কেস স্টাডি ৭ঃ উম্ম মারইয়াম

প্রথম প্রশ্নে উল্লেখিত সমস্যাগুলো হয়েছিল তবে স্বামীর সাথে ঝগড়া হয়নি আবার বাচ্চার প্রতিও কোন নেতিবাচক মনোভাব আসেনি। যা এসেছিল তা শ্বশুরবাড়ির লোকের প্রতি।

শ্বশুরবাড়ির লোকের প্রতি পদক্ষেপ নেওয়া সহজ কিছু না। প্রথমবারের মতোন তাঁদের প্রতি অভিযোগ, অপছন্দ উত্থাপন করেছিলাম। এসবের ফলশ্রুতিতে বাবুর বয়স ৫/৬ মাসের মাথায় আলাদা হয়ে যাই যেখানে আমার স্বামী পুরোপুরি সাপোর্ট দিয়েছিল। অবশ্যই ভালো বোধ করেছিলাম।

প্রেগন্যান্সিতে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল। প্রেগন্যান্সিতে যেহেতু অনেক ব্যাপারে সচেতন ছিলাম যেমন গীবত, কথার ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী, পরচর্চা না করা তাই প্রেগন্যান্সি পরবর্তী সময়ে আর এসব নিয়ে কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। তখন নতুন করে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক উন্নত করার মতোন শারীরিক, মানসিক, আত্মিক অবস্থা ছিলো না।

আমার স্বামী জানতেন এই ব্যপারে। ভদ্রলোক এসব ব্যাপারে পড়াশোনা করতেন। আমি নিজেও পড়ার পরে শেয়ার করতে অভ্যস্ত ছিলাম। তিনিও নতুন কিছু জানলে শেয়ার করতেন।

নিজের খেয়াল রাখার ব্যপারে, পর্যাপ্ত ঘুম বাদে সবই হতো, আলহামদুলিল্লাহ। মেয়ের কারণে রাতে ঘুম সম্ভব ছিলো না। আমি দিনের বেলা ঘুমাতে অভ্যস্ত না তাই রাতের ঘুম দিনে পুষিয়ে নেয়া সম্ভব ছিলো না। খাবারের ব্যাপারে প্রেগন্যান্সি, প্রেগন্যান্সির পরে ভীষণ সমস্যা হয়েছিল। শ্বশুরবাড়িতে খাদেমা ব্যতীত নিজের দেখাশোনা এত সহজ কোন বিষয় না। তারা যেরকম সহযোগিতা করেছিল তা অবশ্যই যথেষ্ট ছিল না। পরিস্থিতি এমন ছিলো, নিজের স্বামীর টাকা দিয়েও নিজের জন্য খাদেমা রাখার সুযোগ ছিলো না। প্রচুর জটিলতা ছিলো। আর্থিক কিছু সমস্যা ছিলো সেসময়।

সমস্যাগুলো ডাক্তার সম্পর্কিত কোন সমস্যা ছিল না। তাই কারও দ্বারস্থ হওয়া লাগেনি। নিজেদের সমস্যা তাই নিজেদের সমাধান করতে হয়েছে।

এখন যেহেতু আলাদা থাকি ইন শা আল্লাহ খাবার সংক্রান্ত, খাদেমা নিয়ে অন্যের সাহায্য নেওয়া সংক্রান্ত সমস্যা হবে না।

এটা এমন একটা বিষয় প্রসব পরবর্তী জিনিস যতই পড়াশোনা করুন মিনিমাম সপ্তাহ খানেক এটার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। আমার কয়েক সপ্তাহ ছিলো। যেহেতু স্বামীর পুরো সহযোগিতা ছিল সবদিক দিয়ে তাই সহনীয় ছিলো, অত বেশি কষ্টের কিছুই ছিলো না। পড়াশোনা দুজনেরই ছিলো কিন্তু পারিনি তো সামাল দিতে। এসময় নামাযও থাকে না। এদিক হতেও মেয়েরা দুর্বল থাকে। সিজারের ব্যাথা, শারীরিক সমস্যাগুলো অসম্ভব ভোগায়। এই ডিপ্রেশনের চেয়ে এই সমস্যা কোন অংশে কম না।

 

কেস স্টাডি ৮ঃ  আহলিয়া শাহরিয়ার

প্রসব পরবর্তী কী কী সমস্যা হয়েছিল তা নিয়ে বলার আগে আমি একটু ব্যাক ট্র্যাক করতে চাই। আমি প্রেগন্যান্সীতে চেষ্টা করেছিলাম অথেনটিক সোর্স থেকে প্রেগন্যান্সী, ডেলিভারী, প্রসব পরবর্তী বাচ্চা ও নিজের যত্ন নিয়ে পড়াশুনা করতে। আরেকটা বড় হেল্প ছিলো হাসপাতালের এন্টিনাটাল ক্লাস। আমি নিজে পড়াশুনার পাশাপাশি আমার জামাইকেও খুব দরকারি ইনফোগুলো শেয়ার করতাম। আমরা ডিনার করার সময় কিংবা রাতে ঘুমানোর আগে এগুলো নিয়ে কথা বলতাম। তাই আলহামদুলিল্লাহ্‌ জামাইও মোটামুটি এসব ব্যাপার নিয়ে অল্প বিস্তর জানতো।

