে সহায়তা করে। ব্যায়াম করে বেশি ক্লান্ত হয়ে গেলে এটি ঘুমের চক্রে (Sleeping cycle) প্রভাব ফেলতে পারে। রাতের ঘুমের তিন থেকে চার ঘণ্টা আগে সব ধরনের ব্যায়াম করে ফেলা উচিত।

৩. অকারণ দুশ্চিন্তা না করা

বিছানার পাশে কাগজ ও কলম রেখে দেওয়া যায় যাতে যখন কোন বিষয় নিয়ে চিন্তা আসে তা চট করে লিখে ফেলা যায়। যেমন আগামীকাল কি নাস্তা বানাবো, রান্নার মেনু কি হবে, বাচ্চাদের স্কুলে কখন নিয়ে যেতে হবে ইত্যাদি।

যদি মনে হয় লিখে রাখলে দুশ্চিন্তা আরো বেশী হচ্ছে সে ক্ষেত্রে এই লিস্ট ঘুমের একঘন্টা আগে লিখে শেষ করতে হবে। 

এইভাবে লিখে রাখার ফলে আমাদের মন ভারমুক্ত হয়, কারণ আমাদের চিন্তা একটুকরো কাগজে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। এছাড়াও এটা একজন মা’কে তার সম্ভাব্য কাজের সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়। এতে মা বুঝতে পারেন কোন কিছু বাদ পড়লো কি না। 

লেখার পর সকাল পর্যন্ত এসব চিন্তা একেবারেই মনে আর আনা যাবে না।

৪. কোন ক্লাসে জয়েন করা

গর্ভবতী মা তার ডেলিভারি, লেবার পেইন, ব্রেস্টফিডিং, বাচ্চার যত্ন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তিত থাকে। এসব বিষয়ে জানার জন্য এখন প্রচুর অপশন অনলাইন এবং অফলাইন এ পাওয়া যায়। তাই কোন ধরনের ক্লাসে যদি যোগদান করা যায় তবে সেক্ষেত্রে কোন আরো গর্ভবতী মায়েদের সাথে একসাথে অন্তর্ভুক্ত হলে নানা ধরনের দুশ্চিন্তা খুব সহজে দূর হয়ে যায়।

আপনার হাতের নাগালে এধরনের কোন ক্লাসে যোগদানের সুযোগ না থাকলে সদ্য মা হওয়া পরিচিত কারো সাথে নিয়মিত ফোনে কথা বলুন।

এছাড়াও ফেসবুকে মাতৃত্ব গ্রুপ (শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য) অথবা মাতৃত্ব টেলিগ্রাম গ্রুপে (উন্মুক্ত) যোগ দিতে পারেন। 

৫. ইয়োগা করা

শরীরের শিথিলায়ন (Relaxation) এ ইয়োগার কার্যকারিতা প্রমাণিত। এতে শরীরের মাংশপেশি নমনীয় হয়। গর্ভকালীন সময়ে সম্ভবা মায়ের জন্য উপযোগী ও উপকারি ইয়োগা নিয়ে বর্তমানে ইন্টারনেটে অনেক অনেক লেখা এবং ভিডিও পাওয়া যায়। নিয়ম করে প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ মিনিট ইয়োগা করার জন্য নিজেকে সময় দিন, এতে সহজে ঘুম চলে আসবে।

৬. শরীর মালিশ (Body Massage)

বডি ম্যাসাজ করলে শরীরের ক্লান্তি ভাব সহজে দূর হয়। এক্ষেত্রে প্রফেশনাল থেরাপিস্টের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং বিশেষভাবে গর্ভবতী মায়েদের নিয়ে কাজ করেন (উপযুক্ত টেবিল এবং বালিশ ব্যবহার করেন) এমন থেরাপিস্টের কাছে সেবা নিতে পারেন।

তবে বাসার বাহিরে কারো কাছে যাওয়ার পরিবর্তে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেও ম্যাসাজ থেরাপি নেওয়া যায়। ঘুমের আগে হাত পা ইত্যাদি জায়গাতে হালকা হাতে যদি স্বামী বা অন্য কোন সদস্য মেসেজ করে দেয় তবে ঘুম বেশ ভালো হবে।

