কেইসঃ ২০ মাস বয়সী মারইয়াম হঠাৎই খুব চঞ্চল হয়ে পড়েছে। সব কিছু নিজে করতে চায়। অালমারি থেকে বের করে জামা-কাপড় নিজে পড়তে চায়। জুতা পড়তে চায় নিজে। এমনকি সিঁড়ি বেয়ে নিজে উঠতে যেয়ে পড়েই গেলো একদিন অনেকখানি উপর থেকে। ভাঙা ভাঙা ভাষায় আধো বুলিতে সারাক্ষন বকছে। সবসময় মনোযোগ চাইছে সবার। সবাই শুধু ওর সাথেই কথা বলুক। এই সে নিজে খেতে চাইছে, এই সে চাইছে মা খাইয়ে দিক, এই আবার খেতে চাইছে না। নিজের পছন্দ-অপছন্দ বুঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ঠিকমতো বুঝাতে না পেরে, রেগে যাচ্ছে। এইটুকু বাচ্চার একটুতে কান্না-রাগ, বাবা-মা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না, কি হলো বাচ্চাটার!
মারইয়াম আসলে “দুর্দান্ত দুই” (Terrible Two) এর ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এরকম বয়সী বাচ্চাদের জন্য এটা বেশ স্বাভাবিক অবস্থা। আসলে বাড়ন্ত বাচ্চারা এক এক সময়ে এক এক রকম অবস্থার ভেতর দিয়ে যায়। কখনো মনে হলো বাচ্চা চুপচাপ, শান্ত, আবার কখনো অস্থির। দুই বছর বয়সের বাচ্চা বেশ কিছু ডেভলপমেন্টাল মাইলস্টোনের ভেতর দিয়ে যায়।
এই সময় বাচ্চাদের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য মোটর ডেভেলপমেন্ট হয়। সামাজিক, আচরনগত, অাবেগীয় বেশ কিছু পরিবর্তন আসে। এই সময়ে একটা দুইটা শব্দ বলা বাচ্চার শব্দভান্ডার বাড়তে থাকে। সে গুছিয়ে না হলেও পুরো বাক্য বলতে চেষ্টা করে। নিজের মতো করে চারপাশ আবিস্কারের চেষ্টা করে। এই সময়টাতেই সে বুঝতে পারে, তাকে কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে। যেহেতু কথা বলায় এতটা পটু হয়ে উঠে নি এখনো, নিজেকে সে ঠিকমতো প্রকাশ করতে চাইলেও ব্যর্থ হয় বারবার। এই ব্যর্থতা ধীরে ধীরে তাকে হতাশ করে তোলে। শুরু হয় আচরণগত বদমেজাজ (Behavioral Tantrum)। বাবা-মা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না এসময় কী করবেন।
উল্লেখ্য, টেরিবল টুজ মানেই যে একসম বাচ্চার দুইবছরের সময়েই এরকমটা হবে তেমন না। বরং এক থেকে তিন বছর, যে কোন সময়ের মধ্যে এই অবস্থাটা আসতে পারে। তবে সাধারনত দুই বছরের কথা বলা হয়, কারন এই সময়টাতে নানা ডেভেলপমেন্টাল মাইলস্টোনগুলো প্রকট হয়।
টেরিবল টুজ – কেন হয়?
নিউ ইয়র্কের হ্যাসেনফেল্ড চিল্ড্রেন হসপটালের শিশুরোগ বিভাগের ক্লিনিক্যাল এসিস্টেন্ট প্রফেসর রবিন জ্যকবসন বলেন, “এই বয়সে বাচ্চারা আসলেই খুব স্মার্ট হয়। ২ এর কাছাকাছি সময়ে তারা ভালো হাঁটতে, লাফাতে, কথা বলতে, বুঝতে পারে। তারা অন্যদের নকল করা শুরু করে। তারা নিজেরা সব পরিস্কার করতে চায়, ফোনে কথা বলতে চায়, নিজেদের হাত নিজেরা ধুতে চায়। এমনকি বড়দের রুটিন অনুসরন করতে চায়। কিন্তু তারা এখনো জানে না, কোনটা তাদের জন্য নিরাপদ, আর কোনটা না। এই জন্য তারা তাদের জন্য অনুমোদিত সীমা (Allowed Limit) যাচাই করে দেখতে চায়।” মানসিক দোলাচলের এই সময় বাবা-মা আর বাচ্চা দুইপক্ষই সহজে রেগে যায়। এই সময়টা বাবা-মায়ের জন্য যেমন কঠিন, বাচ্চাদের জন্যও তাই।
টেরিবল টুজ এর লক্ষণসমুহ:
- বাচ্চার নিজেকে ঠিকমতো প্রকাশ করতে না পারা। যখন তার চাহিদাগুলো তার প্রত্যাশা অনুযায়ী পূরন হচ্ছে না, সহজে হতাশ হয়ে যাওয়া।
- সহজে বাচ্চার মন খারাপ হওয়া। কান্নাকাটি, জিনিস ছুঁড়ে ফেলা সহ আচরণগত সমস্যা (Tantrum)।
- বাবা-মাকে, ক্ষেত্রেবিশেষে অন্যদের লাথি দেয়া, কামড়ানো, আঁচড়ানো। নিজেকে আঘাত করা। হুটহাট মাটিকে শুয়ে পড়ে কান্না করা।
- অন্য কারোর সাথে খেলনা বা খাবার ভাগাভাগি না করা। সব কিছুতে “আমি…আমি…আমার” এই বোধ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা।
- প্রায়শই “না” বলা। এমনকি দরকার না হলেও। আসলে এই না বলার মাধ্যমে সে তার বাউন্ডারী পরীক্ষা করে দেখতে চায়।
বাবা-মায়ের জন্য টিপস
- আপনার এবং বাচ্চার দুজনেরই মেজাজ খারাপ হতে পারে। যথাসম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টা করুন। খারাপ সময়গুলোতে বাচ্চার মনোযোগ অন্যদিকে ফেরানোর চেষ্টা করুন। সম্ভব না হলে, চেষ্টা করুন তাকে উপেক্ষা করতে।
- বাচ্চার খাওয়া বা ঘুমের সময়গুলোতে বাইরে যাওয়া এড়িয়ে চলুন। কারন খাওয়া বা ঘুমের অভাবে বাচ্চা এমনিতেই খিটিখিটে হয়ে থাকবে। বাড়ীর বাইরে গেলে, বাচ্চার জন্য সবসময় স্ন্যাক্সস জাতীয় খাবার হাতের কাছে রাখুন।
- যখন বাচ্চা বুঝাতে না পেরে রেগে যাচ্ছে বা মন খারাপ করছে, তাকে বোঝান এবং নরম স্বরে বলুন- “আমি জানি, তোমার মন খারাপ হচ্ছে। এরকম হতে পারে। এসো, দুইজন মিলে ভেবে দেখি, আমরা আর কি করতে পারি।“
- এই বয়সী বাচ্চারা সাধারনত পরিবর্তন পছন্দ করে না। কাজেই যে কোন কাজের আগে তাকে কিছুটা আগে জানান। অন্তত ১০/১৫ মিনিট আগে জানিয়ে রাখলে, তার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে সহজ হয়। ধরুন বাইরে যাওয়ার আগে তাকে বলুন, “আমরা একটু পর বাইরে যাবো।”
- এই সময়টায় বাচ্চারা নিয়ম কানুনের থোড়াই কেয়ার করে। কিন্তু আস্তে আস্তে তাকে বোঝান, সব কাজ নিয়ম মাফিক করতে হয়। সময়মতো খাওয়া, ঘুম। বাচ্চাকে অর্গানাইজ করার উপযুক্ত সময় এটা। তারা চেষ্টা করে দেখতে চাইবে বাউন্ডারী ভাঙ্গতে কেমন লাগে, যেহেতু সে নিজেকে সব নিয়ম থেকে স্বাধীন ভাবতে পছন্দ করে। নিয়ম কানুনের ব্যাপারে শক্ত থাকুন।
- বাচ্চাকে তার বয়স অনুযায়ী কাজে অংশগ্রহনের সুযোগ করে দিন। বয়সের সাথে মিল রেখে বিভিন্ন কাজ একসাথে করুন। তার নিজের খেলনা তাকে গুছাতে দিন। বলতে পারেন, “এসো আমরা খেলনাগুলো একসাথে গুছিয়ে ফেলি তো।“ অথবা “তোমার কাপড় গুছিয়ে রাখতে, আমাকে সাহায্য কর।“
- বাচ্চাকে প্রশংসা করুন। আপনার কাছে মনে হওয়া তার ছোট্ট এচিভমেন্ট, কিন্তু তার কাছে বিরাট। প্রশংসা করুন, যেখবেন সেটা তাকে প্রণোদিত করবে। যেমনঃ “তুমি নিজে জুতা পড়েছ? বাহ, খুব সুন্দর হয়েছে। কিন্তু জান, এই জুতাটা ডানপায়ের আর এটা বাঁয়ের। এসো তোমাকে আমি দেখিয়ে দিচ্ছি, কিভাবে করতে হয়।“
- বাচ্চাকে টেকনিক্যালি ডিসিপ্লিন শেখানোর চেষ্টা করুন। চিৎকার চেঁচামেচি করে কাজের কিছু হয় না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। মাথা ঠান্ডা রাখুন। লজিক কাজে লাগান। বাচ্চারা আসলে বাবা-মাকে অনুসরণ করে। কোন পরিস্থিতিতে কিরকম আচরন করতে হয়, বাচ্চাকে শেখানোর এটাই ভালো উপায়।
- সব কিছুতে না করবেন না। তার বয়স উপযোগী কিছু কাজ তাকে নিজেকে করতে দিন। এতে তার একটা আত্মবিশ্বাস আসবে, যে সে করতে পারে। ধরুন, তার জামাটা, জুতোটা তাকে পড়তে দিলেন (ভুল করলে দেখিয়ে দিন)। পার্কে নিজে তাকে ছেড়ে দিন, যাতে সে নিজের ইচ্ছামতো দৌড়াদৌড়ি করতে পারে। কিন্তু একই সাথে নিয়মানুবর্তীতার ব্যাপারে যত্নবান হউন।
- বাচ্চার মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিন। ধরুন, সে টিভির রিমোট বা আপনার ল্যাপটপ ধরার জন্য কাঁদছে। তাকে তার পছন্দের খেলনা দিন। একটা বই পড়িয়ে শোনান।
- নিয়মকানুনের ব্যাপারে যেটা নেতিবাচক, সেটাকে শক্ত “না” বলতে শিখুন। বাচ্চা কামড়ালে, লাথি দিলে, শক্তগলায় তাকে বলুন “না”। এতে সে বুঝতে পারবে, আপনি আসলেই সিরিয়াস না বলার ক্ষেত্রে।
- কিছু নেতিবাচক ঘটনাকে ইতিবাচকে পরিনত করুন। ধরুন, আপনার বাচ্চা বাসায় বল ছুঁড়ে দিচ্ছে। এতে প্রতিবেশী বিরক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আপনি বাচ্চাকে বলুন, “চলো আমরা বলটা বাসায় না ছুঁড়ে, বাইরে পার্কে যেয়ে খেলি।“
- যা চাইবে বাচ্চা, সাথে সাথেই সেটাই দিয়ে দেবেন না। শপিং এ গেলে বাচ্চা অনেক কিছুই কিনতে চাইবে। তার মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরান, অথবা তাকে বলেন “আমাদের এরকম খেলনা আছে। ওটা দিয়ে আগে খেলি। পরে তোমাকে বাবা কিনে দেবে।“ কিংবা বাইরে থেকে আর বাসায় ফিরতে না চাইলে, বলুনঃ “আমি জানি তোমার বাইরে থাকতে ভালো লাগছে। আমারও লাগে। কিন্তু এখন সন্ধ্যা হচ্ছে, আর আমাদের বাসায় ফিরে যেতে হবে।“
টেরিবল টুজ আসলে বাচ্চার মনোদৈহিক বিকাশের পথে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এটা শুধুই একটা অবস্থা বিশেষ। ধৈর্য্যের সাথে এই সময়টা পার করুন। বিশেষ করে বাবা-মায়েরা ভেবে দেখুন এই অস্থিরতার মাধ্যমে কেবল বাচ্চারা যে আপনাদের কঠিন পরিস্থিতির মাঝে ফেলছে তা না। বরং তারা নিজেরাও কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মেজাজ হারাবেন না। ধৈর্য্য ধরুন, বাচ্চাকে সময় দিন, সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য কামনা করুন এই সময়টা সহজ হওয়ার জন্য।
লেখাটি রিভিউ করেছেন –
ডাঃ সাবেরা সাঈদা খান
M.B.B.S (DU), MPH (Reproductive & Child Health)(NIPSOM),
Diploma in Ultrasonogram
Lecturer, Ibn Sina Medical College
Consultant Sonologist, Trust Medical Care