আমাকে ৩৯সপ্তাহ শেষে ইন্ডাকশানে নেওয়া হয়েছিলো। আল্লাহ্‌র অশেষ মেহেরবানীতে ৫দিন ব্যাপী ইন্ডাকশান প্রসেস, ১৯ঘন্টার একটিভ লেবার পেইন, এরপর ডাক্তারের হঠাত এমার্জেন্সী সি-সেকশানের ডিসিশান এই পুরা সময়ে অনেক বেশী সবর করতে পেরেছিলাম।

আমার মধ্যে বেবী ব্লুর সিম্পটম প্রথম শুরু হয় যখন আমার সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করি। বুকের কাছে ধরলেই বেবী কান্না করতো; এমনভাবে চিৎকার করতে করতে লাল হয়ে যেতো যে আমিও সবর করতে না পেরে কান্না করতে থাকতাম। এরপর আরও ভয়াবহ ছিলো আমার জন্য “সেকেন্ড নাইট সিন্ড্রোম”। আশ্চর্যজনকভাবে আমি এই ব্যাপারে কেন যেন কোথাও তেমন কিছু পাইনি এমনকি এন্টিনাটাল ক্লাসেও না। “সেকেন্ড নাইট সিন্ড্রোম” হলো বেবী জন্মের ২৪ঘন্টা পার হলে হঠাত করেই বুঝতে পারে সে আর আগের মতো পানির নিরাপত্তা বলয়ে নেই সাথে গর্ভের সেই নানারকম শব্দও লাপাত্তা। তখন বেবী অনবরত কান্না করে, কোলে থাকতে চায়। আমি যেহেতু এই ব্যাপারে কিছুই জানতাম না প্লাস সারাদিন অনেক বেশী ভিজিটর থাকায় আমার কোন রেস্টও হয়নি সাথে হরমোনাল ইফেক্টে আমার নিজেকে খুব বেশী হতাশ ও ব্যর্থ মা মনে হচ্ছিলো।

পরদিন থেকে বিভিন্ন টেকনিক ব্যবহার করেও যখন বেবীকে ডাইরেক্ট খাওয়ানো গেলোনা তখন দুধ এক্সপ্রেস করে সিরিঞ্জে বেবীকে খাওয়ানো হলো।

আমি বাসায় এসেও অনেক চেষ্টা করে বেবীকে ডাইরেক্ট খাওয়াতে না পেরে এক্সপ্রেস করেই কন্টিনিউ করা শুরু করলাম। আলহামদুলিল্লাহ্‌ ফ্লো অনেক ভালো থাকায় বেবী এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টমিল্ক পাচ্ছিলো কিন্তু ধীরে ধীরে আমার নিজেকে খুবই ব্যর্থ একজন মানুষ মনে হচ্ছিলো। এর সাথে অনেক বেশী মিশুক এই আমার কাউকে ভালো লাগতোনা, অকারণে কান্না পেতো, মন খারাপ লাগতো, মনে হতো বাচ্চার টেক কেয়ার করতে পারছিনা। আলহামদুলিল্লাহ্‌ কখনই আমার বেবীর প্রতি কোন বিরক্তি আসেনি। জামাইয়ের নরমাল কথায়ও অনেক সময় দুঃখ পেয়ে যেতাম; এক্সপ্রেস করে দুধ খাওয়ানোর কথা অনেকের কাছেই বলতাম না কারণ মানুষ নানারকম কথা বলতো আর আমি ভয়াবহ আপসেট হয়ে যেতাম। নিজের যত্নের ব্যাপারে একদমই কেয়ারফুল ছিলাম না। খাওয়া, ঘুম, গোসল সবকিছুর অনিয়ম হতো।

আমি এই সময়ে নামাজ না পড়তে পারলেও যিকির করতাম। মেয়েকে জন্ম থেকেই যিকির করে ঘুম পাড়াতাম। আমার কাছে মনে হয় যে এই যিকিরের জন্যই বোধহোয় খুব খারাপ কোন চিন্তা কখনও আমার মধ্যে কাজ করেনি। সাথে ছিলো জামাইয়ের হেল্প। আমার মনে আছে দুই সপ্তাহের বাচ্চা নিয়ে আমরা সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলাম। জামাইয়ের এই ডিসিশান নেওয়ার পেছনে কারণ ছিলো যেন আমি ভালো বোধ করি। সাথে সুযোগ পেলেই সমমনা প্র্যাকটিসিং বোনদের সাথে দেখা করতাম, কথা বলতাম, বই পড়তাম। আলহামদুলিল্লাহ্‌ বেবী ব্লুর এই স্টেইজ পার হয়ে আমি মোটামুটি ভালো ছিলাম শুধু বাচ্চার দুধের ইস্যুটা নিয়ে মন খারাপ লাগতো।

