তৃতীয় প্রেগনেন্সির কথা তেমন কাউকে বলি নি তাই অনেকে গোসসা করে বসে আছে আমার উপর। নিঃসন্দেহে এটা ছিল আমার সবচেয়ে কঠিন প্রেগনেন্সি জার্নি..ভীষন ভীষন রকমের কঠিন।

গোটা আট মাস দিন রাত বমি করে কূল পেতাম না, পানি খেতেও আতংক লাগত যে এখনি ভেতরকার সব উল্টায়ে বমি হয়ে যাবে। দিন রাত এক করে যখন আমি বমি করছি তখন আমার ডক্টর ফোন করে জানালো আমার ব্লাড রিপোর্ট খুব খারাপ, যতটা খারাপ হলে pregnancy terminate (গর্ভপাত) করা বিবেচ্য ততটাই। পরিচিত ডাক্তাররাও সায় দিলো যে সেটাই বেটার অপশন।

রিপোর্টে এসেছিলো যে আমার ব্লাডে একটা এন্টিবডি পাওয়া গেছে, যার দরুন আমি Kell H positive, যা কিনা আমার ক্ষতি না করলেও বাচ্চার গ্রোথ থামিয়ে দিবে এক পর্যায়ে, বাচ্চার হিমোলিটিক ডিযিস হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে। অর্থাৎ বাচ্চার সারভাইভাল চান্স খুব কম। এই কেল এইচ কিভাবে আমার শরীরে আসলো? ইউসুফ আর খাদিজার জন্মের সময় দেশে আমাকে রক্ত দেয়া হয়েছিল, তার মাঝে যে কোন একটা ট্রান্সফিউশন থেকে। এটা আমার জেনেটিক্সে নেই, শুধুমাত্র ব্লাড ট্রান্সফিউশন থেকে এসেছে। এই কেস ভীষণ রেয়ার, কারন কেল পসিটিভ সাধারণত শুধু জেনেটিকাল কারনে কারো রক্তে বিদ্যমান থাকে।

প্রথম কিছু সপ্তাহ একটা ঘোরের মাঝে ছিলাম, কান্নাকাটি করেছি বিস্তর। দু সপ্তাহ অন্তর অনেকগুলো ব্লাড টেস্ট থাকতো, রিপোর্ট পাওয়ার আগ পর্যন্ত দুয়া করতাম যেন আগের রিপোর্টগুলো ভুল প্রমানিত হয়।একসময় বাম হাতে আর ব্লাড পাওয়া যেতো না, ডান হাতে সূচ ঢুকিয়ে খোচাখুচি করা লাগতো। প্রতিবারই যখন রিপোর্ট চেক করতাম, দেখতাম বড় লাল একটা আশ্চর্যবোধক, যা কিনা হাই রিস্কের চিহ্ন।

দেশে যাওয়ার টিকেট কেটে রেখেছিলাম বেশ কয়েক মাস আগেই। রেগুলার প্রেগনেন্সি হলে ঘুরে আসতে বাধা ছিলো না। But nothing was regular and normal anymore in my life. যেহুতু প্রেগন্যান্সি টার্মিনেট করবো না ডিসিশন নিয়েছিলাম, তাই আমার ডাক্তার দেশে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দিল। ‘তোমাকে সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের মাঝে থাকা লাগবে, সো ইউ কান্ট লীভ দা কান্ট্রি।’

এখানে বলে রাখি, আমার বড় দুইজন আপাতত হোম স্কুলিং করে বলে তারা বেশীরভাগ ব্লাড টেস্ট, ডক্টর এপয়ন্টমেন্টে আমাদের সাথেই যেত। পুরো সিচুয়েশন, আমার প্রচন্ড stress কোনকিছুই তাদের কাছে গোপন ছিল না। ইউসুফ আর খাদিজা দুজনেই ভীষণরকমের বাচ্চা ভালোবাসে। মূলত তৃতীয় বাবুর জন্য ওদের ভীষন আগ্রহের কারনেই সাহস করে অগ্রসর হওয়া।

প্রতিবার ব্লাড রিপোর্ট যখন একই বার্তা বহন করে আসতো তখন আমার সাথে সাথে বাচ্চারাও কাঁদত। একবার ব্লাড টেস্ট করাতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। বাচ্চারা আর তাদের বাবা আমাকে ধরে গাড়িতে নিয়ে আসলো। কতবার এমন দিন গেছে যে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে উবু হয়ে বমি করছি।

এবারে প্রেগনেন্সিতে আট মাসব্যাপী বমির সমস্যা ছিলো, পুরোটা প্রেগনেন্সিতে খেতে পারতাম না। আবু ইউসুফ জোর করে খাওয়াতো, আমি কাঁদতাম খাবারে কোন স্বাদ না পাবার কারনে, বিচ্ছিরি রকমের গ্যাসের সমস্যার কারনে, সব খাবার বমিতে বের হয়ে যাবার কারনে। এই সময়ে বন্ধুরা, আপুরা, আশেপাশের ভাবীরা কি পরিমানে যে খাবার পাঠিয়েছে বা বলার বাহিরে। কিন্তু আমার কাছে তখন খাবার মানেই মূর্তিমান বিভীষিকা। প্রচন্ড ক্ষুধা পেটে, কিন্তু এক কামড় খাবার খেলেই বমি। কতদিন পিত্ত বমি করতে করতে বেসিনের সামনে কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহ্‌কে বলেছি, আল্লাহ আমার পেটে আর কিচ্ছু নাই, আর কি বমি করবো?

আর মানসিক অবস্থার কথা কিভাবে বুঝিয়ে বলি? ডাক্তারদের প্যানেল, মিটিং শেষে আমাকে হাই রিস্ক প্রেগনেন্সির ডাক্তারের কাছে রেফার করা হলো, তার সাথে ফিটাল মেডিসিনের ডাক্তার। ফিটাল মেডিসিনের ডাক্তার বসেন সরকারী হস্পিটালে, সেখানে বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া মানা। ইউসুফ খাদিজাকে কোন বন্ধু বা আপুর বাসায় রেখে যাওয়া লাগতো, আবু ইউসুফের সমস্ত ছুটি ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি করতেই শেষ।

ফিটাল মেডিসিনের ডাক্তারের কাছে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হত নানাবিধ কারনে। আমি ওয়েটিং রুমের কাচের দেয়ালের বাহিরে তাকিয়ে থাকতাম। প্রতিবার স্ক্যান শেষে ডক্টর লরা গম্ভীর মুখে বলতেন, বেবি এখনো ঠিক আছে, তবে মেইন রিস্ক বিশ সপ্তাহের পরে। বেবি এনেমিক হওয়া শুরু করলে তাকে পেটে থাকা অবস্থাতেই ব্লাড ট্রান্সফার করা লাগবে। তবে সে survive করবে কিনা গ্যারান্টি নাই। তুমি যদি বাচ্চা রাখতে চাও, সেটা তোমার সিদ্ধান্ত। আর না রাখতে চাইলেও আমি তোমার পাশে আছি।

আবু ইউসুফকে বললাম, I am not strong enough for this। সে বার বার বলত, Whatever happens, we’ll face it together। প্রচন্ড শীতেও লেকের কাছে গিয়ে বসে থাকতাম, মানসিক অবসাদ একটু হলেও, একটুক্ষণের জন্য হলেও চলে যেত। ক্লাসগুলো নিতাম, আগে পরে বা ক্লাসের মাঝে উঠে বমি করে আসতাম, তবে স্টুডেন্টদের বুঝতে দেইনি নিজের অসুস্থতা, বা মানসিক যন্ত্রনা। যে আমি চুল না বেঁধে থাকতে পারি না, তার চুল বাঁধলেই মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যেতো।

ব্যাচগুলো শেষ করতে হবে, তারপর লম্বা অবসরে যাবো, এই ভাবনা আমাকে চালিয়ে নিতো। কখনো ক্লাস শেষ করে নেতিয়ে পড়ে থাকতাম, ইউসুফ খাদিজাকে ডেকে ডেকে বলতাম এটা সেটা নিয়ে খেতে। আবু ইউসুফ ওদের আর আমার নাস্তা বানিয়ে রেখে যেতো। ফেরত এসে আমাকে খাওয়ায় দিতো। বিকেলের পর খেতে পারতাম না একেবারেই তাই কেউ জোর করে খাওয়ায় না দিলে উপায় ছিলো না।

এভাবে প্রায় ছয় মাস কেটে গেলো। তারপর একদিন হাই রিস্ক ডক্টরস প্যানেল থেকে জানানো হল যে আমার হাযব্যন্ডের ব্লাড যেন টেস্ট করানো হয়। বেশ কয়েক রকমের ঝক্কিঝামেলা পেরিয়ে সেই জেনেটিক টেস্ট করানো হল। তাতে রিপোর্ট আসলো যে তার কোন কেল এইচ এন্টিজেন নেই। What does that mean? আমি ফিটাল মেডিসিনের ডক্টরকে জিজ্ঞেস করলাম। How does that change anything? তখন…তখন জানতে পারলাম যে আমার বাচ্চাটা আসলে কোন রিস্কেই ছিলো না কারন তার বাবার এন্টিজেন নেই আর আমার ব্লাডে যেই এন্টিবডি ট্রান্সফিউশনের মাধ্যমে এসেছে তা বেবি বা আমার ক্ষতি করার কোন ক্ষমতা রাখে না। কি আশ্চর্য, এই জিনিশ আমাকে ছয় মাস পর জানতে হলো!

ডক্টর যখন আমাকে অভিনন্দন জানাতে ব্যস্ত, আমি তখন হতবাক হয়ে ভাবছি যে যদি দু তিন মাস আগে প্রেগনেন্সি কন্টিনিউ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতাম তাহলে কি হতো।
পরে অবশ্য আমার হাই রিস্ক প্রেগনেন্সি স্পেশালিষ্ট তাদের এই গাফিলতির জন্য অসংখ্য বার ক্ষমা চেয়েছে। আমার কেসটা খুব রেয়ার বলে তাদের কিছু নলেজ গ্যাপ ছিলো, তাদের অজানা কিছু ফ্যাক্টর ছিলো এখানে। ভীষণ শারীরিক অসুস্থতার মাঝেও এই ছয় মাস পর..দীর্ঘ ছয় মাস পর আমি মানসিক ট্রমা থেকে নির্ভার হতে পেরেছি।

আমার ডক্টর বার বার বলছিলো, তুমি তোমার বাবা মাকে আসতে বলো। You have been through a lot। তোমার মেন্টাল রিলিফ প্রয়োজন। আমরা তাই করলাম, আব্বু আম্মুর জন্য এপ্লাই করলাম। হাই রিস্ক প্রেগনেন্সির ডক্টর নোট দিয়েছে বিধায় বেশ দ্রুতই তাদের ভিসা গ্র‍্যান্ট হয়ে গেলো। বাকিটা খুব বেশী ইন্টারেস্টিং স্টোরি না। খেতে পারতাম না, তবুও মনে বল ছিলো আলহামদুলিল্লাহ্‌, যে এবার আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন। ফা ইন্না মা’আল উসরি ইউসরা। নিশ্চয়ই কষ্টের পর স্বস্তি আছে।

ইয়াসিরের জন্ম সি সেকশনে হলেও সব কিছু সত্যই বেশ সহজ ছিলো, আলহামদুলিল্লাহ্‌। আমার রিকভারিও বেশ দ্রুত হয়েছে। অপারেশনের কয়েক ঘন্টা পর যখন নিজে হেঁটে হেঁটে বাথরুমে গেলাম, নার্স বলল, You are a superwoman!

প্রায় ত্রিশ ঘন্টা পার না হতেই এক চমৎকার ডক্টর আমাকে রিলিয লেটার দিয়ে দিলো। তিন কেজি দুইশ গ্রামের ইয়াসির আল্লাহ্‌র অশেষ রহমতে সুস্থ, একটিভ বেবি হিসেবে আমাদের কাছে এসেছে after the longest nine months of journey।

‎فَبِأَيِّ آلاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ,
Then which of the favors of your Lord will you deny?

সুরা আর-রাহমান

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা