‘ডিপ্রেশন’ শব্দটির সাথে পরিচিত নয় বা এর সম্মুখীন হয়নি এমন কাউকে বর্তমানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ডিপ্রেশনের খুব কাছাকাছি বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজলে সবার আগে আসবে ‘অবসাদ’ বা ‘বিষণ্নতা’। ডিপ্রেশন আমাদের মনে সবসময় এক ধরনের শূন্যতার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে এবং জীবনকে করে তোলে স্থবির।
সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করলে দেখবো যে, গুরুত্বপূর্ণ মানসিক সমস্যাগুলোর মধ্যে ডিপ্রেশন এখন আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বয়সের ২৬৪ মিলিয়নের বেশি মানুষ বর্তমানে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। বিশেষ করে আমাদের তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ হাতাশা, বিষণ্নতা ও মানসিক অবসাদে সময় পার করে।
ডিপ্রেশনের দীর্ঘস্থায়িত্ব অনেকক্ষেত্রে মানসিক অসুস্থতা হিসেবে বিবেচিত হয়। পরিণামে এর থেকে রেহাই পেতে আমাদের মনোচিকিৎসকের দারস্থ হতে হয়, বিভিন্ন ধরনের কাউন্সেলিং বা পরামর্শ, সাইকোথেরাপি ও এন্টিডিপ্রেসেন্ট (ডিপ্রেশন বিরোধী ওষুধ) গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে যা কিনা ব্যয়বহুল এবং একইসাথে এন্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ সেবনের কিছু মারাত্মক পাশ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে মিলতে পারে এর সহজ ও সর্বোত্তম সমাধান?
শারীরিক ও মানসিক উভয় সুস্থতা বজায় রাখার জন্য সাধারণত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের উপর জোড় দেয়া হয়। ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রেও খাবারের প্রভাব অপরিসীম। আজ আমরা আলোচনা করবো এমন একটি সুন্নাহ খাবার সম্বন্ধে যেটি এন্টিডিপ্রেসেন্ট হিসেবে কাজ করে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। আর সে খাবারটি হচ্ছে “তালবিনা।”
তালবিনা হতাশা, দুঃখ, স্ট্রেসের পরিমাণ হ্রাসে যেমন তৎপর পাশাপাশি হরেক রকম রোগেরও সমাধান। এটি মূলত স্ট্রেস, ডিপ্রেশনের রেমিডি হিসেবে কাজ করে। এটি এমনই এক এন্টিডিপ্রেসেন্ট যেটা খুব বেশি ব্যয়বহুল নয় এবং কোনো পাশ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এটি শোক, দুঃখ-কষ্ট, মন খারাপ, উদাসীনতায় আমাদের অন্তরে এক ধরনের প্রশান্তি প্রদান করে। তাইতো তালবিনা হতে পারে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
অনেকেই হয়তো খাবারটির সাথে পরিচিত নই, ভাবছি “তালবিনা ” আবার কেমন ধরনের খাবার!
যব বা বার্লি, দুধ, মধু ইত্যাদির সহযোগে তৈরিকৃত এক প্রকার তরল খাবার হচ্ছে তালবিনা। যব পিষে, দুধে পাকিয়ে তাতে মধু মেশালেই তৈরি হয়ে যায় তালবিনা।
‘তালবিনা’ আরবি ‘লাবান’ (টকদই) শব্দ থেকে এসেছে কারণ রান্নার পরে এটি -দইয়ের মতো ঘনত্বের হয়, নরম ও দেখতে দইয়ের মতো সাদা। সেজন্য সাদৃশ্য বোঝাতে এর নাম ‘তালবিনা’।
এটি এমনই এক সুপার ফুড যা আমাদের রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবাদের (রাঃ) সময়ে শোক-দুঃখসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ নিরাময়ে খেতে পরামর্শ দেওয়া হতো। এটি আমাদের একটি ভুলে যাওয়া সুন্নাহ তাই অনেকে নাও জেনে থাকতে পারি।
রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর স্ত্রী আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত,
তাঁর পরিবারের কোন ব্যক্তি মারা গেলে মহিলারা এসে জড় হলো। তারপর তাঁর আত্মীয়রা ও বিশেষ ঘনিষ্ঠ মহিলারা ছাড়া বাকী সবাই চলে গেলেন। তিনি ‘তালবিনা’ রান্না করতে বললেন। তা রান্না করা হলো। এরপর ‘সারীদ’ (গোশতের মধ্যে রুটির টুকরো দিয়ে তৈরী খাবার) প্রস্তুত করা হলো এবং তাতে তালবিনা ঢালা হলো। তিনি বললেন, “তোমরা এ থেকে খাও কারণ আমি রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে বলতে শুনেছি যে, ‘তালবিনা’ রুগ্ন ব্যক্তির হৃদয়ে প্রশান্তি আনে এবং শোক দুঃখ কিছুটা দূর করে।”
(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৫৪১৭)
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন,
“অপ্রিয় কিন্তু উপকারী বস্তুটি তোমরা অবশ্যই গ্রহণ করবে। তা হলো তালবিনা অর্থাৎ হাসা (দুধ ও ময়দা সহযোগে প্রস্তুত তরল পথ্য)।” রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসা এর পাতিল চুলার উপর থাকতো, যতক্ষণ না রোগী সুস্থ হতো অথবা মারা যেতো।
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩৪৪৬)
এবারে আসুন দেখি, কি আছে তালবিনাতে?
তালবিনার মূল উপাদান হচ্ছে যব বা বার্লি। সাধারণত এতে থাকে পূর্ণ-দানাদার (whole grain) যব বা বার্লির গুঁড়ো অথবা বার্লির ময়দা, মধু, দুধ। চাইলে খেঁজুর এবং কিছু ড্রাই ফ্রুটস যোগ করা যেতে পারে। আমরা জানি, বার্লি, দুধ, মধু, খেজুর সবগুলোই এক একটি সুন্নাহ খাবার এবং প্রতিটিই নিজস্ব গুনাবলি ও পুষ্টিগুণে ভরপুর।
বার্লিতে রয়েছে দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় উভয় খাদ্যআঁশ (dietary fiber)। এছাড়াও তালবিনাতে থাকে বি-ভিটামিন, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ, জিংক, ফসফরাস, কপার, পটাশিয়াম, ক্রোমিয়াম এবং এন্টিঅক্সিডেন্ট।
তালবিনা খাবার হিসেবে খুবই উপকারী কেননা –
• এতে বিদ্যমান পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের মতো খনিজ উপাদানসমূহের(minerals) উপস্থিতি আমাদের মস্তিষ্কের রাসায়নিক বার্তাবাহক নিউরোট্রান্সমিটারগুলোর উপর প্রভাব ফেলে, যা হতাশা বা ডিপ্রেশনের মতো মানসিক অবস্থা হ্রাসে সহায়তা করে।
এটি শরীরে সেরোটোনিন নামক নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। সেরোটোনিন হচ্ছে একধরনের রাসায়নিক উপাদান যা নার্ভ কোষের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে আমাদের খুশি বা প্রশান্তির অনুভূতি দেয়।
১৪০০ বছর আগে “সেরোটোনিন” নামক কোন রাসায়নিকের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত না হলেও রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঠিক এটিই বলে গিয়েছিলেন, “তোমাদের অপছন্দনীয় হলেও তালবিনা খাওয়া উচিত। এটি অসুস্থ ব্যাক্তির হৃদয়ে প্রশান্তি আনে ও কষ্ট কমিয়ে দেয়।”
এছাড়াও ডিপ্রেশন দূর করার পাশাপাশি খাবার হিসেবে তালবিনার আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা বিদ্যমানঃ
- অন্যান্য খাদ্যশস্যের তুলনায় বার্লিতে বিদ্যমান দ্রবণীয় খাদ্যআঁশের (soluble fiber) মধ্যে বিটা-গ্লুকানের পরিমাণ বেশি থাকে, যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করে।
- এটি ক্রোমিয়ামের একটি ভালো উৎস যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক রাখে।
- এটি অসুস্থ হার্টের জন্য প্রতিষেধকস্বরুপ এবং কোলেস্টরলের মাত্রা কমায়। এতে বিদ্যমান দ্রবণীয় ফাইবার বিশেষত বিটা গ্লুকান আমাদের দেহে বিদ্যমান খারাপ কোলেস্টেরল ও উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সহায়তা করে। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।
- তালবিনা টাইপ -২ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই উপকারী। এতে বিদ্যমান দ্রবণীয় খাদ্যআঁশ এবং ম্যাগনেসিয়াম রক্তে শর্করা এবং ইনসুলিনের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে যা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস করে।
- খাদ্যআঁশ ও অন্যান্য উপকারী উপাদানসমূহের উপস্থিতি কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
- রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখে।
- দ্রবণীয় ফাইবার ক্ষুধা হ্রাস করে এবং পূর্নতার অনুভূতি বাড়ায় যা ওজন হ্রাসে সহায়তা করে।
- উচ্চ ফাইবারসমৃদ্ধ হওয়ায় পিত্তথলির পাথর রোধে ভূমিকা রাখে।
- এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস, যা অস্টিওপোরোসিস (হাড়ের এমন একটা অবস্থা যাতে হাড়গুলি সেগুলোর ঘনত্ব হারায় এবং ভঙ্গুর হতে শুরু করে) থেকে মুক্তি দেয়।
- পেটের জ্বালাপোড়া দূর করে।
- হজমে সহায়তা করে।
- কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
- প্রোস্টেট নালীর প্রদাহ হ্রাস করে।
- কিডনি রোগীদের জন্য উপকারী।
- অসুস্থ, দুর্বল রোগীদের জন্য শক্তিদায়ক পথ্য
- শিশুদের প্রয়োজনীয় আঁশ, আমিষ এবং খনিজ পদার্থ যোগান দেয়।এটি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত শিশুদের জন্য খুবই উপকারী।
- অ্যান্টি-এজিং হরমোন তৈরিতে সহযোগিতা করে।
পাকস্থলী এবং অন্ত্রতে আলসারের রুগীদেরকে সকালের নাস্তায় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- এর সময়ে উন্নত মানের ব্যবস্থাপত্র স্বরূপ তালবিনা প্রদান করা হতো। এতে আলসারের প্রতিটি রুগী ২/৩ মাসের মধ্যে আরোগ্য লাভ করতো। প্রসাবের সাথে রক্ত ও পূঁজ পড়া রুগীদের তা যে কারণেই হোক না কেন উপযুক্ত চিকিৎসার সাথে যবের পানি যদি মধুর সাথে মিশ্রণ করে পান করানো যায় তাহলে এ রোগ পনের দিনের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ। আবার কখনো এ পদ্ধতি পেটের পাথর বের করার জন্যও খুব কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে।
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদীস অনুযায়ী তালবিনার উপকারীতাসমূহ অপরিসীম। ডিপ্রেশন দূরীকরণে ‘তালবিনা’ এখন গবেষণায় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটি খাবারও বটে।
[তালবিনা দিয়ে তৈরি করা যায় এমন কিছু খাবারের রেসিপি নিয়ে আছে আরেকটি পর্ব — নাশীতা ওয়েলনেস]