গর্ভাবস্থায় বমিবমি ভাব এবং বমি হওয়াকে আমরা মর্নিং সিকনেস নামে জানি। গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে এটা খুবই সাধারণ ঘটনা। খুব কম গর্ভবতী নারী মর্নিং সিকনেস ছাড়া প্রেগনেন্সি পার করেন। সাধারণত প্রতি ১০ জনে ৮জন নারী এই সিকনেসে ভুগেন।
এটা এমন একটা অনুভূতি ও শারীরিক অবস্থা যেটা দিনে বা রাতের যেকোনো সময় আপনার হতে পারে। এমনকি আপনি পুরোটা দিন অসুস্থতার বোধ নিয়ে কাটাতে পারেন। খুব স্বাভাবিকভাবে এইধরনের শারীরিক অবস্থা অপ্রীতিকর এবং এটা একজন সম্ভবা নারীর দৈনন্দিন জীবনকে উল্লেখযোগ্যভাবে বদলে দেয়। স্বস্থির খবর হলো, সাধারণভাবে মর্নিং সিকনেস গর্ভাবস্থার ১৬ থেকে ২০ সপ্তাহের মাঝে ঠিক হয়ে যায়। এবং এই ঠিক হয়ে যাওয়া গর্ভে বাচ্চার সুস্থ থাকার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
কখনও কখনও প্রস্রাবের সংক্রমণ বা Urinary Tract Infection (UTI) এর কারণে বমি বমি ভাব এবং বমি হতে পারে। প্রস্রাবের সংক্রমণ সাধারণত মূত্রাশয়কে বা ব্লাডারকে ক্ষতিগ্রস্থ করে এবং এটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে কিডনি পর্যন্ত পৌছে যেতে পারে।
বিষয়সূচী
মর্নিং সিকনেস নিয়ে কখন চিন্তিত হবেন?
নিচের লক্ষণগুলো মিলিয়ে নিনঃ
আপনি বমি করছেন এবং
– খুব গাঢ় রঙের প্রস্রাব হচ্ছে বা বিগত ৮ ঘন্টার বেশি সময় ধরে প্রস্রাব করেননি।
– বিগত ২৪ ঘন্টার মাঝে পেটে কোন খাবার বা তরল রাখতে পারছেন না
– খুবই দুর্বল বোধ করছেন, মাথা ভনভন করে ঘুরছে এবং দাঁড়ানোর সময় গুরুতরভাবে জ্ঞান হারাচ্ছেন
– তলপেটে ব্যথা
– উচ্চমাত্রার জ্বর
– রক্ত বমি করা
– ওজন কমে যাওয়া
এরকম পরিস্থিতিতে অবশ্যই একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে চিকিৎসা নিবেন। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে রোগীকে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে যাবেন।
মর্নিং সিকনেস চিকিৎসা কী?
দুর্ভাগ্যবশত, এই বমিভাব বা বমির এমন কোন দ্রুত চিকিৎসা নেই যেটা সবার জন্য কাজ করবে। প্রতিটি গর্ভাবস্থা আলাদা। এমনকি একই মায়ের একাধিক গর্ভাবস্থার মাঝে মিল থাকে না।
তাই চিকিৎসাবিজ্ঞান চেষ্টা করে মর্নিং সিকনেসের উপসর্গগুলোর মাত্রা সহনীয় অবস্থায় রাখার। এজন্য একজন সম্ভবা নারীর খাদ্য এবং দৈনন্দিন জীবনাচরণে কিছু পরিবর্তন আনতে হয়। মূল লক্ষ্য থাকে এই পরিস্থিতি যাতে ট্রিগার না করে এবং শুরু হয়ে গেলে সেটার মাত্রা কমিয়ে সহনীয় করা।
যদি দৈনিক রুটিন ও জীবনাচরণে অদলবদল খুব একটা কাজ না করে, সেক্ষেত্রে ডাক্তার হয়তো আপনাকে ঔষধের পরামর্শ দিতে পারেন।
আপনি নিজে যা করতে পারেন
যদি আপনার বমিভাব ও বমির মাত্রা খুব বেশি না হয়, তাহলে ডাক্তার বা মিডওয়াইফ প্রথমে আপনাকে কিছু লাইফস্টাইল পরিবর্তন করার পরামর্শ দিবেন:-
– প্রচুর বিশ্রাম নিন, কারণ ক্লান্তি বমিভাব ও মাথা ঘোরানোকে খারাপ দিকে নিয়ে যায়।
– এমন খাবার বা গন্ধ এড়িয়ে চলুন যেটা মর্নিং সিকনেস ট্রিগার করে বা বাড়িয়ে দেয়
– বিছানা থেকে নামার আগে শুকনো টোস্ট বা একটি সাধারণ বিস্কুটের মতো কিছু খান।
– কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ সাধারণ খাবার (ভাত, রুটি, পরোটা, পাস্তা) অল্প করে বারবার খান। চর্বিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন।
– যদি গরম খাবারের গন্ধতে আপনি অস্বস্তি বোধ করেন, তাহলে খাবার একটু ঠান্ডা করে খান।
– প্রচুর পরিমাণে তরল (ডাবের পানি, ফলের রস, শরবত) ও পানি পান করুন। অল্প চুমুক দিয়ে পানি পান বমি ভাব কমাতে সাহায্য করে।
– আদাযুক্ত খাবার বা পানীয় খান। অনেকে বলেন আদা বমি বমি ভাব এবং বমি কমাতে সাহায্য করে। তবে গর্ভাবস্থায় যেকোন রকমের জিঞ্জার সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার আগে ডাক্তার বা মিডওয়াইফের পরামর্শ নিন।
– আকুপ্রেশার অনেকের জন্য বমির উপসর্গ কমাতে সহায়তা করে বলে জানা গেছে।
সতর্কতাঃ গর্ভকালীন ডায়বেটিস থাকলে ফলের রস, শবরত গ্রহণে সতর্কতা প্রয়োজন। ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলুন
প্রতিরোধমূলক ঔষধ
যদি বমি বমি ভাব এবং বমির তীব্রতা বেশি হয়এবং উপরের লাইফস্টাইল পরিবর্তনগুলো খুব একটা কাজে না আসে, তাহলে ডাক্তার স্বল্পমেয়াদী ঔষধের কোর্স করার পরামর্শ দিতে পারেন। সাধারণত একে অ্যান্টিমেটিক বলে। গর্ভাবস্থার জন্য নিরাপদ এমন ঔষধ ডাক্তার দিয়ে থাকেন।
এগুলো এক ধরনের অ্যান্টিহিস্টামিন, যেটা সাধারণত অ্যালার্জির চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয় কিন্তু এগুলো একইসাথে মর্নিং সিকনেসের অবস্থার উত্তরণেও ওষুধ হিসেবেও কাজ করে।
অ্যান্টিমেটিকস সাধারণত ট্যাবলেট হিসাবে দেওয়া হবে যাতে আপনি মুখ দিয়ে খেতে পারেন। অনেকের ক্ষেত্রে অসুস্থতার মাত্রা এত বেশি থাকে যে কোন কিছুই পেটে রাখতে পারেন না। এধরনের পরিস্থিতিতে ডাক্তার ইনজেকশন বা মলদ্বারে দেয়া যায় এমন সাপোজিটরি দেন।
মর্নিং সিকনেস কখন ঝুঁকির কারণ
ধারণা করা হয় গর্ভাবস্থার প্রথম ১২ সপ্তাহে হরমোনের পরিবর্তন মর্নিং সিকনেসের কারণ। কারো কারো জন্য এই অসুস্থতা ঝুঁকির কারণ। নিচের তালিকা দেখুনঃ
– যদি গর্ভে যমজ বাচ্চা বা তার বেশি থাকে
– আগের গর্ভাবস্থায় গুরুতর অসুস্থতা ছিলো বা বমি হয়েছিল
– যদি আপনার মোশন সিকনেস থাকে (যেমন গাড়িতে চড়লে বমিভাব ও মাথা ঘোরানো)।
– যদি আপনার মাইগ্রেনের সমস্যা থাকে
– যদি পরিবারিকভাবে মর্নিং সিকনেস থাকে
– গর্ভনিরোধক কন্ট্রাসেপটিভ নেয়ার সময় ইস্ট্রোজেন সমৃদ্ধ ঔষধে যদি অসুস্থ বোধ করেন
– যদি এটা আপনার প্রথম গর্ভাবস্থা হয়
– যদি আপনি স্থুলতায় ভুগেন, BMI 30 বা তার বেশি হয় (আপনার BMI চেক করুন এখানে)
– আপনি মানসিক চাপ বা স্ট্রেসে আক্রান্ত
মর্নিং সিকনেস যখন অস্বাভাবিক মাত্রায় হয়
অনেক সময় গর্ভবতী নারীর মর্নিং সিকনেস মারাত্মক রূপ ধারণ করে। তিনি পুরোটা দিন অসুস্থ অবস্থায় কাটান, পেটে খাবার বা পানি কোন কিছুই রাখতে পারেন না। এ অবস্থাকে হাইপারমেসিস গ্র্যাভিডারাম বা Hyperemesis Gravidarum (HG) বলে। সাধারণত ১০০ জনে ১ – ৩জনের এরকম হতে পারে।
এরকম অবস্থায় একজন নারী পানি শূণ্যতায় (Dehydration) এ আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে থাকেন। এরকম পরিস্থিতিতে পড়ার আগেই ডাক্তার বা মিডওয়াইফের শরনাপন্ন হোন।
মর্নিং সিকনেস ১৬ থেকে ২০ সপ্তাহের মাঝে চলে গেলেও হাইপারমেসিস গ্র্যাভিডারাম সন্তান প্রসব পর্যন্ত থেকে যেতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে ২০ সপ্তাহের পর অবস্থার উন্নতি হতে পারে।
তথ্যসূত্র
কৃতজ্ঞতাঃ
মাতৃত্ব প্রিনাটাল কোর্সের ছাত্রী আইরিন আক্তার এই লেখায় সহায়তা করেছেন।