পোস্ট নাটাল ডিপ্রেশান যে দুই বছরের মধ্যে যেকোন সময় দেখা দিতে পারে তা আমি আমার নিজের জীবন থেকেই বুঝেছি। আমার সন্তানের যখন এক বছর বয়স তখন আমি প্রথম শ্বশুড় বাড়ির মানুষের মুখোমুখি হই। বাচ্চা কেন ব্রেস্টফিড করেনা, ন্যাপি কেন পরাই, একটু মোবাইল কেন দেখতে দেইনা এমন হাজারো অভিযোগে জর্জরিত হয়ে আমি এক সময় ব্রেক ডাউন করি। হরমোনাল কিছু ব্যাপার তো ছিলো সাথে এত এত অভিযোগের তীরে আমি আস্তে আস্তে ডিপ্রেশনের অতল গহবরে হারিয়ে যেতে শুরু করি। নিজের উপর চরম বিরক্ত লাগতো। মনে হতো এত ব্যর্থ আমি মরে গেলেই ভালো (আল্লাহ্‌ মাফ করুক)। আমার কনফিডেন্স একদম জিরো হয়ে গিয়েছিলো। অল্পতেই আমি অনেক বেশী রিয়েক্ট করতাম। অল্পতেই আমি প্যানিকড হয়ে যেতাম। অনেক বেশী পজেটিভ এই আমি পুরাই ১৮০ এঙ্গেলে ঘুরে একজন নেগেটিভ মানুষ হয়ে গেলাম।

আগে থেকে এই ব্যাপারে জানতাম বলেই আমি নিজের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলাম। তাই আমি প্রচুর দোয়া করতাম, যিকির করতাম, সিজদায় গিয়ে অঝোরে কান্না করতাম, আল্লাহ্‌র কাছে সাহায্য চাইতাম, সমমনা বোনদের সাথে নিজের কষ্টগুলো শেয়ার করতাম। মাঝে মাঝে তাহাজ্জুদ পড়ে অনেক কেঁদে কেঁদে দোয়া করতাম সবকিছু সহজ ও বরকতময় করে দেওয়ার জন্য। প্লাস আমার জামাই আলহামদুলিল্লাহ্‌ অনেক হেল্প করেছিলো, আমার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলো (এক দুইবার বাদে আলহামদুলিল্লাহ্‌)। জামাই প্রচুর কাউন্সেলিং করতো আমাকে, সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যেতো। আমাকে লেখালেখি করতে উৎসাহ দিতো। আমাকে আমার পড়াশুনার কাজে ফিরতে অনেক অনেক উতসাহের সাথে সন্তানকে টেক কেয়ার করতো। আমাকে মী টাইম দেওয়ার চেষ্টা করতো, বারাকাল্লাহু ফি।

পরবর্তী প্রেগন্যান্সীতে ইনশাল্লাহ চেষ্টা থাকবে যেন নিজের প্রতি যত্নবান হই। বাচ্চার দেখাশুনার পাশাপাশি দিনে ১০/১৫মিনিট করে হলেও একান্ত নিজের জন্য কিছু করবো সেটা হোক আরাম করে এক কাপ চা খাওয়া, কিংবা একটা আরামপ্রদ গোসল, কিংবা একাকী কিছুক্ষণ বই পড়া কিংবা লিখা। প্রেগন্যান্সী সময় থেকেই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে দোয়া করবো। যিকির, দোয়া কন্টিনিউ রাখার চেষ্টা করবো। নিজের উপর প্রেশার দিবোনা ইনশাল্লাহ।

আমি আমার নিজের লাইফ থেকেই বুঝি যে এই বিষয়ে পড়াশুনা থাকলে আসলে অনেক হেল্প হয়। অন্তত এইটুকু বোঝা যায় যে আমার কিছু সমস্যা হচ্ছে আমার এখন হেল্প দরকার; হোক তা পরিবারের হেল্প কিংবা ডাক্তারের হেল্প। আমার কাছে মনে হয় যে কেস স্টাডি, বেসিক জিনিস, প্রতিকার সবকিছুই কাজে দেয়। তবে হ্যাঁ সবচেয়ে ভালো হয় মাদারহুড অন্যান্য সব বিষয় না হলেও অন্তত এই বিষয়ে স্বামী স্ত্রী দুইজন মিলে জ্ঞানার্জন করা।

 

শেষ পর্ব দেখুন এখানে

লেখাটি কি আপনার উপকারে এসেছে?
হ্যানা