৭. গভীরভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নেয়

ধীরে ধীরে ছন্দে ছন্দে শ্বাস নিলে এবং ফেললে তার শরীরে মাংসপেশিকে রিল্যাক্স করে এবং হার্ট রেট কমিয়ে সহজে ঘুম নিয়ে আসে।

এজন্য বিছানায় বা কার্পেটে দুই পা ছড়িয়ে বসা যায়। যদি তা গর্ভের দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টারে হয়, তবে যেকোনো একদিকে করে বসে অন্যপাশে পিঠের নিচে বালিশ দেওয়া যায় অথবা দুপায়ের মাঝে সাপোর্টের জন্য বালিশ দেওয়া যায়।

এবার মুখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে নাক দিয়ে শ্বাস নিতে হবে। এতে করে আস্তে আস্তে বুক উঁচু হবে কেননা শ্বাস নেয়ার মাধ্যমে ফুসফুসের ভেতরে বাতাস দিয়ে ভরে ফেলছেন। কয়েক সেকেন্ড এভাবে থেকে আস্তে আস্তে নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়তে হবে ১ থেকে ৪ গুনতে গুনতে। এভাবে আস্তে আস্তে একবার ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিতে হবে, আবার ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়তে হবে। এতে শরীরে বেশ আরাম বোধ হবে।

৮. ক্রমাগতভাবে মাংসপেশিকে শিথিল করা।

হাত বা পায়ের বাহু, কাধ, পিঠ বা পায়ের সংকুচিত মাংশপেশি গুলোকে যদি আস্তে আস্তে শিথিল করা যায়, তবে তা শরীরকে বেশ আরাম দেয়। এজন্য বিছানায় শুয়ে যেকোনো একটা পেশির দিকে ফোকাস করে ডান এবং বাম দিকে নড়তে হবে। সংকোচন এবং প্রসারণ এর মাধ্যমে পেশিগুলোকে নমনীয় করতে হবে। 

৯. ভালো কিছু কল্পনা করা

সুন্দর কোন কিছুর ভাবনা যেমন যেকোনো একটা আকাঙ্ক্ষিত বা পছন্দের জায়গাতে ঘুরে বেড়ানো, ভালবাসার মানুষের সাথে প্রথম দেখার স্মৃতি – এরকম কল্পনা আমাদের দুশ্চিন্তা দূর করে এবং সহজে ঘুম নিয়ে আসতে পারে। 

এধরনের ভাল ভাবনা নিয়ে আসার জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরি করার জন্য বেডরুমে ফুল রাখা যেতে পারে, হালকা মিউজিক বা কুরআনের সূরা শোনা যেতে পারে। এরপর পছন্দ মত কোন একটা জায়গা কল্পনা করা যায়, যেখানে যেতে ইচ্ছে করে বা যেতে পারলে মন খুশি হবে, প্রশান্তি আসবে।

১০. সঠিক বালিশ ব্যবহার

গর্ভাবস্থায় ইচ্ছামত আরাম করে ঘুমানো যায় না। শরীর বেশ ভারী হয়ে যায়, নড়াচড়া করতে কষ্ট হয়।সে ক্ষেত্রে যদি বেশ কিছু সাপোর্ট বালিশ ব্যবহার করা যায় , যেমন দুপায়ের মাঝে, পিঠের নিচে, কাঁধের কাছে যদি অতিরিক্ত কয়েকটা বালিশ সাপোর্ট হিসেবে ব্যবহার করা যায় তবে ঘুমটা কিছুটা আরামদায়ক হবে। যদি বুক জ্বালা সমস্যা থাকে তবে মাথা উঁচু করার জন্য এক্সট্রা বালিশ ব্যবহার করতে পারলে বেশ আরাম পাওয়া যায়।

বিভিন্ন অনলাইন শপে অথবা বড় বড় সুপারশপ গুলোতে গর্ভকালীন আরামদায়ক ঘুমের জন্য প্রেগনেন্সি পিলো পাওয়া যায়। 

ভালো ঘুমের অভ্যাস বা নিয়মাবলী

১. ঘুমের চক্র মেনে ঘুমানো

ঘুমের জন্য একটা নির্ধারিত সিডিউল বানালে তা মেনে চলার চেষ্টা করা যায়। কখন ঘুমাতে যাব এবং কখন ঘুম থেকে উঠবো- এভাবে পরিকল্পনা করে রাখলে তা মানার চেষ্টা করা যায়। এজন্য ঘুমের সময় কিছু আগে যদি হালকা কুসুম গরম পানি দিয়ে একটা গোসল দেওয়া যায় তবে সেটা বেশ প্রশান্তিদায়ক হবে।

শিডিউল মেনে ঘুমাতে যাওয়ার পর ঘুম না আসলেও বিছানা ছেড়ে না দেয়া অথবা মোবাইল ফোন ব্যবহার না করা উত্তম। 

২. বেডরুমকে ঘুম-উদ্যানে পরিণত করা

গর্ভবতী মায়েদের শারীরিক অশান্তি/অস্বস্থি বেশি থাকে। তখন তাদের রুমগুলোতে যদি আরামদায়কভাবে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত করা যায় তবে ঘুমটা বেশ গভীর হতে পারে। 

এজন্য রুমটা কোলাহল মুক্ত হতে হবে। ঘুমের আগে প্রধান আলো নিভিয়ে হালকা ডিমলাইট জ্বালাতে পারেন। জানালা খোলা থাকবে, যাতে ঠান্ডা বাতাস আসা-যাওয়া করতে পারে অথবা এসির বন্দোবস্ত থাকতে পারে। মোটকথা রুমে আসলে ঘুমাতে মন চাইবে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

৩. শুধু রাত্রে ঘুম এবং অন্তরঙ্গ মুহূর্ত উপভোগের জন্য বিছানা

বিছানায় শুয়ে টিভি দেখা, গল্প করা, ফোনে কথা বলা ইত্যাদি অভ্যাস থাকলে এগুলো বাদ দেওয়া উচিত। বিছানাটি হতে হবে শুধুমাত্র ঘুম , শুয়ে বই পড়া বা অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর জন্য।

৪. নিজের নির্ধারিত স্থানে ঘুমানো

একই জায়গায় যদি ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তোলা যায় এবং একই ভঙ্গিতে, তবে সেটা শরীরের জন্য ভালো হবে। এই পজিশন রক্ত এবং পুষ্টি চলাচলে ভালো ভূমিকা পালন করবে যা জরায়ু এবং বাচ্চার জন্য ভালো হবে। গর্ভাবস্থায় শুরু থেকে নির্দিষ্ট পজিশনে ঘুমানোর অভ্যাস হয়ে গেলে পরে যখন পেট ভারী হয়ে যাবে তখন কষ্ট কম হবে।

যদি কোন ভাবেই ঘুম না আসে

১. বিছানা ছেড়ে দেয়া

বিছানায় শোয়ার ৩০ মিনিট পরেও যদি ঘুম না আসে তবে বিছানা থেকে উঠে অন্য রুমে চলে যেতে হবে। হালকা হাঁটাহাঁটি করা যায় বা বই পড়া অথবা মিউজিক শোনা যেতে পারে। এরপর যখন ঘুম আসবে তখন সাথে সাথে বিছানায় যেতে হবে।

২. দুশ্চিন্তা না করা

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে চিন্তা করার কিছু নাই। গর্ভাবস্থায় এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয় যে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়।

গর্ভাবস্থায় ঘুমের ওষুধ খাওয়া যাবে?

সাধারণত যেকোনো ধরনের ওষুধ গর্ভাবস্থায় এড়িয়ে যাওয়া উচিত। যেহেতু এই ড্রাগস গুলো কোন গর্ভবতী মায়ের উপর টেস্ট করা হয় না, তাই ড্রাগস গুলো গর্ভবতী মা বা তার বাচ্চার উপর কেমন প্রভাব ফেলবে এটা বোঝা যায় না ।

যদি মায়েদের মারাত্মক রকম ঘুমের সমস্যা থাকে সে ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দ্বিতীয় বা তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে ওষুধ নেয়া যেতে পারে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে এই সময় ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোন ওষুধ ব্যবহার করা যাবে না, এমনকি হোমিও বা হারবাল ওষুধও গ্রহণ করা উচিত হবে না।

সূত্র

The Basics of good sleep during pregnancy By Karen Miles

ছবি কৃতজ্ঞতা: ফ্রীপিক

লেখাটি রিভিউ করেছেন –

ডাঃ মাশরুরা মাহজাবিন
MBBS
General Practioner, Trained Mental health counselor

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা